মঙ্গলবার । ১৮ই নভেম্বর, ২০২৫ । ৩রা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২

ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়

আবদুল কাদের খান

স্বাধীন হয়েছে ৫৪ বছর। কিন্তু আজও কান পাতলে অসহায় মানুষের আর্তনাদ, হাহাকার এদেশের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে। অভাব দুর্যোগ, দুরবস্থা যে আর কবে কাটবে, স্বয়ং মাবুদ ই জানেন। খুলনা গেজেট- এর ১৫ নভেম্বর, ২০২৫ শীর্ষ সংবাদ বা লীড নিউজ আকারে প্রকাশিত হয়েছে, যা বড়ই আতঙ্কের আশঙ্কার এবং চিত্তদাহের।

আঠারো বছর পরও বাগেরহাটের শরণখোলাবাসীর মনে ভয়ংকর রাতের দুর্বিষহ স্মৃতি, সমগ্র জনপদকে আরেকবার নাড়া দিয়েছে। বলেশ্বর তীর রক্ষা বাঁধে ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে। অন্তত ১১ টি জায়গায় সিসি ব্লক ধ্বসে মূল বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, এই বাঁধ নির্মাণের সময় সম্ভাব্যতা যাচাই ও নির্মাণের ত্রুটি এবং নদী শাসন না করে, প্রকল্পের কাজ শুরু করার ফলে এহেন ভয়ংকর পরিণাম দেখা দিয়েছে। বলেশ্বর তীরের বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বাঁধের বর্তমান টালমাটাল নাজুক পরিস্থিতি সমগ্র শরণখোলা জনপদের মানুষ-জনকে দারুণ ভাবে আতঙ্কিত করে তুলেছে।

কথায় বলে, ‘ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়!’ বাগেরহাটের শরণখোলা জনপদের ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষের মনে ঠিক এমনই আতঙ্ক বাসা বেধেছে। অতীতের নিষ্ঠুর করুন অভিজ্ঞতা তাদের আতঙ্কের কারণ। দেড় যুগ আগের কথা, ১৫ নভেম্বর, ২০০৭ সালে ভয়াল ঘূর্ণিঝড় সিডর এর আঘাতে মুহূর্তে লন্ডভন্ড, বিধ্বস্ত হয় এই জনপদ। আঠারো বছর পর আজও এলাকাবাসী ওই ভয়াল করুন স্মৃতি মনে করে দারুণ ভাবে আতঙ্কিত।

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডর দানবের রূপ নিয়ে মুহূর্তের লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল উপকূলের এই জনপদ। সেই রাতের ঝড় জলোচ্ছ্বাসে বাগেরহাটের শরণখোলা পরিণত হয়েছিল, বিরানভূমি ভয়ংকর মৃত্যুপুরীতে। প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় সহ¯্রাধিক মানুষ। সেদিন রাতের সেই প্রলয়ংকরী ঝড়ের তা-ব আর বিভীষিকা মনে করে আজও শিহরে ওঠে শরণখোলা উপকূলের মানুষ। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রবল জলোচ্ছ্বাসে মুহূর্তেই ভেসে গিয়েছিল মানুষের বসত ঘর, গবাদি পশু, গোলাপালা, গাছপালা, ক্ষেতের ফসল। সিডর এর ছোবলের পর বিধ্বস্ত জনপদে চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়েছিল লাশ আর লাশ। সবখানেই ভেসে বেড়াচ্ছিল স্বজন হারা মানুষের বিলাপ। উপকূলীয় এলাকায় টেকসই বেড়ীবাঁধ না থাকায় সিডরের আঘাতে দুর্বল নাজুক বাঁধ ভেঙ্গে বলেশ্বর নদের ভয়ংকর জলোচ্ছ্বাসে ধ্বংস স্তূপে পরিণত হয় শরণখোলার কলহাস্য মুখর জনপদ।

দুঃখজনক অপ্রিয় সত্য কথা, সিডর-এর নয় বছর পর বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩৫/১ পোল্ডারে বিরাট উঁচু ৬২ কিলোমিটার বেড়ীবাঁধ নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে রাক্ষসী বলেশ্বর নদীর তীর শরণখোলার সাউথখালী ইউনিয়নের বগি থেকে মোড়েলগঞ্জ উপজেলার প্রান্ত সীমানা পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলীয় এলাকায় নির্মিত বাঁধের পরিমাণ প্রায় বিশ কিলোমিটার।

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপকূলীয় হিসাবে উন্নয়ন প্রকল্পের (সি ই আই পি-১) মাধ্যমে ২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি শুরু হয় এই নির্মাণের কাজ। সিএইচডাব্লিউই নামের চীনা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এই বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। কাজ শুরু থেকে তিন বছরের মধ্যে ২০১৯ সালে প্রকল্পটি সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও নানা অজুহাতে কাজ সম্পন্ন হতে সময় লাগে সাত বছর। কাজ শেষ হবার পর ২০২৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ড এর কাছে কর্তৃপক্ষ বাঁধের সম্পন্ন রিপোর্ট পেশ করে। কিন্তু কাজ শেষ হবার দেড় বছর যেতে না যেতেই বাঁধটি ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। বলেশ্বর নদের তীর রক্ষা বাঁধের অধিকাংশ স্থানে ভয়াবহ ভাঙন সৃষ্টি হওয়ায় ওই এলাকার পুরো ২০ কিলোমিটার বাঁধই এখন ভয়াবহ হুমকির মুখে। বাঁধের বর্তমান পরিস্থিতি নাজুক অবস্থায় পৌঁছানোর কারণে পুরো শরণখোলা উপকূলের মানুষের দিন কাটছে দারুণ উৎকণ্ঠায়। তারা আক্ষেপ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছে, প্রলয়ংকরী সিডর এর ১৮ বছর পরও একই বাঁধ নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তা করতে হচ্ছে। প্রতিনিয়ত আতঙ্কে দিন কাটছে বলেশ্বর নদের তীরের অসহায় বাসিন্দাদের। এলাকাবাসী বাঁধের বিপন্ন অবস্থায় দারুণ ভাবে উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ।

কতটা আতঙ্কে তাদের প্রতিদিন কাটছে তার নমুনা হিসেবে এলাকাবাসীর সাক্ষাৎকার থেকে পরিস্থিতির ভয়াবহতার এক বাস্তব করুন চিত্র উঠে এসেছে। বলেশ্বর নদ তীরবর্তী গাবতলা গ্রামের বাসিন্দা মিজান হাওলাদার, দক্ষিণ সাউথখালী গ্রামের বাসিন্দা আলমগীর হোসেন, জাহাঙ্গীর খান, উত্তর সাউথখালী গ্রামের আনোয়ার হাওলাদার প্রমুখ আক্ষেপ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, টেকসই বেড়ীবাঁধ ছিল না বলে প্রলয়ংকরী সিডরে আমরা আমাদের সহায় সম্পদ এবং স্বজনদের হারিয়েছি। প্রলয়ংকরী সিডর মুহূর্তে ঘরবাড়ি সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। আমাদের জীবন ও সম্পদের বিনিময়ে একটি টেকসই উঁচু মজবুত বাঁধ চেয়েছিলাম। অত্যন্ত বেদনার বিষয়ে এই যে, লোক দেখানো উঁচুবাঁধ নির্মাণ হয়েছে ঠিকই কিন্তু এখানে রয়ে গেছে শুভঙ্করের বিরাট ফাঁকি! বাঁধটি বাইরে থেকে দেখতে মজবুত ও উঁচু হলেও কোনোভাবেই টেকসই হয়নি এটাই পরিহাস! আমাদের প্রস্তাব অনুযায়ী নদী শাসন না করে নামকাওয়াস্তে বাঁধ নির্মাণ করায় শুধু অর্থের অপচয় হয়েছে। কাজের কাজ সামান্যও হয়নি। এলাকাবাসীর আতঙ্ক ও দুর্ভোগ সামান্যটুকুও কমেনি। বাঁধ নির্মাণ করে হস্তান্তর করার মাত্র দেড় বছর যেতে না যেতেই পুনরায় ভয়াল ভাঙন শুরু হয়েছে।

এলাকাবাসী দুর্দশা পীড়িত মানুষ ভয়ংকর হুংকার দিয়ে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, দ্রুত মজবুতভাবে বাঁধের ফাটল সংস্কার এবং নদী শাসনের ব্যবস্থা না করা হলে, আগামী দুই তিন বছরের মধ্যে এই বাঁধ ভেঙে পুরো এলাকাটি বলেশ্বরের পানির তোড়ে বিলীন হয়ে যাবে।

এলাকাবাসীর দুর্দশা চিত্র পরোখ করে শরণখোলা উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি আনোয়ার হোসেন তার অভিমত প্রকাশ করে বলেন, অবিলম্বে নদী শাসন ছাড়া টেকসইবাঁধ হওয়া সম্ভব নয়। তৎকালীন সরকার ও বিশ্ব ব্যাংক শরণখোলার এই উপকূলীয়বাঁধ নির্মাণে নদীর শাসন এর ব্যবস্থা না রেখে অজ্ঞাত রহস্যজনক কারণে দারুণ ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। এখানে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। প্রকল্পের মাটি ব্যবহার করার কথা থাকলেও মাটির বদলে স্থানীয় নদীর বালু ব্যবহার করা হয়েছে। এতে শুধু বাঁধ উঁচু হয়েছে কিন্তু দুর্বল নির্মাণের কারণে টেকসই হয়নি। ওই বিএনপি নেতা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছে দ্রুত নদী শাসন করে টেকসই বাঁধ মেরামত ও ওই কাজে দুর্নীতির তদন্ত দাবি করেছেন। বাগেরহাটের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানিয়েছেন, এলাকার ভাঙন রোধে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ১০০০ মিটার এলাকার ভাঙন রোধে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর আওতায় শরণখোলার বগি এলাকার প্রায় সাতশ মিটার ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় বালু ভর্তি জিও ব্যাগ এবং সিসি ব্লক ও মোড়েলগঞ্জ সীমানায় ফাসিয়াতলা এলাকায় বালু ভর্তি জিও ব্যাগ ডাম্পিং করা হবে।

ওই এলাকার সামগ্রিক পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে কর্তৃপক্ষের শৈথিল্য দেখানোর কোন অবকাশ নেই বলে আমরা মনে করি। নাজুক অবস্থার বাঁধটি দুর্যোগ কবলিত হবার আগেই পরিস্থিতি যত তাড়াতাড়ি সামলে নেয়া যায়, ততই মঙ্গলজনক। অন্যথায়, বলেশ্বর নদের তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের জীবন ও সম্পদের যেকোনো মুহূর্তে বিলীন হবে, পরিস্থিতি দেখে তা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন