পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে গত ১৭ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার চলে গেলেন বৃহত্তর খুলনার একজন আদর্শিক পুরুষ সাহিত্যক জনাব শেখ আবদুল জলিল। যিনি ছিলেন সততা ও ন্যায়ের একজন উজ্জ্বল প্রতীক। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক জীবন চালিত করে রেখে গেছেন এক অনুপম আদর্শ।
মরহুম শেখ আবদুল জলিল দেশভাগের দশ বছর আগে ১৯৩৭ সালে খুলনার পাইকগাছা উপজেলার চাঁদখালী গ্রামে ঐতিহ্যবাহী শেখ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শেখ আবদুস সাত্তার, আর মাতা জারিয়া খাতুন। তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। এমনকি মামাতো ও খালাতো ভাই বোনের মধ্যে সকলের বড় হওয়ায় তাঁকে পিতৃকুল ও মাতৃকুলের মধ্যে রড় ভাই হিসেবে ডাকতেন। ছোট শিশুকাল থেকে তিনি গ্রামের অন্য ছেলেদের তুলনায় একটু আলাদা। প্রাইমারিতে পড়ার সময় তিনি ইসলাম ও এর আকীদা এবং তাহজিব ও তমুদদুন সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন। তাঁর চাচা ও চাচীদের কাছে ছিলেন প্রিয় সন্তান।
প্রাইমারি পড়া শেষ করে তিনি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার জন্য বড় মামা পরবর্তীকালে শশুর মরহুম শেখ আবদুল ওয়ারেশ কাছে দরগাহপুরে চলে আসেন। দরগাহপুর আসার পর তার জীবনের চাকা ঘুরে যায়। তিনি তার জীবন গড়ার প্রকৃত গোড়াপত্তন দরগাহপুর থেকে শুরু হয়। তিনি জগৎ বিখ্যাত রসায়নবিদ ও বিজ্ঞানী স্যার পিসি রায়ের রাড়ুলী পিসি রায় বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। দরগাহপুর আসার পর তিনি চার মামা শেখ আবুল হোসেন এ্যাড শেখ আবদুল বারী (যিনি দরগাহপুর সংলগ্ন এলাকায় প্রথম আইনজীবী) ও ছোট মামা হাফেজ মাওলানা শেখ আবদুল করিমের সান্নিধ্য চলে আসেন। নানা শেখ আবদুল মতিন মসজিদের মুয়াজ্জিন থাকায় ছোট বেলা থেকে যেমন নানার সঙ্গে নিয়মিত মসজিদে যেতেন, তেমনি মেজে মামার বইয়ের ব্যবসা থাকায় প্রচুর বই পড়ার সুযোগ পান ও বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলেন। এই সময় তার লেখার হাতে খড়ি হয়। তার প্রথম লেখাটি ছিল ‘ফুটো পয়সার বাহাদুরি’।
মরহুম আবদুল জলিল তার সেজ মামা শেখ আবদুল বারীর নিকট থেকে ইংরেজিতে পারদর্শী এবং ছোট মামা হাফেজ মাওলানা আবদুল করিমের সাথে থেকে আরবিতে পারদর্শী হয়ে উঠেন। হাফেজ আবদুল করিম শুধু তার মামা নন, বন্ধুও বটে।
তাঁর জীবনে প্রভাব পড়েছে জগৎ বিখ্যাত আলেম জমিয়াতে উলামায়ে ইসলামের পশ্চিম বাংলার সভাপতি ভারতের লোকসভার সদস্য ও বসিরহাট আমিনিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মরহুম মাওলানা বজলুল রহমান দরগাহপুরী বিখ্যাত কারী দেশভাগের অন্যতম নেতা অবিভক্ত খুলনা জেলা পরিষদের সদস্য মরহুম কারী মাহমুদ আলী ও প্রখ্যাত সাহিত্যক ও সাংবাদিক মরহুম আবদুল ওহাব সিদ্দিকীর।
তাঁর বাল্য জীবনের বন্ধু ও সহপাঠী ছিলেন এসওএস শিশু পল্লীর বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মরহুম শেখ নিয়ামত আলী, তথ্য অফিসার ও সাহিত্যক মরহুম আমীরুল ইসলাম সিদ্দিকী, বিখ্যাত সাহিত্যিক মরহুম আনিস সিদ্দিকী ও খাদ্য কর্মকর্তা মইনুল ইসলাম সিদ্দিকী। তাঁর খালু ও মামা মরহুম শেখ কবীর আহমেদ সাথে ছিল বন্ধুর মত চলাফেরা। সাতক্ষীরা কলেজ থেকে শিক্ষা জীবন শেষ করে তিনি বসিরহাটে কিছুদিন শিক্ষাকতা করেন। পরবর্তীতে পাইকগাছার দেবদুয়ারে কয়েক বছর শিক্ষাকতা করার পর তিনি খাদ্য বিভাগের চাকরিতে যোগদান করেন।
মাওলানা বজলুল রহমান দরগাহপুরীর সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল, কখনো চিঠির মাধ্যমে আর কখনো সশরীরে। মাওলানা দরগাহপুরী ছিলেন তার আদর্শিক ওস্তাদজী। তিনি ছিলেন ফুরফুরা পীরের ভক্ত। এছাড়াও তার জীবনে মরহুম মাওলানা রুহুল আমীন ও মরহুম মাওলানা ময়েজউদ্দিন হামিদী প্রভাব বিস্তার করে।
তিনি সব সময় আলেম উলামায়েদের ভালোবাসতেন। সকলের সঙ্গে হাসি মুখে কথা বলতেন। পবিত্র কুরআন ও হাদিসের উপর ছিল অগাধ পারদর্শী। তিনি তার সামর্থ্য অনুযায়ী দান করতেন। তিনি প্রতি বছর দানের টাকা লোক মারফত দান গ্রহিতাকে পাঠিয়ে দিতেন। তার একটা বড় গুন ছিল মাসে একবার বা দুবার তিনি আত্মীয় স্বজনদের খবর নেওয়ার চেষ্টা করতেন। যেখানে তিনি চিরদিনের জন্য শায়িত হয়েছেন সেই দরগাহপুর বাগদাদীয়া রহমানিয়া দারুণ কোরআন মাদ্রাসার প্রতি ছিল তার অকৃত্রিম ভালোবাসা। এই মাদ্রাসা উন্নয়নের জন্য তিনি তার মামাতো ভাই মরহুম হাফেজ মাওলানা জাহিদুল বাসার হাফেজ খায়রুল বাসার সাথে আলাপ করতেন। তার আরেক মামাতো ভাই মরহুম আবুল কাশেম মিঠুন (চিত্র নায়ক) ছিল তার ভালবাসার মানুষ।
খাদ্য বিভাগে চাকরি করেও দুর্নীতি তার ধারে কাছেও আসতে পারেনি। তিনি কখনো লোন করা পছন্দ করতেন না। তিনি দরগাহপুর সম্পর্কে এত বেশি জানতেন যে সাবেক বিচারপতি মরহুম কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী ও সাহিত্যক জহুরুল ইসলাম সিদ্দিকী কিছু লিখতে গেলে টেলিফোনে মরহুমের সহযোগিতা নিতেন। পরবর্তীকালে ভাগ্নে শেখ আফজাল হোসেন তার লেখনী চালনার জন্য মরহমের সহযোগিতা নিয়েছেন। শেষ সময় এসে ও তিনি তার সন্তানতুল্য শালী মনজু ও খালাতো ভাই জুলফিকার হায়দারের নিকট থেকে দরগাহপুরের খবর নিতেন। দরগাহপুরের মাওলানা আবদুল হাননান তার অন্যতম প্রিয় মানুষ।
তিনি খাদ্য বিভাগে চাকরি করার পাশাপাশি মাওলানা বজলুল রহমান দরগাহপুরীর জীবনীসহ তিনটি বইয়ের রচয়িতা। তিনি খুলনার ও ঢাকার দৈনিকে প্রায় দু’শতাধিক প্রবন্ধ লিখেছেন।
মরহুমের সহধর্মিণী হাজেরা জলিল একজন ধার্মিক মাহিলা। দুই ছেলে বড় জন আমি এই প্রবন্ধের লেখক ছোট ছেলে ডাক্তার শেখ মাহমুদুল হাসান। একমাত্র মেয়ে নিলুফা সুলতানা শিক্ষিকা। বড়ছেলে সহধর্মিণী কোহিনূর নুরী মুন্নী গৃহিণী তার পিতা খুলনার সাবেক মহকুমা অফিসার মরহুম আবুল কাসেম। বড় ছেলের একমাত্র সন্তান শেখ শাহনেওয়াজ শরীফ। সে পেশায় প্রকৌশলী আর তার সহধর্মিণী কাজী সোনিয়া বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার। ছোট ছেলের সহধর্মিণী হোসনে আরা হাসি গৃহিণী। তার দুটি সন্তান ফোয়ারা ও ওয়ারিস। একমাত্র বোনের জামাই প্রকৌশলী খান ফজলে আহমেদ জাকারিয়া ও একমাত্র কন্যা ফারহা জাকারিয়া ক্রিষ্টাল প্রকৌশলী আর তার জামাই প্রকৌশলী এম ডি হাসান আর মারুফ।
মরহুমের আর একটি বড়গুন ছিল সহজে অন্যকে আপন করে নেয়া। জীবনের প্রথমে যে শিক্ষাকতা শুরু করেছিলেন। শেষ জীবন অবধি সকলকে কিভাবে চলতে হবে সেই শিক্ষা দিয়েছেন। আল্লাহ তাকে জান্নাত বাসী করুন। আমীন। (ফেসবুক ওয়াল থেকে)
খুলনা গেজেট/এনএম