সোমবার । ১লা ডিসেম্বর, ২০২৫ । ১৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২

তারেক রহমানের দেশে ফেরা : ভূ-রাজনীতি ও অদৃশ্য শক্তির লম্বা ছায়া

নিয়াজ মাহমুদ

অদৃশ্য শক্তির লম্বা ছায়া। লাইফ সাপোর্টে মা— দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। দেশের বাইরে ছেলে— তারেক রহমান। দুই প্রান্তে দুই তীব্র বাস্তবতা। এক প্রান্তে নিঃশ্বাসের ছন্দ কমে আসা একজন মায়ের কান্না, অন্য প্রান্তে এমন এক রাজনৈতিক সমীকরণ, যেখানে একটা সিদ্ধান্তও সহজ নয়।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একটি বাক্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আগুন ছড়িয়েছে, “দেশে ফেরার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ অবারিত ও একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়।”
এই এক বাক্যই যথেষ্ট ছিল। জনমনে প্রশ্নের পাহাড়, তারেক রহমান কি নিজের সিদ্ধান্তের মালিক নন?

যাদের কথা তিনি ইঙ্গিত করলেন, তারা কারা? মায়ের পাশে দাঁড়াতে চাইলেও কি কেউ বা কিছু তাকে থামিয়ে রেখেছে? এমন প্রশ্ন শুধু জনতার নয়, রাজনৈতিক অঙ্গনের স্তরেও তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

তারেক রহমানের পোস্টের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সরকারের প্রতিক্রিয়া আসে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, “তারেক রহমানের দেশে ফেরায় কোনো সরকারি নিষেধাজ্ঞা নেই।”

কথা শেষ হতে না হতেই রোববার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন আরও নির্দিষ্টভাবে ঘোষণা করলেন, “তিনি চাইলে একদিনে ট্রাভেল পাস দেওয়া যাবে।” আইনগত বাধা নেই। রাষ্ট্রগত আপত্তি নেই, দরজা নাকি পুরোপুরি খোলা। সবকিছু এত সহজ হলে— তাহলে তারেক রহমান কেন দেশে ফিরছেন না? এ প্রশ্নে দেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে যেন নতুন এক খাদের সৃষ্টি হয়েছে।

পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে কয়েকদিন আগের সজীব ওয়াজেদ জয়ের বক্তব্য।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “বাংলাদেশের দুটি বড় দলের নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার জন্য বিদেশ থেকে একটা অগণতান্ত্রিক খেলা চলছে।” দুটি দল—আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এই মন্তব্যের পর বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন— এই ‘খেলা’ কি তারেক রহমানের দেশে না ফেরার সঙ্গে সম্পর্কিত? কেউ কি বিদেশে বসে চায় না তিনি দেশে ফিরুন? নেতৃত্ব পরিবর্তনের চাপ কি বিএনপির উপরই বেশি?

জয়ের বক্তব্য বিষয়টিকে কেবল রাজনৈতিক নয়, আন্তর্জাতিক সমীকরণের সঙ্গেও যুক্ত করেছে। আর এই আন্তর্জাতিক সমীকরণই তারেকের সিদ্ধান্তে বড় বাধা কিনা— সেই প্রশ্ন আজ গুঞ্জনের থেকেও বেশি।

যেখানে সরকারের পক্ষ থেকে “বাধা নেই” ঘোষণা আসছে, সেখানে বিএনপি একেবারে নীরব। দলের শীর্ষ নেতারা কেউই মন্তব্য করতে চান না— এমনকি সাংবাদিকদের প্রশ্নও এড়িয়ে যাচ্ছেন। এই নীরবতা কি শুধুই সতর্কতা? নাকি দলের ভেতরেই এমন কিছু শক্তি আছে, যারা চায় না তারেক রহমান এখন ফিরে আসুক? যে কারণই হোক, বিএনপির এই নীরবতা প্রশ্নকে আরও ঘন করে তুলছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে “অদৃশ্য শক্তি” শব্দগুচ্ছটি যেন এক ধরনের সাংকেতিক ভাষা। কখনো এটি ক্ষমতার নেপথ্য রূপ, কখনো আন্তর্জাতিক পক্ষের চাপ, আবার কখনো অভ্যন্তরীণ, নিরাপত্তাবিষয়ক গোপন কারসাজি। তারেক রহমান যখন বলেন—“সিদ্ধান্ত এককভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই” তখন এই অদৃশ্য শক্তি কি তারই ইঙ্গিত?

অনেকেই বলছেন— তারেক যদি দেশে ফেরেন, তাহলে তাকে আবার মামলা ও গ্রেপ্তারের ঝুঁকি নিতে হবে। আর এই ঝুঁকির দায় কোনো পক্ষই নিতে চায় না।

আবার অন্য পক্ষ বলছে— তারেককে দেশে ফিরতে না দেওয়া একটি সুপরিকল্পিত বৈশ্বিক কূটনৈতিক স্ক্রিপ্ট— যেখানে আন্তর্জাতিক পক্ষ, সরকার এবং বিএনপি সবাই কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে আছে। এ সত্যিই কি তাই? কেউ স্বীকার করবে না, কিন্তু বাতাসে গন্ধ রয়ে গেছে।

সমালোচকেরা সবচেয়ে বেশি আঘাত করছেন তারেকের মানবিক দিককে। তারা বলছেন—“মা মৃত্যুপথযাত্রী, আর ছেলে বিদেশে! এটি কি গ্রহণযোগ্য?” তারা আরও অভিযোগ করছেন—“মায়ের প্রতি নয়, তারেকের বেশি দরদ মাসীদের প্রতি— অর্থাৎ যে-সব শক্তি তাকে ফিরে আসতে বাধা দিচ্ছে।” কিন্তু রাজনীতির বাস্তবতা সবসময়ই নিষ্ঠুর এবং বহুস্তরীয়। মায়ের পাশে দাঁড়ানো সহজ, কিন্তু সেই দাঁড়ানো যদি রাজনৈতিকভাবে তাকে মাটিতে নামিয়ে দেয়—তবে কি সেই সিদ্ধান্তও মায়েরই কাম্য?
তারেকের সমর্থকেরা তাই যুক্তি দেন—ঝুঁকি নিয়ে দেশে ফিরে যদি তিনি পুনরায় বন্দি হন, তবে কি তিনি মায়ের জন্যই আরও বড় কষ্ট ডেকে আনবেন না? মানবিকতার বিপরীতে রাজনৈতিক নিরাপত্তা—এ দুইয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে তারেক যে গভীর সংকটে আছেন, তা অস্বীকার করা যায় না।

আজ বাংলাদেশ এমন এক রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে—যেখানে শুধু একটি ব্যক্তির সিদ্ধান্তই বহুস্তরীয় প্রভাব ফেলতে পারে। তারেক রহমান দেশে ফিরবেন কি ফিরবেন না—এ সিদ্ধান্ত আর শুধুই ব্যক্তিগত নয়। এটি রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, নিরাপত্তাবিষয়ক এবং ক্ষমতার ভবিষ্যৎ সমীকরণের অংশ।

কিন্তু সংকটের কেন্দ্রে রয়েছে এক মানবিক দৃশ্য—একজন মৃত্যুপথযাত্রী মা ছেলের মুখ দেখতে চান। আর সেই ছেলের—ফেরার পথ কি খোলা, নাকি পথের দু’ধারে অদৃশ্য শক্তির নিষিদ্ধ সাইনবোর্ড? রাজনীতি যতই নির্মম হোক, দিনশেষে একটাই প্রশ্ন বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে— তারেক রহমান কি মায়ের ডাক পেরিয়ে অদৃশ্য শক্তির দেয়াল ভেঙে দেশে ফিরবেন, নাকি এই দেওয়ালই তার সিদ্ধান্তকে নিঃশব্দে আটকে রাখবে?

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট, email:  niazjournalist@gmail.com

খুলনা গেজেট/এএজে




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন