খুলনা মহানগরীর কোলাহল থেকে সামান্য পশ্চিমে, খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়ক লাগোয়া গল্লামারীর বধ্যভূমির পবিত্র মাটিকে বুকে ধারণ করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে দক্ষিণাঞ্চলের বাতিঘর খ্যাত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (খুবি)। ময়ূর নদের তীর ঘেঁষে প্রায় ১০৫ দশমিক ৭৫ একর সুবিশাল ক্যাম্পাসে যেন জ্ঞান, মুক্তি আর তারুণ্যের এক অবিরাম স্রোত। ‘শেখো, বাঁচো এবং নেতৃত্ব দাও’-এই স্লোগানকে বুকে ধারণ করে দেশের উচ্চশিক্ষায় একটি স্বাতন্ত্র্য ধারা সৃষ্টি করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
আজ ২৫ নভেম্বর, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই গৌরবময় পথচলার দিন। ১৯৯১ সালের এই দিনে মাত্র চারটি ডিসিপ্লিন এবং ৮০ জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যে শিক্ষাযাত্রার সূচনা হয়েছিল, আজ তা মহীরূহে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে ৮টি স্কুল এবং ১টি ইনস্টিটিউটের অধীনে ২৯টি ভিন্ন ভিন্ন ডিসিপ্লিনে প্রায় সাড়ে সাত হাজার শিক্ষার্থী জ্ঞান অর্জন করছে। সে সময়ে প্রথম প্রকল্প পরিচালক ও উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন প্রফেসর ড. মো গোলাম রহমান।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিতির এক অন্যতম দিক হলো-এটি বাংলাদেশের একমাত্র ছাত্র রাজনীতিমুক্ত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্র-বিষয়ক পরিচালকের দপ্তর কর্তৃক জারীকৃত কঠোর নীতিমালা অনুসারে এখানে ছাত্রদের রাজনৈতিক কর্মকা-সম্পৃূর্ণরূপে নিষিদ্ধ, যা নিশ্চিত করেছে এক নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ। শিক্ষার্থীদের কাছে এই প্রাঙ্গণ তাই কেবল পাঠ্যপুস্তকের কেন্দ্র নয়, এটি মুক্ত জ্ঞানচর্চা ও মানবিক বিকাশের এক অনন্য ক্ষেত্র।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রায়হান কবীর বলেন, “আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি না থাকায় এখানে কখনো রক্তপাতের ঘটনা ঘটেনি। আমাদের সেশনজট নেই। আমরা প্রতিটি ডিসিপ্লিন একসাথে ক্লাস পরীক্ষা শুরু করি। সবকিছু আমাদের একাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুসারে হয়। কিন্তু কিছু সমস্যা রয়েছে। আবাসিক হল সংকট রয়েছে। যার ফলে প্রায় আমাদের অনেক ছাত্রকে বাইরে থাকতে হয়, যা আমাদের জন্য কিছুটা নিরাপত্তাহীনতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।’’
বিশ্ববিদ্যালয়ের চেতনা তার স্থাপত্যে জীবন্ত। মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে ভিন্ন আঙ্গিকের শহীদ মিনার। আর মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ও আত্মত্যাগ স্মরণ করিয়ে দিতে ক্যাম্পাসে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ভাস্কর্য- অদম্য বাংলা, যার ভাস্কর ছিলেন গোপাল চন্দ্র পাল।
তবে, খুলনার এই ক্যাম্পাস কেবল সাফল্যের গল্পই নয়, এটি ধারণ করে আছে তার হারিয়ে যাওয়া সন্তানদের করুণ স্মৃতিও। কটকা প্রান্তরে মর্মান্তিকভাবে ডুবে যাওয়া ছাত্রদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে কটকা চত্বর। অন্যদিকে, শিক্ষার্থী হাদির অকাল প্রয়াণের স্মৃতি বহন করে হাদি চত্বর, যা প্রতিনিয়ত তাঁদের হারিয়ে যাওয়া সহপাঠীদের স্মরণ করিয়ে দেয়।
সর্বশেষ ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানে ১৮ জুলাই ঢাকায় শহিদ হন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ। তাঁর এই দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগকে অমর করে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের নামকরণ করা হয়েছে শহিদ মীর মুগ্ধ তোরণ।
শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক বিকাশে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় অত্যন্ত যত্নশীল। জ্ঞানপিপাসুদের জন্য রয়েছে সুবিশাল কাজী নজরুল ইসলাম কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার। এছাড়া গবেষণার দিগন্ত উন্মোচন করতে তৈরি হয়েছে অত্যাধুনিক কেন্দ্রীয় গবেষণাগার, যা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উচ্চতর গবেষণায় অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে। বর্তমানে তিনটি একাডেমিক ভবন, আবাসন সুবিধার জন্য ছাত্রদের তিনটি এবং ছাত্রীদের দুটি আবাসিক হল রয়েছে।

শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রাণবন্ত আড্ডা ও অবকাশের জন্য রয়েছে একটি নান্দনিক গোলপাতার ক্যাফে এবং ধর্মীয় বিশ্বাস পালনের জন্য রয়েছে সুবিশাল কেন্দ্রীয় মসজিদ ও একটি নান্দনিক কেন্দ্রীয় মন্দির। মুক্ত সংস্কৃতি চর্চার জন্য রয়েছে একটি মুক্ত মঞ্চ।
শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে নির্মাণাধীন রয়েছে টিচার্স স্টুডেন্ট সেন্টার (টিএসসি), যেখানে দক্ষিণবঙ্গের সবচেয়ে বড়ো মিলনায়তনের ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়া স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টার এবং শারীরিক চর্চার জন্য একটি জিমনেসিয়ামও নির্মিত হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য প্রফেসর ড. মো রেজাউল করিম জানান, “পাইকগাছা সরকারি কৃষি কলেজকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় নিয়ে নান্দনিক ক্যাম্পাস তৈরি, শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট নিরসনে নতুন আবাসিক হল নির্মাণের প্রস্তুতি এবং নতুন একাডেমিক ভবন উদ্বোধনের পর নতুন নতুন ডিসিপ্লিন খোলারও পরিকল্পনা রয়েছে। আমি চেষ্টা করছি যতদ্রুত সম্ভব আবাসন সংকট নিরসন করা যায়।”
তিনি আরও বলেন, “ভবিষ্যতে আমরা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়কে উদ্ভাবন, মানবিকতা, সৃজনশীলতা ও দায়িত্ববোধে পরিপূর্ণ এক জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রে পরিণত করতে চাই। পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে তরুণদের সৃষ্টিশীল মনন ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিই গড়ে তুলবে আগামী দিনের বাংলাদেশ, আর সেই যাত্রায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে পথপ্রদর্শকের ভূমিকায়।”
উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে ১৯৭৪ সালে ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে যাত্রা শুরু করা এই প্রতিষ্ঠানটি শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে জ্ঞান আর মুক্তি ছড়িয়ে দেওয়া এই বিশ্ববিদ্যালয় আজও দৃঢ় প্রত্যয়ে তার পথ চলছে। আগামী দিনেও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানচর্চা, গবেষণা ও মানবিক মূল্যবোধের বিকাশে দক্ষিণবঙ্গের নেতৃত্ব দেবে-এই প্রত্যাশাথসকলের।
কর্মসূচি : আজ ২৫ নভেম্বর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস যথাযথভাবে পালনের জন্য এ বছর বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ; সকাল ১০টায় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, বেলা ১১টায় লিয়াকত আলী মিলনায়তনে দিবসের মূল অনুষ্ঠান এবং গত বছরের কৃতিত্ব অর্জনকারী শিক্ষার্থী ও সংগঠনসমূহকে সম্মাননা প্রদান, পরে অদম্য বাংলা প্লাজায় বিভাগ/ডিসিপ্লিনসমূহের গত বছরের অর্জন ও আগামী বছরের পরিকল্পনা উপস্থাপনার ডিসপ্লে বোর্ডের মাধ্যমে স্থাপন, বাদ যোহর দোয়া, মন্দিরে প্রার্থনা আয়োজন এবং সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মুক্তমঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

