ব্রিটিশ শাসন আমল (১৮৫৭-১৯৪৭)। তখন খুলনা শহরের পরিধি স্বল্প পরিসরের। যশোর থেকে পৃথক হয়ে ১৮৮২ সালে খুলনা পৃথক জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৮৮৬ সালে খ্রীষ্টান ধর্ম প্রচারের জন্য কয়েকজন ধর্মযাজক খুলনাঞ্চলে আসেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ইউবিয়াস্কী। কৃষ্ণনগর ধর্ম প্রদেশের অধীনে খুলনা শহরকে কেন্দ্র করে তারা জনকল্যাণমূলক কাজে সম্পৃক্ত হন। ব্রিটিশ জামানায় ভারতবর্ষে তখন লর্ড লিনলিথ গাও (১৯৩৬-১৯৪৩) ভাইসরয়। তিনি খ্রীষ্টান ধর্মালম্বীদের কিছু সুযোগ সুবিধা দেন। কৃষ্ণনগর মিশনের কর্মকর্তারা ১৯৩৯ সালে খুলনা শহরে আহসান আহম্মেদ রোডে কিছু জায়গা কেনেন। ১৯৪০ সালে খানজাহান আলী রোড ও আহসান আহম্মেদ রোডের সংযোগস্থলে কেনা জায়গায় গড়ে ওঠে সেন্ট যোসেফস এম ই স্কুল। পরবর্তীতে নামকরণ করা হয় সেন্ট যোসেফস হাইস্কুল। (ড. শেখ গাউস মিয়া রচিত মহানগরী খুলনা ইতিহাসের আলোকে)।
ব্রিটিশ জামানা থেকে আজ পর্যন্ত এটি মেধাবী শিক্ষার্থীদের পীঠস্থান। ৮৩ বছর বয়সি এ প্রতিষ্ঠান ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা স্মৃতিচারণ করে আসছে।
১৯৭০ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে প্রাক্তন শিক্ষার্থী শেখ আব্দুস সালাম, স ম বাবর আলী, এ্যাডঃ মনোরঞ্জন দাস, ইস্কান্দার কবীর বাচ্চু, শেখ আব্দুল কাইয়ুম বলিষ্ঠ সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা খুলনা জেলা ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্ব পর্যায়েও ভূমিকা রাখেন। এ অভূতপূর্ব বিজয়ের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়া শুরু করে। বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়, একাত্তরের ১ মার্চ। সকাল থেকে খুলনা শহরে ইথারে ইথারে খবর ভেসে আসে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট রেডিও ও টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। দুপুর ১টা নাগাদ প্রেসিডেন্টের ভাষণের পরিবর্তে রেডিওতে জাতীয় সংসদের ৩ মার্চ এ অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা প্রচারিত হয়। রেডিওতে এ ঘোষণার প্রতিবাদে খুলনা শহরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছাত্র জনতা জঙ্গি মিছিল নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। সোচ্চার করে ছাত্রজনতার স্লোগান ছিল ‘জয় বাংলা’, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ছয় দফা না এক দফা স্বাধীনতা স্বাধীনতা, বীর বাঙালি অস্ত্রধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে শহরে দেওয়াল লিখনের প্রয়োজন হয়। মার্চের প্রথমে গভীর রাতে দেওয়াল লিখনের নেতৃত্ব দেন জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক ও এ প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন শিক্ষার্থী শেখ আব্দুল কাইয়ুম। অন্যান্যের মধ্যে অংশ নেন এ প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন শিক্ষার্থী আ ব ম নূরুল আলম, অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী সুশান্ত কুমার নন্দী, আব্দুস সবুর, তালুকদার আব্দুল খালেক, ইউসুফ আলী ভূইয়া, নুরুল ইসলাম খোকন ও শামসুদ্দোহা টিপু। ছাত্রলীগ এ ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। শহরের আহসান আহমেদ রোড¯ টিএন্ডটি অফিস (অধুনালুপ্ত), পিকচার প্যালেস ভবন, নগর ভবন ও তৎকালীন স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান (আজকের বাংলাদেশ ব্যাংক), খুলনার প্রধান গেটে গভীর রাতে দেওয়াল লিখন হয়।
সেন্ট যোসেফস হাইস্কুলের প্লাটিনাম জুবলী উপলক্ষ্যে স্বরণিকা জ্যোতিতে বিদ্যালয়ের ইতিহাস নামক প্রবন্ধে সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ অহিদুল্লাহ উল্লেখ করেন, ১৯৭১ সালের ১৮ জানুয়ারি অমিয় গাব্রিয়েল মল্লিক প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন (তিনি প্রথম বাঙালি প্রধান শিক্ষক)।
১ মার্চ সরকারি বিএল কলেজে বি এ অনার্স পরীক্ষা চলছিল। কলেজের অধ্যক্ষ এবি চৌধুরী সেদিন বেতারের ঘোষণা এবং সংসদ অধিবেশন স্থগিতের খবর পরীক্ষার্থীদের অবহিত করেন। খবর পেয়ে এ প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও বিএল কলেজ ছাত্র সংসদের তৎকালীন ভিপি স ম বাবর আলীর নেতৃত্বে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা বর্জন করেন। তারা কলেজ অঙ্গন থেকে জঙ্গি মিছিল বের করে। বিকেলে ছাত্রলীগের উদ্যোগে আযমখান কমার্স কলেজ থেকে বিক্ষোভ মিছিল হাদিস পার্কের উদ্দেশ্যে বের হয়।
৩ মার্চ বিকেলে ছাত্রসমাজ শহরের কালীবাড়ি রোড ও কে ডি ঘোষ রোডের কয়েকটি বন্দুকের দোকান লুট করে মুক্তিযুদ্ধের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ করে।
জয় বাংলা বাহিনীর প্রধান, এ প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন শিক্ষার্থী শেখ আব্দুল কাইয়ুম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন। খুলনায় এই প্রথম পতাকা উত্তোলন।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এ প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা হচ্ছেন মরহুম শেখ আব্দুস সালাম, (জেলা মুজিব বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার), স ম বাবর আলী (১৯৭৩ সালে সংসদ সদস্য), মরহুম ইস্কান্দার কবীর বাচ্চু, শেখ আব্দুল কাইয়ুম (জয় বাংলা বাহিনীর প্রধান, খুলনা), মরহুম এ্যাড. শেখ আব্দুস সাত্তার, মরহুম খন্দকার সাজ্জাদ আলী, প্রয়াত এ্যাড. মনোরঞ্জন দাস, আশরাফুল আলম টুটু, এ্যাড. আ ব ম নূরুল আলম, তৌফিক উদ্দীন আহমেদ, (শ্রীউলা, সাতক্ষীরা), মেজর (অবঃ) শেখ জামসেদ হোসেন, এম এম ওয়াহিদুন্নবী, বাগমারার প্রয়াত তপন কুমার বিশ্বাস, হুমায়ুন কাদির খান দুলাল, প্রকৌশলী হারুণ অর রশিদ, ড. সরদার নুর নেওয়াজ, ইঞ্জিনিয়ার সাইফুল ইসলাম, জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য মরহুম এ্যাড. ফিরোজ আহমেদ, মরহুম খন্দকার খায়রুল কবীর লনি, শেখ মাহতাব আলী, (কাচনা, মোল্লাহাট, বাগেরহাট), আব্দুল্লাহ হিল সাফী, মতিউর রহমান তরফদার, আতিয়ার রহমান তরফদার, মনোয়ার সানী ফরিদ ও বীরেন দাস বিরু (স্বাধীন বাংলা ফুটবল টিম)।
সেন্ট যোসেফস হাইস্কুলের প্লাটিনাম জুবলী উপলক্ষ্যে জ্যোতি নামক স্মরণিকায় স্বাধীনতা সংগ্রামী (প্রাক্তন শিক্ষার্থী) আব্দুল্লাহ হিল সাফী ‘১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের স্কুল’ নামক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, ১৯৬৯ সালে ক্লাস নাইনে পড়াকালীন সময়ে গণআন্দোলনে অংশ নেই। ছিল সকল শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ। এটি এ প্রতিষ্ঠানের বড় অর্জন।
এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা খুলনা ও সাতক্ষীরার বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে গল্লামারী বেতার কেন্দ্র, পাইকগাছা হাইস্কুল, বারোআড়িয়া, বুধহাটা, জেঠুয়া, কপিলমুনি, পারুলিয়া, খানজিয়া ও কালিগঞ্জের যুদ্ধে অংশ নেন। শিক্ষার্থীদের একটি অংশ খুলনার ফুলতলা থানার ডাবুরের মাঠে, অপর অংশ ঢাকা স্টেডিয়ামে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র জমা দেন। এসএসসি পরীক্ষার্থীরা বিজয়বেশে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফিরে মুক্ত বাতাসে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করে বিজয় উল্লাস করে।
খুলনা গেজেট/এনএম

