মঙ্গলবার । ২রা ডিসেম্বর, ২০২৫ । ১৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২
বিজয়ের স্মৃতিকথা

মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা খুলনা বেতার

কাজী মোতাহার রহমান

ময়ূর নদের পশ্চিম পাড়ে খুলনা বেতারের যাত্রা। ৫৪ বছর আগে নাম ছিল রেডিয়ো পাকিস্তান, খুলনা। ১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর এ বেতার কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয়।

অসহযোগ আন্দোলন : পহেলা মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলনের আগ থেকে রেডিয়ো সেন্টারে পাঞ্জাবি সৈন্য মোতায়েন করা হয়। একাত্তরের মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে অবস্থানে নেয় এ বেতার কেন্দ্র।

৭ মার্চের ভাষণ : ৮ মার্চ দুপুরে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট ও খুলনা কেন্দ্র থেকে একযোগে প্রচারিত হলো। এরপর পঁচিশ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন ৬টি বেতার কেন্দ্র থেকে ভাষণ সম্পূর্ণ অথবা নির্বাচিত অংশ প্রচার করা হয়।

সে সময়কার অনুষ্ঠান প্রযোজক (পরবর্তীতে আঞ্চলিক পরিচালক) সামছুর আলী বিশ্বাস স্থানীয় দৈনিক সময়ের খবরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে (৮ মার্চ, ২০১৪) উল্লেখ করেন, অনুষ্ঠান প্রযোজক আব্দুস সাত্তার শেখ ও ওয়ালিউর রহমান ভাষণটি খুলনা কেন্দ্র থেকে প্রচারে সাহসী ভূমিকা পালন করেন। ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের পথে অনুষ্ঠানটি প্রচার হয়।

পঁচিশে মার্চ : বেতারের কর্মকর্তা কাজী মাহমুদুর রহমান রচিত বেতার কথা নামক গ্রন্থ উল্লেখ করেন, ‘২৫ মার্চ বিকেলের অনুষ্ঠান শেষে কর্মকর্তারা বেতার ভবন ত্যাগ করেন। রাতে গণহত্যা, গুলিবর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের কারণে শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শহরের রাস্তাঘাট শূন্য হয়ে যায়। ২৬ মার্চ সকাল থেকে বেতারের সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়।’

রেডিয়ো সেন্টার দখলের যুদ্ধ : ৪ এপ্রিল রাতে বেতার কেন্দ্র দখলের সিদ্ধান্ত হয়। যুদ্ধের অধিনায়ক নির্বাচন করা সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার মেজর জয়নুল আবেদীনকে। যুদ্ধের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন বিপ্লবী পরিষদের চেয়ারম্যান। রাত আনুমানিক ৯টা নাগাদ মুক্তিযোদ্ধাদের এই দলটি গল্লামারী রেডিয়ো স্টেশনের উদ্দেশ্যে নৈহাটী ত্যাগ করেন। যুদ্ধের অধিনায়ক জয়নুল আবেদীন অনুধালুপ্ত নিরালা বাজারের বিপরীতে সিটি কলেজ হোস্টেলের কাছে তার দলবল নিয়ে অবস্থান করেন। যেন শহর থেকে পাক বাহিনী গল্লামারী রেডিয়ো সেন্টারের দিকে না আসতে পারে। পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য যুদ্ধের অধিনায়ক সিটি কলেজ হোস্টেলের কাছে অবস্থান নেয়। শেখ কামারুজ্জামান টুকু ও নায়েক সিদ্দিক রেডিয়ো সেন্টারের দক্ষিণ দিকে অবস্থান নেয়। রেডিয়ো স্টেশনে অবস্থানরত পাক বাহিনী পাল্টা গুলি ছোড়ে। রাতের নীরবতা কেটে যায়। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে পশ্চিম বানিয়াখামার, গল্লামারী ও হাজীবাড়ি এলাকার অধিবাসীরা। পাকিস্তান বাহিনীর অবস্থান ছিল রেডিও ভবনের পশ্চিমপাশে একটি টিনশেডে, উত্তর পাশে ও প্রধান ফটকের পাশে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ না থাকায় তাদের সামনে এগোতে অসুবিধা হচ্ছিল। গল্লামারী রেডিয়ো স্টেশন এলাকায় যুদ্ধ হচ্ছে এখানের যুদ্ধে মোসলেম নামক এক আনসার সদস্য শহীদ হয়। যুদ্ধের অধিনায়ক সুবেদার মেজর জয়নুল আবেদীন সিটি কলেজ ছাত্রাবাসে পূর্বদিকে একতলা ভবনে অবস্থান করছিল। পাকিস্তানি সেনাদের কয়েকটি ট্রাক শের-এ-বাংলা রোড দিয়ে রেডিয়ো স্টেশনের দিকে যাত্রা করলে যুদ্ধের অধিনায়ক ট্রাকের চাকায় গুলি করে গতি থামিয়ে দেয়। পাকিস্তানি সেনারা গাড়ি থেকে নেমে ট্রাক ঠেলে সামনে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলে অধিনায়কের রাইফেল গর্জে ওঠে। ঘটনাস্থলেই দশ বারোজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। প্রতিপক্ষের গুলি এসে বিদ্ধ হয় অধিনায়ক জয়নুল আবেদীনের শরীরে। তিনি ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান।

নির্যাতন সেল : সাংবাদিক ও গবেষক গৌরাঙ্গ নন্দী বৃহত্তর খুলনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে উল্লেখ করেছেন বেতার ভবনের দোচালা ঘরটিতে দেশ স্বাধীনের পর অনেকেই নির্যাতিতদের রক্তমাখা জামা কাপড় দেখতে পেয়েছেন। রক্ত দিয়ে একজন নির্যাতিত দেওয়ালের লেখে মা তোমার সাথে আমার আর দেখা হবে না। ভবনের আশেপাশে পাকিস্তানি বাহিনীরা ট্রাকে করে লাশ এনে গল্লামারী বিলে ও ময়ূর নদে ফেলে দিত।

গল্লামারী বধ্যভূমির বর্ণনা দিতে গিয়ে বিভিন্ন লেখক উল্লেখ করেছেন, যুদ্ধকালীন সময় কোনো সুস্থ মানুষ প্রাণের ভয়ে গল্লাামারী এলাকায় আসতে চাইত না। এখানে সচরাচর লাশ পাওয়া যেত ধান খেতে, পাট খেতে ও ময়ূর নদীর পাড়ে। স্বাধীনতার পর এখানে নরকঙ্কালের স্তূপ পাওয়া গেছে। গল্লামারী এলাকায় শান্তিলতা সাহা নামে এক নারীকে হত্যা করা হয়। লেখক মীর আমীর আলী গল্লামারী বধ্যভূমিকে কসাইখানা বলে উল্লেখ করেছেন। রেডিয়ো সেন্টারে অব¯ানরত পাকিস্তানি সেনারা আতঙ্কগ্রস্ত থাকত। সন্ধ্যার পর মুক্তিবাহিনী কখন চোরাগোপ্তা হামলা চালায়। গল্লাামারী ব্রিজটি উড়িয়ে দেয়, এ নিয়ে প্রায় তারা চিন্তিত থাকত।

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে সেনাছাউনি ছেড়ে পাঞ্জাবিরা বাইরে সাধারণত বের হতো না। বিমান হামলার পর সার্কিট হাউজ সদর দপ্তর ছেড়ে নিরাপত্তার জন্য স্থানীয় অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান নিউজপ্রিন্ট মিলস্-এর রেস্ট হাউজে আশ্রয় নেয়। এদিকে ১৪ ডিসেম্বর মেজর জয়নাল আবেদীন (স্বাধীনতা পরবর্তী ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার) বেতার কেন্দ্র দখলের জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। পরবর্তীতে তারা পিছিয়ে যায়। ১৬ ডিসেম্বর রাতে আর একদফা হামলা করে। এই যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনী পরাজিত হয়। রাতভর যুদ্ধে সারা শহর কাঁপতে থাকে।

রেডিয়ো পাকিস্তান, খুলনা কেন্দ্রেই গড়ে উঠেছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। একাত্তরের নির্মম নির্যাতনের সাক্ষী এই স্থানটি।

রেডিয়ো পাকিস্তান খুলনা কেন্দ্রের মৃত্যু : রেডিয়ো পাকিস্তান খুলনা কেন্দ্রের মৃত্যু হয় ১৭ ডিসেম্বর ভোরে। পরাজয়ের গ্লানি সহ্য করতে না পেরে পাকিস্তানি বাহিনী বেতার কেন্দ্রের ১০ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রান্সমিটার ডিনামাইট দিয়ে ধ্বংস করে দেয়। স্টুডিয়ো ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নষ্ট করে ফেলে। এ বেতার ভবন ক্যাম্পের পাকিস্তানি সেনারা গুলি করতে করতে সার্কিট হাউজের দিকে এগোতে থাকে। ১৭ ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশ বেতার খুলনা নামকরণ হয়। কিন্তু ট্রান্সমিটার ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় এ বেতার কেন্দ্রের সম্প্রচার শুরু করা সম্ভব হয়নি।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন