স্বপ্নের অপর নাম পদ্মা সেতু। বাংলাদেশের গর্বের আর এক নাম পদ্মা বহুমুখী সেতু। সর্বশেষ স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়েই পদ্মাসেতুর ৪১ তম স্প্যান বসানোর কাজ শেষ হল। মূল সেতু ব্যবহারের জন্য শিগগিরই খুলে দেয়া হবে। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হচ্ছে পদ্মা সেতুর কাঠামো। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই বহুমুখী সেতুর মূল আকৃতি হবে দোতলা। সেতুর উপরের অংশে যানবাহন ও নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন।
বর্তমান সরকারের অন্যতম সাফল্য পদ্মা সেতু। এই সেতু নির্মাণ নিয়ে নানা রকম জটিলতা জল্পনা-কল্পনার পরও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দৃঢ় অঙ্গীকারই আজকের পদ্মাসেতু। পদ্মা সেতু দেশের অর্থনৈতিতে নতুন এক মাত্রা যোগ কররে। যা শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলেরই নয়, সারাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। পদ্মা সেতুকে ঘিরে এরই মধ্যেই নানা ধরনের অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ চলছে। পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে প্রায় ৪৪,০০০ বর্গ কিলোমিটার (১৭,০০০ বর্গ মাইল) বা বাংলাদেশের মোট এলাকার ২৯% অঞ্চলজুড়ে ৩ কোটিরও অধিক জনগণ প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হবে। এই সেতুর মাধ্যমে আঞ্চলিক বাণিজ্য সমৃদ্ধ হবে, পাশাপাশি দারিদ্র বিমোচন হবে এবং উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির গতি ত্বরান্বিত হবে। দেশের বৃহত্তম এই সেতু নির্মাণ সম্পন্ন হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর সাথে রাজধানীসহ অন্যান্য অংশের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। দেশের ওই অঞ্চল থেকে রাজধানী ঢাকার দূরত্ব গড়ে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত কমবে।
স্বপ্নের এই সেতু নির্মাণের ফলে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর মোংলার গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা অল্প সময়ের মধ্যে পণ্য পরিবহন করে মোংলা বন্দরের মাধ্যমে রফতানি ও আমদানি করতে উৎসাহিত হবেন। দেশের অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিমায়িত মৎস্য ও পাটশিল্প যার অধিকাংশ খুলনা থেকে রফতানির মাধ্যমে আয় হয়ে থাকে। পদ্মা সেতু হলে এই আয় আরও বাড়বে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে যশোর, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, বেনাপোল, দর্শনা ও ভোমরাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমের ব্যবসা-বাণিজ্য অর্থনীতির গতি সৃষ্টি হয়েছে। নদীপথে দেশি ও বিদেশি পণ্যের অভ্যন্তরীণ রফতানিতে যশোরের শিল্পশহর নওয়াপাড়ায় অন্যতম বৃহত্তম নদীবন্দরের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি খনন ও সংস্কার চলছে। পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ প্রকল্পের কাজ চলছে জোরেশোরে। যশোরে দুটি ইপিজেড স্থাপনের তোড়জোড় চলছে।
এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলছে, এটি দেশের আঞ্চলিক ও জাতীয় অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে লক্ষণীয় অগ্রগতি সাধন করবে। এই সেতু চালু হলে মানুষ ও পণ্য পরিবহনের সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে, যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ, জ্বালানী ও আমদানি ব্যয় হ্রাস পাবে।এই সেতুর মাধ্যমে শিল্পায়ন ও বাণিজ্যিক কর্মকন্ড প্রসারের লক্ষ্যে পুঁজির প্রবাহ বাড়বে, পাশাপাশি স্থানীয় জনগনের জন্য অর্থনৈতিক ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এছাড়াও স্থানীয় জনগণ উন্নততর স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষনের জন্য খুব সহজেই রাজধানী ঢাকা যেতে পারবেন। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ টি উপকূলীয় জেলার সাথে রাজধানী ঢাকাসহ পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ শক্তিশালী হবে বা অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ নেটওয়ার্ক শক্তিশালী হবে। ফলে ঐ অঞ্চলের কৃষি, যোগাযোগ, শিল্পায়ন, নগরায়ন, জীবনমান বৃদ্ধি পাবে যা দেশের সার্বিক উন্নয়ন ঘটাবে। পদ্মা সেতুর দুই পাড়ে গড়ে উঠবে বিশ্বমানের শহর। কলকারখানায় ভরে উঠবে এ এলাকা। শ্রমজীবী মানুষের ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। সারা দেশের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি ঘটবে।
অন্যদিকে ঢাকার সাথে কলকাতার যোগাযোগ সহজ হবে। ফলে দ্বি-পাক্ষিক বাণিজ্যের উন্নয়ন ঘটবে। অঞ্চল ভিত্তিক ব্যবসায়ের উন্নতি সব সময় জাতীয় অর্থনীতির উন্নতির নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। ফলে জাতীয় উন্নয়নের মানও উন্নয়নের দিকে ধাবিত হয়।
শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও যোগাযোগব্যবস্থার জন্যই পদ্মা সেতু গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটা জাতির আত্মমর্যাদার প্রশ্নেও গুরুত্ববহ। নিজের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে ইতিহাস সৃষ্টি করতে চলেছে বাংলাদেশ। পদ্মা সেতুর মতো বড় একটা অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে। ভবিষ্যতে এ ধরনের আরো বড় অবকাঠামো নির্মাণে অনুপ্রেরণা হিসেবেই কাজ করবে এটা।
গ্যাস-বিদ্যুৎ-রেল এই তিনে মিলে খুলনা হয়ে উঠবে প্রকৃতপক্ষেই দক্ষিণাঞ্চলের রাজধানী। এমনি একটি স্বপ্ন বাস্তবায়নে পদ্মা সেতু মূলত ‘খুলনার মূল চাবিকাঠি’ হিসেবে গুরুত্ব পাচ্ছে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। পদ্মা সেতুর সুফলের আওতা বাড়াতে এর ওপর দিয়ে স্থাপন করা হচ্ছে রেললাইন। এজন্য রাজধানী ঢাকা থেকে পদ্মা বহুমুখী সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে। এ সেতু বাস্তবায়নের মাধ্যমে শুধু যুগান্তকারী অগ্রগতিই সাধিত হবে না, অর্জিত হবে জাতীয় আস্থা ও সমতা। এটা সুবিদিত যে, অর্থনৈতিক উন্নতির অন্যতম মূল ভিত্তি হলো যোগাযোগব্যবস্থা। সেই সাথে কার্যকর পরিকল্পনা অনুযায়ী বিনিয়োগ।
দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা। আমদানি-রফতানি বাণিজ্য, অভ্যন্তরীণ পণ্য পরিবহন এবং মানুষের যাতায়াত দ্রুত করতে সমৃদ্ধ যোগাযোগব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। পদ্মা সেতু দেশের অর্থনীতির জন্য সেই উন্নত যোগাযোগব্যবস্থার দ্বার খুলে দিচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলা ছাড়াও পুরো দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে পদ্মা সেতু। সেতুর নির্মাণ কাজ যতই এগিয়ে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতির সম্ভাবনার দুয়ার তত খুলছে। পদ্মা সেতুকে ঘিরেই উদ্যোক্তারা দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিনিয়োগের পসরা খুলে বসছেন। হাতে নেয়া হচ্ছে অসংখ্য মেগা প্রকল্প। আবাসন শিল্প, পর্যটন শিল্প, হাইটেক পার্ক, তাঁতপল্লীসহ অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে।
স্বপ্নের এই সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অর্থনীতির পুনর্জাগরণ ঘটবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, পদ্মা সেতুর সঙ্গে বদলে যাবে ওই এলাকার অবকাঠামো, কৃষি, স্বাস্থ্য এবং যোগাযোগ প্রযুক্তির ধারা। একই সঙ্গে এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে যোগাযোগ, বাণিজ্য বৃদ্ধিসহ অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে অর্থনীতিবিদরা আশপোষণ করছেন।
দেশের অর্থনীতিতে পদ্মা সেতুর ভূমিকা নিয়ে বিশ^ব্যাংক অভিমত জানিয়েছে, সেতুটি বাস্তবায়িত হলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২ শতাংশ বেড়ে যাবে। আর প্রতিবছর দারিদ্র্য নিরসন হবে শূন্য দশমিক ৮৪ ভাগ। এর মাধ্যমে অর্থ-সামাজিক উন্নয়নে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার প্রায় ৬ কোটি মানুষের ভাগ্যে পরিবর্তন আনবে পদ্মা সেতু। উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে হাটঁছে বাংলাদেশ। এগিয়ে যাক বাংলাদেশ। গড়ে উঠুক সোনার বাংলা।
(লেখক : সহকারী অধ্যাপক, গণযোগযোগ ও সাংবাদিকতা ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়)
খুলনা গেজেট /এমএম