শুক্রবার । ১২ই ডিসেম্বর, ২০২৫ । ২৭শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২

দুই সাংবাদিকের ওপর হামলাকারীরা একমাসেও ধরা পড়েনি!

আবদুল কাদের খান

বিশিষ্টজনেরা বলে থাকেন, ‘হাঁড়ির একটা ভাত টিপলেই নাকি টের পাওয়া যায়, গোটা হাঁড়িতে সব ভাত সিদ্ধ হয়েছে কিনা।’ বাংলাদেশের নারীরা রান্নার সময় এই ফর্মুলাটি বিশেষভাবে প্রয়োগ করে থাকেন। সংসার সমাজ দেশ বিশুদ্ধভাবে চলছে কিনা তা বোঝা যাবে কীভাবে? দেশের সর্বত্রই তো একই অবস্থা। ঢিলেঢালা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। কিন্তু এর কারণ কি? যারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত উনারা কী ভীষণ ক্লান্ত? কিন্তু কেন?

কয়েকদিন আগের কথা। খুলনা মহানগরীর সোনাডাঙ্গা থানার নাকের ডগায় পরিকল্পিতভাবে দুর্বৃত্তরা দু’জন সাংবাদিককে নির্দয়-বেধড়ক মারপিট করে। পুলিশ এ পর্যন্ত ওই মারপিটের ব্যাপারে পজেটিভ কি করেছে, আমরা জানতে পারলাম না। গেল মাসের প্রথম দিকে ৮ নভেম্বর, খুলনা মহানগরীর ব্যস্ততম এলাকা শিববাড়ি মোড়ে ‘আমার দেশ’ পত্রিকার দুই সাংবাদিকের ওপর দুর্বৃত্তরা হামলা চালিয়ে তাদেরকে বেধড়ক মারপিট করে। পরদিন যথারীতি খুলনার সচেতন নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ এবং সাংবাদিকরা খুলনা প্রেসক্লাব চত্বরে প্রতিবাদ সমাবেশ করে, এ পর্যন্তই। এ অবস্থায় স্বাধীন দেশের পুলিশের কার্যক্রম দেখে মনে হয়েছে, এ ঘটনার ব্যাপারে পুলিশের কোন দয়িত্বই ছিল না !

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (ইঋটঔ) সহকারী মহাসচিব যুগপৎভাবে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার খুলনা ব্যুরো প্রধান, অত্যন্ত সাহসী সাংবাদিক এহতেশামুল হক শাওন এবং ওই পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার কামরুল হোসেন মনি – এই দু’সাংবাদিক ঐদিন (৮ নভেম্বর, ২০২৫) বিকেলে স্থানীয় কতিপয় দুর্বৃত্তের হাতে বেধড়ক মারপিটের শিকার হন। আমার দেশ পত্রিকার দুঃসাহসী তরুণ সাংবাদিক কামরুল হোসেন মনি জানান, “একটি বিষয় সংক্রান্ত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করার জন্য নগরী শিববাড়ি মোড়ে পৌঁছান মাত্র, পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ৮-১০ জন দুর্বৃত্ত আমার দেশ পত্রিকার খুলনা ব্যুরো প্রধান এহতেশামুল হক শাওনের উপর বেপরোয়াভাবে হামলা চালায়। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুর্বৃত্তরা তাদেরকে বেধড়ক মারপিট শুরু করে।” কামরুল হোসেন মনি জানান, “সাংবাদিক শাওনকে মারপিটের সময় তাকে ঠেকাতে গেলে দুর্বৃত্তরা তাকেও নিষ্ঠুর ভাবে লাঞ্ছিত করে।”

আমার দেশ পত্রিকার খুলনা ব্যুরো প্রধান এহতেশামুল হক শাওন বলেন, “দুপুরে ফোনে এক ব্যক্তির সাথে কথা হয়। তিনি আমাকে শিববাড়ি মোড়ে দেখা করার কথা বলেন। বিকেলে আমার সহকর্মী কামরুল হোসেন মনি সহ আমরা শিববাড়ি মোড়ে পৌঁছালে এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করেন, আমার দেশ পত্রিকার খুলনা ব্যুরো প্রধান শাওন কে? আমি পরিচয় দেওয়ার পর কিছুটা সামনে এগিয়ে এসে ৮-১০ জন দুর্বৃত্ত আমাকে ঘিরে ধরে, এবং কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই বেধড়ক এলোপাতাড়ি মারপিট শুরু করে। আমি আত্মরক্ষার জন্য পাশে হোটেল টাইগার গার্ডেনের ভেতরে দৌড়ে গিয়ে আশ্রয় নেই। এ সময় সহকর্মী কামরুল হোসেন মনিকে একা পেয়ে তাকে যথেচ্ছা বেদম মারপিট করে। কর্মব্যস্ত শিববাড়ি মোড়ে এ ধরনের জীবনসংহারি আক্রমণ করে দুর্বৃত্তরা যখন তাদের ক্ষোভ মিটাচ্ছিল, তখন ওখানে কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন দেখা যায়নি। নগরীর একটি সেনসিটিভ এলাকা এবং বলা চলে সোনাডাঙ্গা থানার চোখের উপরে অথচ পুলিশ বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাউকে আমাদের চোখে পড়েনি।”

স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, “পূর্ব থেকেই ওইসব দুর্বৃত্তরা একটি মাইক্রোবাসে করে এসে সাংবাদিকদের হামলা করার জন্য ওৎ পেতে থাকে। খোদ মহানগরীর একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দুর্বৃত্তরা নিরীহ সাংবাদিকদের উপর অনেকক্ষণ ধরে হামলা চালালো অথচ দুর্বৃত্তদের প্রতিরোধ করার জন্য জনবহুল ওই এলাকায় আইন সংস্থার কাউকেই পাওয়া গেল না। তাহলে পুরো মহানগরীর অন্যান্য থানার চিত্র বিশেষ করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে কি তা সহজেই অনুমান করা যায়।”

দুর্বৃত্তদের অভয়াশ্রম যদি হয় খুলনা মহানগরী তাহলে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে পুলিশ কিংবা অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোক পুষবার দরকার কি? এই ঘটনা স্থানীয় জনমনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দায়িত্ব পালনে উদাসীনতা দেখে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার করেছে।

মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়ন খুলনার সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক রানা অত্যন্ত ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “এ ধরনের ঘৃণ্য হামলায় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাই দায়ী। সাংবাদিকদের উপর বারবার দুর্বৃত্তদের দ্বারা এ ধরনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। প্রশাসন, বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসন পুরোপুরি নীরব। পূর্বের হামলার দোষীদের গ্রেপ্তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি অর্থাৎ অপরাধীদের বিচার হলে এমন ঘটনা আবার ঘটতো না।

খুলনা মহানগরী বিএনপি সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম তুহিন বলেছেন, “আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তেমন তৎপরতা নেই বললেই চলে। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন তাদের উপর আরোপিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না। আমি এ হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। একই সঙ্গে হামলা কারীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।”
এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনার পর খুলনার সাংবাদিক সমাজ তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা জানায়। খুলনা প্রেসক্লাব, খুলনা মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন খুলনা ইউনিট, সরকারি সুন্দরবন কলেজ স্টুডেন্ট ফোরাম ও খুলনা অনলাইন জার্নালিস্ট ইউনিয়ন নেতারা তৎক্ষণাৎ হামলাকারীদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।

সোনাডাঙ্গা থানার অফিসার ইনচার্জ কবির হোসেন বলেন, “মোবাইল ট্রাকিং করে হামলাকারী বিপ্লবের ঠিকানা পেয়েছি। আরো পরিষ্কার হওয়ার জন্য আমরা ঘটনা স্থলের পাশের একটি ব্যাংক থেকে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে হামলাকারীদের অচিরেই গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হব।”

খুলনা মহানগর বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী খুলনা অঞ্চল নেতৃবৃন্দ এ ঘটনায় তীব্র ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সোনাডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আশ্বাস বাক্য উচ্চারণ করেই দায়িত্ব থেকে খালাস পেতে পারেন না। কারণ এত এত জনবল কাঠামো সত্ত্বেও শিববাড়ি মোড় অরক্ষিত থাকা এবং ঘটনা সংঘটনের সময় পুলিশ যদি তৎপর না থাকে, তাহলে তাদেরকে ঐ দিন কোথায় রাখা হয়েছিল? এ প্রশ্নটি সঙ্গতভাবেই এসে যায়।

৮ নভেম্বর ২০২৫ থেকে আজ ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই ঘটনার কী অগ্রগতি হয়েছে? নগরবাসী তা জানতে চায়। দুর্বৃত্তদের যারা লালন পালন করে সেই গডফাদারদের কোনো ব্লাক লিস্ট কী তৈরি করা হয়েছে? নগরীর সচেতন মহল তা জানতে চায়। এরপর যদি নিরীহ সাংবাদিক সহ নাগরিকদের জানমালের উপর হাত পড়ে, তাহলে সে দায়-দায়িত্ব স্থানীয় থানার পুলিশকেও নিতে হবে।

ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্তৃপক্ষের উচিত হবে সোনাডাঙ্গা থানা পুলিশের অযোগ্য কর্মকর্তাকে এই ব্যর্থতার দায়ে ক্লোজ করে তাদেরকে পুলিশ লাইনে ন্যাস্ত করা। তারা ব্যস্ততা দোহাই পেড়ে শিববাড়ি এলাকার এই ঘৃণ্য ঘটনার দায় কোনোভাবে এড়াতে পারে না।

আমরা স্পষ্টভাবে মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলবো, “আইন-শৃঙ্খলার নামে ইঁদুর বিড়াল খেলা তো দীর্ঘ ১৫-১৬ বছর চলছে। অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে আপনাদের ইউনিফর্মের মর্যাদা রক্ষার জন্য এই ঘটনাটি প্রথম ও শেষ মনে করে জনমনে আস্থা ফেরানোর দিকে আল্লাহর ওয়াস্তে একটু নজর দিন। জনগণ আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছে, এ ব্যাপারে আপনারা কি করেন তা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। দেখা যাক এ ব্যাপারে আপনাদের কতটুকু সদিচ্ছা আছে। আশা করি আস্থার জায়গাটি নষ্ট হতে দেবেন না।”

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন