সোমবার । ১লা ডিসেম্বর, ২০২৫ । ১৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২
বিজয়ের স্মৃতিকথা

গণমাধ্যমে খুলনার রণাঙ্গন

কাজী মোতাহার রহমান

পূর্ব পাকিস্তানের ২৪ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৭১ সাল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মহান মুক্তিযুদ্ধের বছর। বাঙালি জাতির গর্বের বছর, জাতির অংহকারের।

একাত্তরের মার্চ থেকে খুলনার গণমাধ্যম সাহসী ভূমিকা পালন করে। যুদ্ধের প্রাক্কালের পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ ১১০ নং সামরিক বিধি জারি করে। সামরিক বিধিতে বলা হয় পাকিস্তানের অখ-তা, সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো ছবি, খবর, অভিমত, বিবৃতি, মন্তব্য প্রভৃতি মুদ্রণ বা সংবাদপত্রসমূহকে প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। এ আদেশ লঘন করা হলে সর্বোচ্চ শাস্তি দশ বছর সশ্রম কারাদ-। ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ১ মার্চ – ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সংবাদপত্রগুলো নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকার দুটি সামরিক বিধি জারি করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সংবাদপত্রে সত্যের মৃত্যু ঘটে। ২৬ মার্চ পাক প্রেসিডেন্ট ৭৭ নং সামরিক বিধি জারি করে।

এ বিধিতে উল্লেখ ছিল, পাকিস্তানের অখ-তা বা সংহতির বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমালোচক বা সমালোচনার চেষ্টা, জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়, কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র প্রতি অশ্রদ্ধা, অবমাননার চেষ্টা এবং কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্রের না দিয়ে রাজনৈতিক বিষয় সংবাদপত্রের সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। ৭৭ নং সামরিক বিধির কার্যকারিতার ওপর দৃষ্টি রাখার জন্য ঢাকায় স্থাপন করা হয় সেন্সারশীপ হাউস। জে. ইয়াহিয়া খানের বিধি উপেক্ষা করে খুলনার কয়েকটি সাপ্তাহিক পত্রিকা অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেয়। বিশেষ করে, লুৎফর রহমান জাহাঙ্গীরের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক দেশের ডাক পত্রিকায় ২০ মার্চ পূর্ণ পৃষ্ঠায় বাংলাদেশের পতাকার রঙিন ছবি ছাপা হয়। এটাই ছিল দেশের ডাকের শেষ সংখ্যা। দেশের ডাকের এই সংখ্যা দ্রুত বিক্রি হয়ে যায়। ২৬ মার্চ পাকিস্তান বাহিনী এ পত্রিকার নটরাজ প্রেস আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। স্বাধীনতার পর দেশের ডাক পত্রিকা আর প্রকাশিত হয়নি। খুলনা শহরের ধর্মসভা এলাকা থেকে মাহমুদ আলম খানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক স্বাধিকার। সম্পাদক ন্যাপ (ভাসানী) এর রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।

বিদেশি সাংবাদিক : পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসা বিদেশি সাংবাদিকদের মধ্যে ছিলেন দিল্লি থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দি স্টেটসম্যান-এর মারি শাইল (গৌরাঙ্গ নন্দী রচিত বৃহত্তর খুলনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস)। তিনি তখন দক্ষিণাঞ্চলের বড় শহর খুলনায় আসেন। তার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল, খুলনায় কতজনকে হত্যা করা হয়েছে তা আমি জানি না, তবে একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, একদিন দশ মিনিটে তিনি নদী দিয়ে ৪৮টি লাশ ভেসে যেতে দেখেছেন।

সাংবাদিক মারি সাইলকে খুলনা সদর দপ্তরে কর্মরত লে: কর্নেল শামস জানান বাঙালিরা ভীতু, যুদ্ধ করতে জানে না। তিন মাসে পাক বাহিনী খুলনা শহর মুক্ত করেছেন।

‘মোংলা বন্দরে ৬টি জাহাজ ডুবি’ শিরোনামে ১৯৭১ সালের ১ সেপ্টেম্বর সাপ্তাহিক বাংলাদেশ নামের পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৪ আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা খুলনা জেলার মোংলা বন্দরে গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে ছয়টি জাহাজ ডুবিয়েছে, দুটি আটক করেছে।

‘ব্রিটিশ জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত’ শিরোনামে ১৪ নভেম্বর বিপ্লবী বাংলাদেশ নামক পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের গেরিলারা চালনা বন্দরে একখানা ব্রিটিশ জাহাজের ওপর গুলিবর্ষণ করলে জাহাজটি চালনা ছেড়ে পালিয়ে কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছে বলে জানা গেছে।

‘ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের শিল্প উৎপাদন বাড়ানোর আহ্বান’ শিরোনামে বার্তা সংস্থা এপিপির বরাত দিয়ে ১৪ নভেম্বর দৈনিক পাকিস্তানে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয় মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খুলনা শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক সমাবেশে বক্তৃতা করেন।

দৈনিক বাংলায় ১৯৭২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় প্রতিনিধি মনিরুল হুদার পাঠানো প্রতিবেদন : খুলনায় পাকবাহিনীর নরধেমযজ্ঞ শিরোনামে ১৯৭২ সালে ১২ ফেব্রুয়ারি দৈনিক বাংলায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, খুলনা শহরের হেলিপোর্টে ও ফরেস্ট ঘাটে বাঙালিদের যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হতো, তা দেখে খুলনার তৎকালীন জেলা জজ হার্টফেল করে মারা যান। (তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল পত্র : অষ্টম খণ্ড)।

রাতের বেলায় জজ কোর্টের পেছনে ফরেস্ট ঘাটে বাঙালিদের এনে জবাই করে হত্যা করা হতো এবং দেহগুলোর পেট চিরে নদীতে ফেলা হতো। ঘাটটি আবার জেলা জজ সাহেবের বাসার ঠিক পেছনেই। রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে সেই সব মৃত্যুপথ যাত্রী বাঙালিদের কারুন আর্তনাদ জজ সাহেবের কানে পৌঁছাত। তিনি হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে এক রাতে মারা গেলেন। আরেকটি বধ্যভূমি ছিল গল্লামারী। খুলনা শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে মাত্র দেড় মাইল। হেলিপোর্ট ও ফরেস্টঘাট, কাস্টম্স ঘাট প্রভৃতি জায়গায় প্রথমে বাঙালিদের হত্যার জন্য বেছে নিলেও পরে বর্বর পাকবাহিনী গল্লামারীতে তাদের নৃশংসতার উপযুক্ত স্থান বলে বেছে নিয়েছিল।

দৈনিক বাংলা : খুলনা পাক বাহিনীর নরমেধযজ্ঞ শিরোনামে ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দৈনিক বাংলায় আরও একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, খুলনা শহরের কেন্দ্রস্থলে রেলষ্টেশন ও রেল লাইনের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছিল বাঙালি নিধনের আরেকটি ঘাঁটি। এপ্রিল-মে মাসে জল্লাদ সৈন্যরা খুলনা রেল স্টেশন এলাকাতে বহু বাঙালিকে হত্যা করেছে।

রেলস্টেশন ও স্টিমার ঘাটগুলির শক্ত সবল মুটে শ্রমিকরাই তাদের হাতে মারা গিয়েছিল সর্বাধিক। রেল কলোনি এলাকাতে প্রাধান্য ছিল পাক সেনাদের সহযোগী একদল অবাঙালিদের। ঐ সময়ে রেল কলোনি এলাকাতে দিনের বা রাতে যখনই কোনো বাঙালি গিয়েছে, সে আর ফেরেনি কোনো দিনও।

১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারি দৈনিক বাংলায় খুলনায় পাক বাহিনীর নরমেধযজ্ঞ শিরোনামে আরও একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রবীণ সাংবাদিক মনিরুল হুদা সে সময় এ পত্রিকার প্রতিনিধি ছিলেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘হামকো আদমি নেহি চাহিয়ে, শ্রেফ জমিন চাহিয়ে’- কথাগুলো বলতো খুলনাস্থ বর্বর পাকসেনারা। শুধু বলতোইনা, বাংলাদেশে গণহত্যার এটাই ছিল তাদের অনুসৃত নীতি। বাঙালি নিধন যজ্ঞে তাদের সহযোগিতা করতো একদল স্থানীয় অবাঙালি। তাদের বুলি ছিল ‘উও লোক (মিলিটারি) রহেগা আর হামলোক (অবাঙালি) রহেঙ্গে।’

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন