মাত্র আড়াই মাস পরেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ইতোমধ্যে অধিকাংশ সংসদীয় আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। প্রচারও শুরু করেছেন তারা। ভোটের মাঠে এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, সিপিবি, গণসংহতি আন্দোলনসহ বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা থাকলেও খুলনা-৬টি আসনে এগিয়ে রয়েছে বিএনপি ও জামায়াত প্রার্থীরা।
নির্বাচনী আসনগুলো ঘুরে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রচার-প্রচারণা এবং জনসম্পৃক্তার দিক থেকে খুলনা-২, খুলনা-৩ ও খুলনা-৪ আসনে এগিয়ে রয়েছেন বিএনপি মনোনীত প্রার্থীরা। অন্যদিকে খুলনা-৫ ও খুলনা-৬ আসনে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন জামায়াতের দুই প্রার্থী। খুলনা-১ আসনে বিএনপি এখনও প্রার্থী চূড়ান্ত করেনি। অন্যদলগুলোর তৎপরতা ওই আসনে ভোটারদের মধ্যে তেমন প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারেনি।
খুলনা-২ আসন
অংশগ্রহণমূলক প্রতিটি নির্বাচনে আসনটিতে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীরাই জয়ী হয়েছেন। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে একদরফা ও ভোট বর্জনের নির্বাচনে আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হন। এবার আসনটিতে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বি বিএনপি ও জামায়াত।
আসনটিতে এবার বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন দলটির জনপ্রিয় নেতা নজরুল ইসলাম মঞ্জু। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস জয়ের মধ্যেও খুলনা-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। আসনটিতে জামায়াত প্রার্থী করেছে কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরা সদস্য ও নগর জামায়াতের সেক্রেটারি শেখ জাহাঙ্গীর হুসাইন হেলালকে। তিনি খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর।
এছাড়া সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, ইসলামী আন্দোলনের মহানগর সভাপতি মুফতি আমান উল্লাহ, গণসংহতি আন্দোলনের জেলা আহ্বায়ক মুনীর চৌধুরী সোহেল, খেলাফত মজলিসের অ্যাডভোকেট শহিদুল ইসলাম নির্বাচনে প্রচার চালাচ্ছেন। তবে নজরুল ইসলাম মঞ্জু ও জাহাঙ্গীর হুসাইন হেলালের ধারে কাছেও তারা নেই। ভোটের মাঠের পুরোটাই এই দুই প্রার্থীর দখলে। বিএনপি প্রার্থীর অবস্থা তুলনামূলক ভালো বলে ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে মানুষ ভোট দেয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। মানুষের সেই কাংখিত ভোটে জয়ী হওয়ার বিষয়ে আমি আশাবাদী।’ জামায়াতের প্রার্থী জাহাঙ্গীর হোসাইন হেলাল বলেন, ‘প্রচারণায় মানুষের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। ভোটের ফলাফলে এর প্রতিফলন ঘটবে।’
খুলনা-৩ আসন
খুলনা সিটি করপোরেশনের ১ থেকে ১৫ নম্বর ওয়ার্ড, যোগীপোল ও আড়ংঘাটা ইউনিয়ন নিয়ে খুলনা-৩ আসন। শ্রমিক অধ্যুষিত এই এলাকায় অতীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পালা করে জিতেছে। বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল এবারও দলের মনোনয়ন পেয়েছেন। আসনটিতে তার পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছেন দলটির নেতাকর্মীরা।
আসনটিতে ১৯৯৬ সালের পর জামায়াত কখনো প্রার্থী দেয়নি। এবার জামায়াতের প্রার্থী মহানগর জামায়াতের আমির অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান। নির্বাচনী এলাকায় তিনিও ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন।
এছাড়া ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির আবদুল আউয়াল প্রচারণা চালাচ্ছেন। ২০২৩ সালের কেসিসি নির্বাচনে তিনি ৬০ হাজারের বেশি ভোট পেয়েছিলেন। ভোট বর্জন করে ওই নির্বাচন প্রার্থী দেয়নি বিএনপি ও জামায়াত।
স্থানীয়রা জানান, ভোটের প্রার্থী বিএনপি ও জামায়াত প্রচারণায় এগিয়ে রয়েছে। তবে নানা সমীকরণে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে বিএনপি প্রার্থী। সুষ্ঠু পরিবেশ থাকলে শেষ পর্যন্ত এই হিসাব পাল্টে যেতে পারে।
বিএনপি প্রার্থী রকিবুল ইসলাম বকুল বলেন, ‘এই এলাকার মানুষ কর্মস্থল, রুজি হারিয়ে দীর্ঘ বঞ্চনার শিকার। তারা বিএনপির দিয়ে তাকিয়ে আছে। ভোটে জিতে তাদের আস্থার প্রতিদান দেব।’
জামায়াতের অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘দীর্ঘ জুলুম-নির্যাতনের পর মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে। প্রচারে তাদের মুখে পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাচ্ছি। আশা করছি ভোটের ফলাফলে পরিবর্তন দেখতে পাবেন।’
খুলনা-৪ আসন
রূপসা, তেরখাদা ও দিঘলিয়া নিয়ে খুলনা-৪ আসন। আসনটি অতীতে কখনো বিএনপি, কখনো আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিজয়ী হন। ২০১৮ সালের মতো এবারও বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির তথ্য সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল দলীয় প্রার্থী হচ্ছেন। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি এলাকায় নিয়মিত গণসংযোগ করছেন।
এখানে জামায়াতের প্রার্থী খুলনা জেলা কমিটির নায়েবে আমির কবিরুল ইসলাম। ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী দলের মহাসচিব ইউনুস আহমাদ। তাঁরা দু’জনই এলাকায় মোটামুটি সক্রিয়। তবে প্রচার-প্রচারণা এবং নির্বাচনী জনসংযোগে এগিয়ে রয়েছেন বিএনপি নেতা আজিজুল বারী হেলাল।
আজিজুল বারী হেলাল বলেন, ‘মানুষ এলাকার উন্নয়ন চায়, কর্মস্থলের সুযোগ চায়। একমাত্র বিএনপি তাদের এই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারবে। এটা মানুষও বোঝে। এজন্য তারা বিএনপিকেই ভোট দেবে।’
ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব ইউনুস আহমাদ বলেন, ‘চাঁদাবাজি, দখল, লুটপাটের প্রতি মানুষের ঘৃণা জন্মে গেছে। প্রচারে গেলে মানুষ বলছে, আপনারা ইসলামপন্থিরা এগিয়ে আসুন। সুষ্ঠু ভোট হলে তারা ওই অপশক্তির বিরুদ্ধেই ভোট দেবে বলে আমার বিশ্বাস।’
খুলনা-৫ আসন
ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলা নিয়ে গঠিত খুলনা-৫ আসন। অতীতে আসনটি আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের মধ্যে পালাবদল হয়েছে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচন ছাড়া এখানে বিএনপি কখনো আসনটিতে জেতেনি। জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক সংসদ সদস্য মিয়া গোলাম পরওয়ার এবারও আসনটিতে প্রার্থী হয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় নির্বাচনী তৎপরতা চালাচ্ছেন তিনি। তারপক্ষে কর্মীরাও একাট্টা।
দীর্ঘ ২৯ বছর পর বিএনপি এ আসনে নিজস্ব প্রার্থী দিয়েছে আলী আসগর লবিকে। ২০০১ সালের উপনির্বাচনে খুলনা-২ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আলী আসগর। এই ব্যবসায়ী ২০০৯ সাল থেকে রাজনীতির মাঠে ছিলেন না। তবে দলের হাইকমান্ডের নির্দেশনায় কয়েক মাস ধরে তিনি নির্বাচনী গণসংযোগ করছেন। পরে তাকেই আসনটিতে প্রার্থী ঘোষণা করে বিএনপি।
এ আসনের লক্ষাধিক ভোটার হিন্দু সম্প্রদায়ের। দুই প্রার্থীই তাঁদের ভোট টানতে মরিয়া। জামায়াত হিন্দু কমিটি গঠন করেছে। গত মাসে উপজেলা স্বাধীনতা চত্বরে হিন্দু কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত সম্মেলনে বক্তব্য দেন গোলাম পরওয়ার। বিএনপির প্রার্থীও নিয়মিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন। ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী আবদুস সালাম এখানে তেমন সক্রিয় নন।
স্থানীয় ভোটাররা জানান, সার্বিক বিবেচনায় এখন পর্যন্ত জামায়াতের প্রার্থী আসনটিতে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন। তবে বিএনপি ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামলে দৃশ্যপট পাল্টে যেতে পারে।
খুলনা-৬ আসন
স্বাধীনতার পর থেকে বিএনপি কখনোই খুলনা-৬ (কয়রা-পাইকগাছা) আসনে জয় পায়নি। ২০০১ সালের নির্বাচনে চারদলীয় জোটের অংশ হিসেবে আসনটি জামায়াতকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এবার এখানে বিএনপির প্রার্থী হচ্ছেন সদ্য দায়িত্ব পাওয়া জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সদস্যসচিব মনিরুল হাসান বাপ্পী। তাঁর বাড়ি রূপসা উপজেলায়। তার এই ‘বহিরাগত’
পরিচয় স্থানীয় রাজনীতিতে কিছুটা প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।
১৯৯৬ ও ২০০১ সালে আসনটিতে জয় পায় জামায়াত নেতা রুহুল কুদ্দুস। এবার আসনটিতে জামায়াতের প্রার্থী হয়েছেন কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও খুলনা অঞ্চলের সহকারী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ। এর আগেও তিনি ওই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। ইসলামী আন্দোলনের জেলা সেক্রেটারি আসাদুল্লাহ আল গালিব এ আসনে দলের ঘোষিত প্রার্থী।
আসনটিতে নির্বাচনী তৎপরতা অন্য দলগুলোর তুলনায় এগিয়ে জামায়াত। তবে বিএনপির প্রার্থী পক্ষে ঐক্যবদ্ধ প্রচার শুরু হলে পরিস্থিতি পাল্টাতে পারে।
খুলনা-১ আসন
খুলনার হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত দাকোপ-বটিয়াঘাটা উপজেলা নিয়ে গঠিত খুলনা-১ আসন। আসনটি বরাবরই আওয়ামী লীগের ঘাটি হিসেবে পরিচিত। ১৯৯১ সাল থেকে প্রতিটি নির্বাচনে সেখানে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। ২০০১ ও ২০০৮ সালে অবশ্য বিএনপি প্রার্থী আমীর এজাজ খান তুলনামূলক ভালো ভোট পেয়েছিলেন। একসময় বাম দলের প্রভাব থাকলেও আসনটিতে জামায়াতের অবস্থান সব সময় দুর্বল ছিল। ১৯৯৬ সালে শেষবার জামায়াত প্রার্থী দিয়েছিল এবং মাত্র দুই হাজার ভোট পেয়েছিল।
সম্প্রতি এই আসনে জামায়াতের সাংগঠনিক কার্যক্রম কিছুটা বেড়েছে। এবার বটিয়াঘাটা উপজেলা জামায়াতের আমির শেখ আবু ইউসুফ আবারও প্রার্থী হয়েছেন। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মাওলানা আবু সাঈদও মাঠে আছেন। এই আসনে বিএনপি এখনও প্রার্থী চূড়ান্ত করেনি। বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী আমীর এজাজ খান ও জিয়াউর রহমান পাপুল প্রচারণায় রয়েছেন। আসনটিতে কী হতে পারে-এটা নিয়ে তেমন কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে খুলনা জেলা বিএনপির সাবেক আহবায়ক আমীর এজাজ খান বলেন, দীর্ঘ ২৯ বছর ধরে ওই এলাকায় আমি কাজ করছি। তখন বিএনপির নাম বলতে মানুষ ভয় পেত। আমার প্রচেষ্টায় দাকোপ বটিয়াঘাটায় দল আজ সংগঠিত। আমার এই প্রচেষ্টা দল মূল্যায়ন করবে।
সাবেক ছাত্রদল নেতা জিয়াউল আলম পাপুল বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এই আসনের ভোটার অবহেলিত। দলের নেতা-কর্মীরা উপেক্ষিত। মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে অনেক সাড়া পেয়েছি। বিষয়টি কেন্দ্রীয় নেতাদের জানিয়েছি। তারা কাজ অব্যাহত রাখতে বলেছেন।
খুলনা গেজেট/এনএম

