সোমবার । ১লা ডিসেম্বর, ২০২৫ । ১৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২

নগরে আগুন লাগলে কি দেবালয় এড়ায়?

আবদুল কাদের খান

আমার প্রিয় মহানগর খুলনা। খুলনা মহানগরীর শারীরিক অবস্থা মোটেও ভালো নাই। খবরের কাগজের পাতা খুললেই কিলবিল করে অসুস্থতার খবর। নিয়ন্ত্রণহীন মহানগরী খুলনা এখন আতঙ্কের মহানগরী। গেল ২৬ নভেম্বর, ২০২৫ বুধবার প্রকাশিত খুলনা গেজেট এর খবর, ‘খুলনায় এইডস আক্রান্ত ৯০ শতাংশের অন্তর্নিহিত কারণ অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক’।

হাসপাতাল ক্লিনিকগুলোতে চিকিৎসায় অব্যবস্থা নৈরাজ্য যখন নৈমিত্তিক ঘটনা, ঠিক তখন ভয়ংকর এ খবর দেশের এ অঞ্চলের মানুষের জন্য যথেষ্ট আতঙ্কের।

নষ্ট রক্ত, নষ্ট যৌন সম্পর্ক এইডস এর কারণ আমরা এই প্রথম শুনলাম- তা নয়, এই মরণব্যাধি আমাদের অনিয়ন্ত্রিত সমাজ থেকে বিস্তার লাভ করছে। এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নগরীর বস্তি এলাকার ভাসমান পতিতা এবং আবাসিক হোটেলে অবৈধ যৌন কর্মকা-ে অবৈধ মিলন থেকে এই ঘাতক ব্যাধিটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।

নগরীতে এইচআইভি এইডস আক্রান্তের পেছনের কারণ ৯০ শতাংশ অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক হলেও বাকি ১০% আক্রান্ত হচ্ছে স্ক্যানিং বিহীন রক্ত থেকে অর্থাৎ অপরিশোধিত রক্ত থেকে। অপরিশোধিত রক্ত রোগীর দেহে প্রবেশের পর তারাও ঝুঁকিতে পড়ছে! যারা আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের কোনো শ্রেণিবিভাগ নেই। সে হোক প্রসূতি, হোক ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তি, হোক নবজাতক শিশু প্রত্যেকেই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। নগরীতে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার সুযোগে গড়ে উঠা অনুমোদনবিহীন ক্লিনিক এই রোগ বিস্তারে নিবৃত ভূমিকা পালন করছে। সরকারি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন বিহীন সব ক্লিনিকে অধিকাংশ রক্ত পরিশোধিত না করে অর্থাৎ স্ক্যানিং ছাড়াই রক্ত লেনদেন করে। যারা ক্রয় করেন তারা জানেন না কি বড় জীবন ঘাঁতি জীবাণু তারা বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন। এখান থেকেই ঝুঁকি বাড়ছে দিনকে দিন।

প্রথমে বলতে হবে অনুমোদনবিহীন ক্লিনিক-এর কথা। এখানে গাঁজা, হেরোইন, চরোস, ফেন্সিডিল, মারিজুয়ানা খোর অধিকাংশ দুই নম্বর মানুষ বা নষ্ট তরুণ জরুরি নেশার অর্থের প্রয়োজনে নিয়মিত হাজির হয়। রক্ত দেয়। এর সাথে রয়েছে ঠেলা গাড়ি শ্রমিক, রিকশাওয়ালা, নানা ধরনের বোহিমিয়ান তরুণ। জরুরি অর্থের প্রয়োজনে এরাই এসব ২ নম্বরি ক্লিনিক এর শরণাপন্ন হয় এবং সস্তা দামে রক্ত বিক্রি করে।

ক্লিনিকগুলো নামমাত্র মূল্যে রক্ত কিনে ফ্রিজ জাত করে, যেনতেনো প্রকারে তথাকথিত ব্লাড ব্যাংকে জমা রাখে। রক্তদানকারী কোনো জটিল রোগে আক্রান্ত কিনা, তাও পরীক্ষা নিরীক্ষা না করেই পাইকারি হারে রক্ত গ্রহণ করা হয়। কী পরিহাস!

এরপর কোথাও অপারেশন কাজে জরুরি রক্তের প্রয়োজন হলে নামিদামি ট্রেডমার্ক ক্লিনিক গুলোতে রক্ত না পেয়ে গ্রাহকরা কানা গলিতে অনুমোদনবিহীন ক্লিনিক এর শরণাপন্ন হয়ে এ ধরনের বিপত্তি ডেকে আনেন। দোষ দোষ ভূক্তভোগী রোগীর অভিভাবকের নয়, দোষ অনুমোদনবিহীন ক্লিনিক-এর স্ক্যানিং না হওয়া ভেজাল রক্তের। কিন্তু এসব নির্বিবাদে স্বাস্থ্য বিভাগ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার চোখের সামনে ঘটছে, কিন্তু বলার কেউ নেই। এভাবেই রোগ কাতর মুমূর্ষু নারী পুরুষ, শিশু আবাল বৃদ্ধ বনিতা অদৃশ্য হাতের কারসজিতে এইডস এর মতো ঘাতক ব্যাধিতে নিঃশব্দে আক্রান্ত হচ্ছে। বছরের পর বছর এভাবে সরল নিরীহ মানুষ ক্লিনিক নামধারীদের চোরা ফাঁদে আটকে যাচ্ছে।

এবার দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাই। নগরীর অভাবী বস্তি এলাকার ভাসমান পতিতাদের কথা। এর সাথে সংযুক্ত রয়েছে গ্রাম এলাকা থেকে কাজের সন্ধানে নগরীতে আসা একশ্রেণীর ভাসমান পরিবার। তাদের অভাবী সংসারে যুবতী কন্যারা দু’ মুঠো আহারের জন্য অর্থ কষ্ট থেকে বেঁচে থাকার জন্য নগরীর হোটেল গুলোতে সুলভ যৌন পণ্য হিসেবে নিজেদের গতর বিক্রি করে। প্রতিদিন নষ্ট পুরুষের সাথে এইসব অসহায় সদ্য যুবতী নারীদের শারীরিক মিলনের ফলে সৃষ্টি হচ্ছে জটিলতা। এখানেই বহুগামী যুবক খদ্দেরের কাছে দেহ মিলনের ফলে এইডস আক্রান্ত হচ্ছে নারী পুরুষ উভয়েই।

খুলনা গেজেট এর অপরাধ বিষয়ক প্রতিবেদক এর ভাষ্য থেকে জানা যায়, নগরীর হোটেল গুলোতে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার উদাসীনতার সুযোগে যে অবৈধ মিলন ঘটে তাদের অধিকাংশই তরুণ। ভাসমান পতিতাদের সাথে শারীরিক সংযোগের ফলে তারা উভয়েই আক্রান্ত হচ্ছে। কারণ আলালের ঘরের দুলাল এই নষ্ট তরুণরা নানাভাবে বহুগামী। তারাই বহন করে এইডস এর জীবাণু। আবার অর্থের জন্য নিত্য রাতে দেহ পসারিনি, যে অভাবী যুবতীরা শরীর বেঁচে এরাও বহুগামী। বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন পেশার ব্যাধি আক্রান্তদের সাথে শরীরী মিলনের মাধ্যমে এই ঘাতক ব্যাধিটা ছড়াচ্ছে। যারা এই ঘাতক ব্যাধি এইডসে আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের অধিকাংশেরই বয়স ২৫ থেকে ৪০ এর কোঠায়, এরাই আক্রান্তের অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে। কথায় বলে, ‘নগরে আগুন লাগলে কি দেবালয় এড়ায়?’ এখন পুরো নগরীতে নষ্ট যুব তারুণ্য এইডস এর জালে বন্দি। নিশ্চয়ই আতঙ্কের খবর তাই না?

স্পট গুলো সম্পর্কে কিছু বলা দরকার। মহানগরী খুলনার নতুন বাজার, জেলা স্টেডিয়াম মার্কেট, নগরের হৃৎপিণ্ড সিটি কর্পোরেশন লাগোয়া শহীদ হাদিস পার্ক এলাকা, শিববাড়ি মোড়, গল্লামারি কাঁচাবাজার সংলগ্ন আশপাশ এলাকা, এবং জিরো পয়েন্ট সংলগ্ন কৃষ্ণনগর এলাকা যা এখন মোহাম্মদ নগর নামে পরিচিত, ওখানে তাদের বিভিন্ন খদ্দেরদের সাথে আড়ালে আবডালে কথোপকথন করতে দেখা যায়।

অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের ভাষ্যে বলা হয়েছে, এই ভ্রাম্যমাণ ভাসমান পতিতাদের সাথে যোগাযোগের ব্যাপারে এক শ্রেণির নারী লিপ্সু লম্পট দালাল তাদের ব্যাবসা হিসেবে এই ঘৃণ্য কাজ বেছে নিয়েছে। তারাই খদ্দের খুঁজে পতিতাদের জম জমাট ব্যবসায় নেপথ্য ভূমিকা পালন করে। পুলিশি অভিযান বা গোয়েন্দা নজরদারির অভাবে এ ধরনের ঘটনা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন।

নগরীর এক শ্রেণির কন্টাক্ট আবাসিক হোটেল এবং নগরীর অদূরে বটিয়াঘাটা রিসোর্ট সেন্টারে এইসব নষ্ট তরুণরা প্রায়ই বোহিমিয়ান যুবতী নারীদের সাথে শরীরী সংযোগ করে বলে অভিযোগ রয়েছে। নগরীর আবাসিক হোটেলে স্কুল-কলেজগামী তরুণ তরুণীরা অভিভাবকের চোখ ফাঁকি দিয়ে দিনের পর দিন নিরিবিলি সময় কাটানোর কাহিনী এখন এক ওপেন সিক্রেট। রূপসাগামী পীর খান জাহান আলী সেতুর আশপাশের খুপরি ঘর ও বস্তিতে আশ্রয় ¯ল করে, ওরা এসব অনৈতিক কাজ দিনের পর দিন চালিয়ে যাচ্ছে। প্রশাসন সম্পূর্ণ নীরব!

এবার আসি মহানগরীর জেনারেল হাসপাতালে। হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংক সূত্র তথ্য দিয়ে নিশ্চিত করেছে যে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মোট নয়জনের শরীরে এই এইচআইভি শনাক্ত করা হয়। তার মধ্যে আটজনই পুরুষ। বয়স ২৫ থেকে ৪০ এর মধ্যে। তারা এ স্বাস্থ্য কেন্দ্র কর্তৃপক্ষকে অকপটে বলেছে যে, অনিরাপদ যৌন মিলন থেকে তারা এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছে। ওই সূত্রের দাবি, সিফিলিস, গনেরিয়া থেকে যৌন ব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু খুলনা জেনারেল হাসপাতালে প্রতি বছর কমপক্ষে সাতজনের শরীরে এ জীবাণু পাওয়া যায়।

চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের অভিমত এই সংক্রান্তদের জীবাণু হোয়াইট ব্লাড সেলে আশ্রয় নিয়ে রোগীকে তিন সপ্তাহ থেকে পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে কাবু করে ফেলে। পরে জ্বর জ্বর ভাব, ডায়রিয়ার মতো মলত্যাগ, খাবারে অরুচি, শরীরে অসাচ্ছন্দ্য দেখা দেয়। আস্তে আস্তে শুকিয়ে যায়, রক্তশূন্য হয়ে যায়। এইডস আক্রান্ত রোগী রক্তশূন্য হয়ে আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে এ রোগে আক্রান্ত হলে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। এক কথায় চিকিৎসা ব্যাপারটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়ায়। রোগ নিরাময়ের সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ থাকে। যদিও সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে দিদা বললে চিকিৎসা উপকরণ সরবরাহ করা হয়, তবুও তা দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার মাধ্যমে কিছুটা নিরাময় হয়।

দুঃখজনক অপ্রিয় সত্য কথা এই যে, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কিংবা জেনারেল হাসপাতালে এ ধরনের চিকিৎসা সেবা থাকলেও খুলনা মহানগরীর গা ঘেঁষা খুলনা জেলার অন্যান্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বা কমিউনিটি ক্লিনিকে এসব সুবিধা একেবারেই নেই বললে চলে। বেসরকারি স্বাস্থ্য এসব রোগের চিকিৎসা উপকরণ ক্রয়সহ চিকিৎসা ব্যয় বহুল হওয়ায় অনেক আক্রান্ত ব্যক্তিরা অর্থ অভাবে চিকিৎসা বিমুখ থাকছে। ধুকে ধুকে মৃত্যুর দিন গুনছে।

খুলনা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ রফিকুল ইসলাম গাজী আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন, আক্রান্তের অধিকাংশই তরুণ এবং বয়স ২৫ থেকে ৪০ এর মধ্যে। এ জেলায় এইচআইভি জীবন পাওয়ার পেছনে কারণ হচ্ছে অনিরাপদ যৌন মিলন। ক্ষেত্র বিশেষে রক্তদাতা শরীরে এ জীবাণু বহন করে যা পরিশোধিত বা স্ক্যানীং না করে রোগীর দেহে প্রয়োগের ফলে সুস্থ রোগীর শরীরেও এই জীবনের সংক্রমিত হচ্ছে। পরিবারের সবই আক্রান্ত হলে যৌন মিলনের মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবে স্ত্রী ও আক্রান্ত হচ্ছে। আবার রোগী অবস্থায় শরীরের রক্ত গ্রহণের প্রয়োজনে অপরিশোধিত রক্ত থেকে রোগ বিস্তার হচ্ছে। এইচআইভি সংক্রমিত গর্ভবতী মায়ের গর্ভের সন্তান ও জন্ম থেকে এ জীবাণু ও বহন করে।

ঘটনা যেখানেই শেষ নয় পাঁচ সাত বছর আগে ভারতে রোগটি ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করে। সীমান্তের পাড়ে আমরা যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিলাম। কিন্তু এখন তা আমাদের তরুণদের সহজেই আক্রান্ত করেছে। এখনই আমাদের আইন-শৃখলা তদারককারী সংস্থা ও স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ সচেতন না হলে এই জীবাণুঘটিত ব্যাধি দুই দশ বছর পর বৈবাহিক সূত্রে, ক্লিনিক সূত্রে, অবৈধ শারীরিক মিলন সূত্রে হোক, বিস্তার লাভ করলে, নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তাই সময় থাকতে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই। ‘সাধু সাবধান!’

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন