শুক্রবার । ১২ই ডিসেম্বর, ২০২৫ । ২৭শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২
বিজয়ের স্মৃতিকথা

মুক্তিযুদ্ধে গৌরবগাঁথা খুলনার কমার্স কলেজ

নিজস্ব প্রতিবেদক

পাকিস্তান জামানায় ১৯৭০ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। এ অভূতপূর্ব বিজয়ের পর জয়ী দল একাত্তরের জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য শুভ মুহুর্ত গুণতে থাকে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেঃ আগা ইয়াহিয়া খান একাত্তরের ৩ মার্চ জাতীয় সংসদের অধিবেশনে আহ্বান করেন। বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়, একাত্তরের ১ মার্চ। সকাল থেকে খুলনা শহরে ইথারে ইথারে খবর ভেসে আসে পাক প্রেসিডেন্ট রেডিও এবং টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। দুপুর ১টা নাগাদ প্রেসিডেন্টের ভাষণের পরিবর্তে রেডিওতে জাতীয় সংসদের ৩ মার্চ এর অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা প্রচারিত হয়।

ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে শহরের স্কুল কলেজ বন্ধ হয়ে যায়। ছাত্রাবাস ছেড়ে শিক্ষার্থীদের একাংশ গ্রামে ফিরে যায়। শিক্ষাঙ্গণের পাশের মেসে স্বাধীনতা প্রত্যাশী ছাত্ররা অবস্থান করে। তখনকার দিনে এখানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা মেডিকেল কলেজ ছিল না।

সে সময় শহরের বেসরকারি কলেজের মধ্যে এটি সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান। তা ছাড়া এ কলেজ মূল শহরে অবস্থিত হওয়ায় ছাত্র রাজনীতির প্রাণ কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। ২ মার্চ এ কলেজ প্রাঙ্গন থেকে স্বাধীনতার দাবিতে ছাত্রলীগের একটি জঙ্গি মিছিল শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে এ কলেজ ছাত্র সংসদে ভি.পি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ছাত্রলীগ নেতা শাহনেওয়াজ জামান চৌধুরী আজাদ ও জি.এস আফজাল হোসেন।

এ কলেজে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্তরা হচ্ছেন মরহুম জাহিদুর রহমান জাহিদ, বিনয় ভূষণ চ্যাটার্জী, জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সুশান্ত কুমার নন্দী, যুগ্ম সম্পাদক শেখ আব্দুল কাইয়ুম, সৈয়দ মনোয়ার আলী, মোঃ কায়কোবাদ আলী, স ম আব্দুস সাত্তার, আব্দুস সবুর, শাহ আবুল কাশেম, শাহ আবুল কালাম, এস. এম দাউদ আলী, ফেরদৌস আলম, গোলাম রসুল, কুদরুত ই এলাহী, মিজানুর রহমান, মোঃ সোবহান গোলদার, টি এম নিজানুল হক, রুহুল আমিন, মোঃ আবু জাফর, শেখ জামসেদ হোসেন, লাল প্রমুখ। ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এর রাজনীতির সাথে সম্পৃক্তরা হচ্ছেন নারায়ণ চন্দ্র (পরবর্তীতে অধ্যক্ষ), রনজিৎ দত্ত, মোঃ লিয়াকত আলী মিনা, এম আব্দুল্লাহ (পরবর্তীতে শেখ হাসিনা সরকারের ধর্মমন্ত্রী), আব্দুল মজিদ মল্লিক,আমিনুল হক, সাদিক পল্টু ও ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ)-এর হারণ-অর-রশীদ।

হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর এস এ হাসিব (১৯৬৩-১৯৯৭ পর্যন্ত দায়িত্বকাল) এর জীবদ্দশায় বর্ণনা মতে, বাংলা বিভাগের তৎকালীন প্রভাষক হারুণ অর রশীদ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেন। তিনি তেরখাদা উপজেলার অধিবাসী। জামায়াতে ইসলামী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। এ কলেজের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক এ বি এম রশীদুজ্জামান ও ভূগোল বিভাগের প্রভাষক জি এম মহিউদ্দিন পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার পক্ষে অবস্থান নেন।

৩ মার্চ বিকেলে ছাত্র সমাজ খুলনা শহরের কালী বাড়ি রোড ও কে ডি ঘোষ রোডস্থ কয়েকটি বন্দুকের দোকান লুটের মাধ্যমে অস্ত্র সংগ্রহ করে। এতে কমার্স কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী শেখ কামরুজ্জামান টুকু, বি কম শেষ বর্ষের ছাত্র সুশান্ত কুমার নন্দী, শেখ কাইয়ুম প্রমুখরা অংশ নেন।

২৩ মার্চ সকাল ১০ টায় সাদা পোশাকে সুসজ্জিত হয়ে জয় বাংলা বাহিনী মিউনিসিপাল পার্কে উপস্থিত হয়। এ বাহিনীর প্রধান শেখ আব্দুল কাইয়ুম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন। খুলনায় এই প্রথম পতাকা উত্তোলন। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে হয়, ১৯৬৪ সালে এ প্রতিষ্ঠানে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন শেখ কামরুজ্জামান টুকু। এখান থেকেই তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি বৃহত্তর খুলনা মুজিব বাহিনীর প্রধান ছিলেন। দক্ষিণ জনপদে এ বরেণ্য মুক্তিযোদ্ধা কমার্স কলেজের গর্ব। এ প্রতিষ্ঠানের আরও একজন গর্বিত শিক্ষার্থী শেখ আব্দুল কাইউম মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা হচ্ছেন, বৃহত্তর খুলনা মুজিব বাহিনী প্রধান শেখ কামরুজ্জামান টুকু, ডেপুটি কমান্ডার শেখ আব্দুস সালাম, জয় বাংলা বাহিনীর প্রধান শেখ আব্দুল কাইউম, কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি শাহানেওয়াজ জামান চৌধুরী আজাদ, টিএম নিজানুল হক, মোঃ মনিরুজ্জামান মনি (পরবর্তীতে মেয়র, খুলনা সিটি কর্পোরেশন), মোঃ আব্দুল হালিম, মোঃ আবু জাফর, স.ম. আব্দুস সাত্তার, মোঃ কায়কোবাদ আলী, মোঃ আব্দুল্লাহ (শেখ হাসিনা সরকারের ধর্ম মন্ত্রী), আনোয়ার হোসেন আনু (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ), আব্দুল মান্নান (পাকবাহিনীর হাতে শহীদ), এস. এম. দাউদ আলী (পরবর্তীতে ভিপি), মোঃ আবু জাফর, ইত্তেহাদুল হক, শেখ শাহাদাত হোসেন বাচ্চু, মুন্সি আইয়ুব হোসেন, শেখ মাহাতাব উদ্দিন, মোকলেছুর রহমান বাবলু, রবিউল ইসলাম খান চৌধুরী তিনু ও মেজর (অবঃ) শেখ জামশেদ হোসেন।

শহীদ আব্দুল মান্নান: এ কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আব্দুল মান্নান। তিনি থাকতেন সাউথ সেন্ট্রাল রোডস্থ মসজিদে তৈয়েবার পেছনে। জুলাই মাসের শেষ দিকে পরিবার পরিজনকে দেখতে সাউথ সেন্ট্রাল রোডস্থ বাড়িতে আসেন। গোয়েন্দা সূত্রে খবর পেয়ে পাকবাহিনী তাকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে কয়েকদিন আটকে রাখে। শারীরিকভাবে নির্যাতন করায় তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তাকে হত্যা করে গল্লামারী ময়ূর নদে তীরে ফেলে দেওয়া হয়। তার লাশের সন্ধান পাওয়া যায়নি। শহীদের স্মরণে কমার্স কলেজে ব্যয়ামাগারের নামকরণ করা হয় আব্দুল মান্নানের নামানুসারে।

শহীদ আনোয়ার হোসেন আনু : ৭ ডিসেম্বর কপিলমুনিতে রাজাকার ক্যাম্পের পতন হয়। যুদ্ধে তিনজন শহীদ হন। তার মধ্যে একজন কমার্স কলেজের ছাত্র আনোয়ার হোসেন আনু। ৭১ সালে তিনি বি.কম শেষবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। খুলনার রূপসা থানার মুছাব্বরপুর গ্রামের শেখ মিরাজউদ্দিনের পুত্র। প্রথমে তালা থানার শাহাজাতপুর গ্রামে তাকে দাফন করা হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী রূপসা থানার মুসাব্বরপুর গ্রামে পারিবারিক গোরস্তানে দাফন করা হয়।

বিজয়ের পর ক্যাম্প : ১৭ ডিসেম্বর খুলনা মুক্ত হয়। পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা খুলনায় আসতে শুরু করে। বৃহত্তর খুলনা মুজিব বাহিনীর প্রধান শেখ কামরুজ্জামান টুকুর তত্ত্বাবধায়নে কমার্স কলেজে ক্যাম্প স্থাপন হয়। বিধ্বস্ত খুলনা শহরের পুনর্বাসনের জন্য ভারতের আনন্দ মার্গী নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান এ কলেজে এসে অবস্থান করে। তারা মার্চ পর্যন্ত খুলনা শহরে পুনর্বাসনের কার্যক্রম পরিচালনা করে।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন