বাংলাদেশের বর্তমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে শিক্ষিত বেকারত্ব এক ভয়াবহ জাতীয় সমস্যায় রূপ নিয়েছে। প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলো থেকে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা শেষ করে বের হচ্ছে। তাদের চোখেমুখে থাকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন আর বুকভরা আশা। কিন্তু নির্মম বাস্তবতা হলো শিক্ষাজীবন শেষ করার পর তাদের একটি বিশাল অংশকেই বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে হতাশার সাগরে ভাসতে হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বিভিন্ন প্রতিবেদনে যে চিত্র উঠে এসেছে তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। দেশে অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত মানুষের মধ্যে বেকারত্বের হার যতটা না বেশি তার চেয়ে বহুগুণ বেশি বেকারত্ব দেখা যায় স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের মধ্যে। এটি এমন এক অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি করেছে যেখানে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করাটা যেন তরুণদের জন্য আশীর্বাদ না হয়ে বরং বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
এই সংকটের পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে আমাদের সনাতন শিক্ষাব্যবস্থাকে দায়ী করা হয়। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা এবং চাকরির বাজারের চাহিদার মধ্যে বিশাল এক ফারাক তৈরি হয়েছে। আমাদের পাঠ্যক্রম মূলত তাত্ত্বিক জ্ঞাননির্ভর। সেখানে মুখস্থবিদ্যার ওপর জোর দেওয়া হয়। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যাবহারিক দক্ষতা বা কারিগরি জ্ঞানের অভাব থেকে যায়। বর্তমান বিশ্ব চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যেখানে অটোমেশন ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। অথচ আমাদের দেশের গ্র্যাজুয়েটরা সেই তুলনায় আধুনিক প্রযুক্তিতে দক্ষ হয়ে উঠতে পারছে না। ফলে একদিকে নিয়োগকর্তারা তাদের পছন্দমতো দক্ষ কর্মী খুঁজে পাচ্ছেন না, আর অন্যদিকে হাজার হাজার শিক্ষিত তরুণ চাকরির অভাবে দ্বারে দ্বারে ঘুরছে।
এছাড়া আমাদের সামাজিক মনস্তত্ত্বে সরকারি চাকরির প্রতি অতিরিক্ত ঝোঁক বেকারত্ব বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। অধিকাংশ শিক্ষার্থীই বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে বিসিএস বা সরকারি চাকরির প্রস্তুতির পেছনে বছরের পর বছর সময় ব্যয় করে। এই দীর্ঘ সময়ে তারা অন্য কোনো দক্ষতা অর্জন করে না বা বেসরকারি খাতে ক্যারিয়ার গড়তে চায় না। যখন সরকারি চাকরি পায় না তখন তারা চরম হতাশায় নিমজ্জিত হয়। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রতি আমাদের সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিও এই সমস্যার জন্য দায়ী। অথচ উন্নত দেশগুলোতে কারিগরি শিক্ষার হার অনেক বেশি এবং সেখানে বেকারত্বের হারও কম।
এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি ও সুপরিকল্পিত উদ্যোগ। প্রথমত শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। পাঠ্যক্রমকে হতে হবে যুগোপযোগী ও বাজারমুখী। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসারে সরকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের শুধু চাকরি প্রত্যাশী না বানিয়ে তাদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এর জন্য সহজ শর্তে ঋণ এবং ব্যাবসায়িক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি। পাশাপাশি বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের তরুণ জনগোষ্ঠী দেশের সম্পদ। তাদের মেধা ও শ্রমকে কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক দূর এগিয়ে যাবে। কিন্তু যদি এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তবে এই শিক্ষিত বেকার বাহিনী ভবিষ্যতে দেশের জন্য বড় ধরনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
লেখক : শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়।
খুলনা গেজেট/এনএম

