কাজী আব্দুল খালেক। আদি বাসিন্দা দৌলতপুর সংলগ্ন গাইকুড় গ্রামের। তিনি মুহসিন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। পাশাপাশি সাংবাদিকতা করতেন পাকিস্তান অবজারভার নামক ইংরেজি দৈনিকে। খুলনার সাপ্তাহিক আওয়াজ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। সৃজনশীল মানুষ।
১২ মার্চ, ১৯৭১ সাল, সময় বেলা তিনটা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও বিহারিরা সশস্ত্র অবস্থায় তার বাড়ি ঘিরে ফেলে। দরজা ভেঙে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে। অটোমেটিক চাইনিজ রাইফেল তার বুকে চেপে ধরে। তাকে উদ্দেশ করে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তার প্রশ্ন ‘তোম বাঙালি হায়, না বিহারী হায়’। উত্তরে তিনি জানান ‘হাম পাকিস্তানি মোহাজির হায়’। তার দ্বিতীয় প্রশ্ন ‘তোম আওয়ামী লীগ মে হায়, তোম আওয়ামী লীগ কো ভোট দিয়া’। উত্তরে তিনি বলেন, ‘মেই আওয়ামী লীগকো সাপোর্ট কিয়া, আওর আওয়ামী লীগ মে ভোট দিয়া, ৯৯ পারসেন্ট লোকনে আওয়ামী লীগ মে ভোট দিয়া, তো হামভী দিয়া, মাগার, মেই আওয়ামী লীগ মে ইলেক্টেড মেম্বার নেহি হায়’। পাকিস্তানি সেনারা বাড়ির বাইরে এনে তাকে ট্রাকে তোলে। ট্রাকে আরও ৭-৮ জন বাঙালি ছিলেন। তার মধ্যে খালিশপুরের পুলিশের ডিএসপি ও ওয়াপদার একজন কর্মকর্তা ছিলেন। পুলিশ কর্মকর্তার রক্তাক্ত শরীর ও ওয়াপদার কর্মকর্তার মুখের এক পার্টি দাঁত ভাঙা ছিল। একজন সেনা কর্মকর্তা কাজী খালেককে দেখে প্রশ্ন করে, ‘তুম বাঙালি হায় না বিহারী হায়’। তার উত্তরে তিনি জানান, ‘পাকিস্তানকা মোহাজের হায়’। পাল্টা প্রশ্ন ‘তোমহারা আইডেন্টিটি কার্ড হায়’। আইডেন্টিটি কার্ড দেখানোর পর এবং নিখুঁতভাবে উর্দু বলতে পারায় সেনারা সে যাত্রায় তাকে ছেড়ে দিয়ে যায়।
দ্বিতীয় ঘটনা ৭ জুলাই। দৌলতপুর থানা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে মহাকুমা হাকিমের আদালতে নিয়ে যায়। তখন আদালতের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। পুলিশ বাধ্য হয়ে তাকে জেল হাজতে পাঠায়। জেল হাজতে গিয়ে তিনি আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ নেতা, কলেজের শিক্ষক ও বাঙালি পুলিশ অফিসারদের দেখতে পান। তাদের শারীরিক অবস্থা শোচনীয়। কেউ শারীরিকভাবে দুর্বল আবার কারও গায়ে চুলকানি পাঁচড়া। প্রথম দিন তাকে জেল হাজতের ছোট্ট একটি কক্ষে রাখা হয়। এই কক্ষের ধারণ ক্ষমতা ৫০ জন। অবস্থান করেন ৪শ’ ওপরে কয়েদি। প্রত্যেককে কাত হয়ে শুয়ে থাকতে হয়। প্রত্যেক রাতে পাকিস্তানি সেনারা কারাগার থেকে কয়েদিদের নিয়ে যেত। কয়েদীরা আর ফিরে আসত না। সেনারা সার্কিট হাউজ ময়দানে নানা বয়সি বাঙালিদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করত, ভৈরব নদের পাড়ে নিয়ে জবাই করে লাশ ফেলে দিত। কারাগারে আসামি ও কয়েদিদের যে ডাল ও ভাত দেওয়া হতো তা খাওয়ার রুচি কারও থাকতো না। কয়েদিদের কক্ষের এক কোনায় টয়লেট, দুর্গন্ধে টিকে থাকা কষ্টসাধ্য। ৯ জুলাই মহকুমা হাকিমের আদালতে পাঁচশ’ টাকা সিকিউরিটি ভিত্তিতে জামিন হয়। আত্মীয় স্বজনরা তার জামিনের খবর কারাগারে পৌঁছে দেয়। কারাগার থেকে নৌসেনারা তাকে খালিশপুর নেভাল বেজে নিয়ে যায়। সেখানে বিহারী হত্যার মিথ্যা অভিযোগ এনে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। নেভাল বেজের নৌসেনা কর্মকর্তা ছিল কর্নেল গুলজার। নৌসেনা কর্মকর্তা তাকে বারবার জিজ্ঞাসা করত তুমি কত বিহারীকে হত্যা ও নির্যাতন করেছ। উত্তরে তিনি বলতেন, আমি বিহারী হত্যার সাথে সম্পৃক্ত নই। সেনা কর্মকর্তার নির্দেশে তাকে নেভাল বেজের জঙ্গল পরিষ্কার করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কাঁচিতে আঙুল কেটে দুই ভাগ হয়ে যায়। তিনদিন এভাবেই কাজ করতে হয়। প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত আবার ২টার কিছুক্ষণ পর থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ঘাস কাটতে হতো। খাবার ছিল একটা রুটি। এরই মধ্যে একদিন যখন ঘাস কাটছিলেন একটি শিয়াল ঘাস বনের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ায় ঘাস নড়ছিল। নৌসেনাদের ধারণা মুক্তিবাহিনী প্রবেশ করেছে। সাথে সাথে তারা পজিশন নেয়। সেখানে মুক্তিবাহিনী আসেনি। তবুও তারা আতঙ্কগ্রস্ত। এরই এক পর্যায়ে ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন তাকে দেখে সিপাহীদের নির্দেশ দেয় কাজী খালেককে তার চেম্বারে নিয়ে আসতে। পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন রোলার দিয়ে তার শরীরে আঘাত করে। ক্যাপ্টেন তার কাছে প্রশ্ন করে ‘তোম শালা বহুত বিহারীকো খতম কর দিয়া আওর বহুত বিহারীকো আওরাতকে ইজ্জত লিয়া’। তারপরে রোলার দিয়ে সেনা কর্মকর্তা কাজী খালেকের ওপর একের পর এক আঘাত করে। পায়ে শিকল দিয়ে উল্টো দিকে ঝুলিয়ে রাখতো। তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়তেন। অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতেন। দু’দিন পর এ ঘটনা জানতে পেরে কর্নেল গুলজারি আহত কাজী খালেকের চিকিৎসার ব্যবস্থ করেন, এ অপরাধে নেভাল ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিনকে চট্টগ্রামে বদলি করে। নেভাল বেজে একজন পাঞ্জাবি ইমাম সেখানে আটক বাঙালিদের খাবার সরবরাহ করতেন। ৯ দিন নির্যাতন ভোগ করার পর ১৯ জুলাই খালিশপুর নেভাল বেজ থেকে কর্নেল গুলজারের সহযোগিতায় তিনি মুক্তি পান। সেই সাথে তাকে পরামর্শ দেওয়া হয় বিহারিদের এড়িয়ে চলবে। মুক্তি পেয়ে তিনি বোনের বাসায় চলে আসেন। তারপর তার পরিবার পরিজনদের সাথে সাক্ষাৎ হয়। ১৯৯৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর কাজী খালেক ইন্তেকাল করেন।
(তথ্য সূত্র : তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র ৮ম খণ্ড ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিকে দেয়া ১৯৭৩ সালের ১১ জুলাই কাজী খালেকের সাক্ষাৎকার।)
খুলনা গেজেট/এনএম

