‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু
নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাহাদের ক্ষমা করিয়াছো,
তুমি কি বেসেছো ভালো?’
রবীন্দ্রনাথের উক্তি দিয়ে আজকের কথাগুলো শুরু করলাম। সারা দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মাইক্রোস্কোপিক অবজারভেশন নিয়ে কথা উঠেছে। মনে হচ্ছে, এত এত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রয়েছে অথচ দুর্বৃত্তদের কাছে যেন কিছুই না। গত ১৬ বছরের মতো এখনো যেন দেশটা দুর্বৃত্ত দ্বারা শাসিত। এখন তো ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর কোনো গুম নেই, অপহরণ নেই, ক্রসফায়ার নেই। এখন তো কেউ চলমান সরকারের উচ্চ পর্যায়ের রোষের শিকার হয়ে যখন তখন যেখানে সেখানে নিরীহ মানুষের উপর সরকারি বাহিনীর হামলা নেই। কিন্তু তবুও মাথার উপর দারুণ আতঙ্ক চেপে রয়েছে। কী সেই আতঙ্ক, গুপ্ত ঘাতকের হাতে মৃত্যুর আতঙ্ক। আততায়ীর হামলায় মৃত্যুর আতঙ্ক! আইন শৃঙ্খলা বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পলিসি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনোভাব বড় একটা ভালো না। কারণ এই সরকার ‘বজ্র আটুনি ফস্কা গেরো’ পলিসিই বেশি পছন্দ করে।
২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের সময় ৫ থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত বলা চলে কোনো সরকারই ছিল না। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক ছিল। ৮ আগস্ট ২০২৪ অন্তবর্তীকালীন সরকার শপথ গ্রহণের মাধ্যমে দায়িত্ব গ্রহণ করে। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) সাখাওয়াত হোসেন। যে-কোনো কারণে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সাখাওয়াত হোসেন বেফাঁস মন্তব্য করার কারণে তুমুল প্রতিবাদ ও জনরোষের শিকার হন। তাঁকে ঐ পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) জাহাঙ্গীর আলম হাওলাদার। গত সতেরো মাসে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এতই ঢিলেঢালা চলছে যে, রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত যে কোনো নাগরিকের জীবন কোনোভাবেই নিরাপদ নয়। সবকিছুই যেন চলছে অগোছালোভাবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সুযোগ্য প্রধান উপদেষ্টা, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ডক্টর প্রফেসর মোহাম্মদ ইউনুস গেল ১৭ মাসে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে করতে মেঘে মেঘে অনেক বেলা বেড়েছে। এরই মধ্যে তাঁর ওয়াদা অনুযায়ী ১১ ডিসেম্বর ২০২৫ আগামী ২০২৬ সালের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন-এর তফসিল ঘোষণা করেছেন। ইতঃপূর্বে পর্যবেক্ষক মহল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সাথে সাথেই দেশের রাজনীতির পরিস্থিতি মুহূর্তে টালমাটাল হয়ে উঠবে। অবশেষে ঘটনা তাই হয়েছে।
১২ ডিসেম্বর দুপুরে তফসিল ঘোষণার মাত্র একদিনের মধ্যে ইনকিলাব মঞ্চের প্রধান সমন্বয়ক শরীফ ওসমান হাদীর উপর হামলা চালিয়ে দুর্বৃত্তরা তাকে গুলি করে পালিয়ে গেছে। আস্তে আস্তে রাজনীতির রূপ-রস গন্ধ প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। গুলিবিদ্ধ শরিফ ওসমান হাদী ঢাকা-৮ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। নির্বাচন ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এ। এরই মধ্যে টার্গেট করে হাদীকে হত্যার মাধ্যমে ঘাতকরা নির্বাচন প্রক্রিয়া বানচাল করার ষড়যন্ত্রে মত্ত হয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, জুলাই বিপ্লবের প্রথম শ্রেণির অন্যতম যোদ্ধা, শরীফ ওসমান হাদীকে কেন হত্যা করার চেষ্টা করা হলো। এ প্রশ্ন আজ দেশের সকল সচেতন নাগরিকের মুখে মুখে! ধারণা করা হচ্ছে, আধিপত্যবাদী, আগ্রাসী, কর্তৃত্বপরায়ণ শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কারণে তাকে হত্যার সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা করা হয়েছে।
এর আগে ভিপি নূরকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। তারপর হেনস্তা করা হয় এ বি পার্টি সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদকে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে, দেশকে অস্থির করতে এবং নির্বাচনকে জুতসইভাবে ভন্ডুল করতে দেশবিরোধী একটি চক্র একের পর এক কুৎসিত পরিকল্পনা এটেই চলেছে। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কী ভাবছেন তা আমাদের বোধগম্য নয়। আমরা সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজকে স্বচ্ছ করার জন্য বারবার বলছি, থানা পর্যায় থেকে শুরু করে রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত সকল থানা এলাকার অপরাধীদের কালো তালিকায় তৈরি করতে হবে। পলাতক পরাজিত ফ্যাসিস্ট সরকারের যে-সব বশংবদ বাংলাদেশে আবার মুখ ও মাথা নেড়ে আধিপত্যবাদের জয় ঢাক বাজাচ্ছে ওদের নজরদারিতে রাখতে হবে, ওদের বিষদাঁত একেবারে ভেঙে দিতে হবে। কোনো প্রকার আইন-শৃঙ্খলা অবনতির ঘটনা ঘটানোর ষড়যন্ত্র করতে চাইলে, তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম সাহেব এইসব ভাবনার একটিও কী ভেবে দেখছেন? বরং তিনি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে এবং আসিফ নজরুল আইন উপদেষ্টার চেয়ারে বসে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ থেকে এক এক করে আওয়ামী লীগের হাই প্রোফাইলের বহু নেতা, আধুলি নেতা নিরাপদে দেশ ত্যাগ করে, বাইরে গিয়ে অন্য দেশ থেকে হুংকার দিচ্ছেন। জনরব ছিল সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বিশেষ ব্যক্তিদের সহযোগিতায় দেশত্যাগের সুযোগ পান। ওবায়দুল কাদের, জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং খুলনার তালুকদার আব্দুল খালেক, ভাতের হোটেলের ডিবি হারুন, এ আর আরাফাত এরা চলে গেল ধরাছোঁয়ার বাইরে! কীভাবে এটা সম্ভব হলো? এখনো পর্যন্ত জনমনে এ প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে!
পুরোনো কাসুন্দি আর ঘাটতে চাই না। সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলবো, বিগত সরকারের আমলে সেট করা ডিসি এসপি, ইউএনও এবং থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের শুধু স্টেশন বদল করে বদলি করে কোনো লাভ হবে না। বরং স্বয়ং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে দেশের ৬৪ জেলার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপারের মাধ্যমে তীক্ষ্ণ নজরদারি ও জবাবদিহির ব্যবস্থা করতে হবে। বারবার আমরা বলে আসছি, বজ্রাঁটুনি ফস্কা গেরো দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চলে না। দুর্জনেরে আঘাত হানো, স্বজনেরে রক্ষা করো- এই পলিসি নিয়ে কৌশলীভাবে হাঁটতে হবে।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সাথে সাথে যখন নির্বাচনী হাওয়া প্রচণ্ডভাবে বইতে শুরু করেছে, নির্বাচনী ট্রেন চলছে, এখন দরকার অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, কালো তালিকাভুক্ত অপরাধীকে গ্রেপ্তার, ভাসমান দুষ্কৃতকারীদের ও ১৪ শিকেয় পুরে ফেলা। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জুলাই বিপ্লব পরবর্তী সময়ে যারা জনগণের সহায় সম্পদ লুট করেছে, গ্রামাঞ্চলে নিরীহ মানুষের জায়গা জমি প্রভাব খাটিয়ে দখল করেছে, চাঁদাবাজির টেন্ডারবাজি করেছে, তাদের সম্পর্কে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কোনো কথা বললে কী মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়?
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি মজবুত না হলে দেশের মানুষের জান মালের নিরাপত্তা না ফিরলে, নির্বাচন ব্যবস্থা যে লেজে গোবরে জড়িয়ে যাবে, তা কী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ সম্যকভাবে জ্ঞাত আছেন? হাদির উপর হামলা হওয়ায় বিষয়টি সেন্সিটিভ বিধায় উপদেষ্টা পরিষদ নড়ে চড়ে বসলেন, এটা কি আইন-শৃঙ্খলা ব্যাপারে দৃশ্যমান অগ্রগতির লক্ষণ? আমরা সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে স্পষ্টভাবে একটি বক্তব্য তুলে ধরতে চাই। ঘোলা জলে মাছ শিকারের স্বপ্নে মত্ত কিছু কিছু রাজনৈতিক দল মনে করছে, প্রশাসন আমাদের, জনগণ আমাদের, প্রয়োজনে আমরা আইন-শৃঙ্খলা সুবিধামতো ব্যবহার করব হাতে তুলে নেব! এ ধরনের মানসিকতায় যারা সরকারকে থোড়াই কেয়ার করছে, স্বেচ্ছাচারিতা করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করার এখনই সময়। ওই সব দল ও প্রভাবশালী ব্যক্তিকে বুঝিয়ে দিতে হবে, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে। বিশেষ দল ও তাদের প্রভাব কোনো কাজে আসবে না। ব্যক্তিত্বের দল বড় কিংবা কারো প্রভাব বড় মনে হতে পারে, কিন্তু দলের চেয়ে সরকারের কাছে এই মুহূর্তে দেশের নাগরিকের অধিকার বড়। দেশ বড়।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে একটি মাইল ফলক হিসেবে চিহ্নিত হবে। সেজন্য সরকারের উচিত হবে একাউন্টটিবিলিটি বা জবাবদিহিতা জোরদার করা আইন শৃঙ্খলা ক্ষেত্রে এমনকি প্রশাসনিক ক্ষেত্রে। পলাতক ফ্যাসিস্ট শক্তি ওত পেতে আছে যে কোনো মূল্যে নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র করা নির্বাচন বানচাল করার হীন উদ্দেশ্যে। আমরা মনে করি সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ এই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচন যদি আটটি বিভাগে পৃথক পৃথক দিনে আট দিন ধরে অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে সরকারের সুদৃঢ় অবস্থান বহাল থাকবে। নির্বাচনও অবাধ শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু হবে। সরকার যদি নির্বাচন কমিশনের সাথে এ ব্যাপারে সুষ্ঠু আলোচনা করতে না পারে আর একই দিনে সারা দেশে নির্বাচন হয় তাহলে যথেষ্ট কেলেঙ্কারির অভিযোগ নির্বাচন কমিশন ও সরকারকে মাথায় নিতে হবে।
এই মুহূর্তে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির আলামত ভালো না। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার উচিত হবে জেলা পুলিশ প্রশাসন, থানা পুলিশ প্রশাসন এবং বিভাগীয় পুলিশ প্রশাসনের একটি সমন্বয়মূলক বৈঠকের মাধ্যমে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া। প্রত্যেক এজেন্সিকে জবাবদিহিতার কথাটিও বিশেষভাবে স্মরণ করিয়ে দেওয়া। সর্বোপরি, জেলা প্রশাসকদের একটি বৈঠকের মাধ্যমে ঘাপটি মেরে থাকা বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের এখনো কেরোসিনের ফোটা যাতে এই নির্বাচনকে কোনোভাবে প্রশ্নবিদ্ধ না করতে পারে এমন লোকদের নির্বাচনে রিটার্নিং ও প্রিজাইডিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
খুলনা গেজেট/এনএম

