জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত গণহত্যাসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মামলার রায় আজ ঘোষণা করা হবে। এ মামলার রায় দেবেন বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
এর মধ্য দিয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত অপরাধের প্রথম কোনো মামলায় বিচারের রায় ঘোষণা হতে যাচ্ছে। মামলার অপর দুই আসামি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের সাবেক আইজিপি। বেলা ১১টায় রায় ঘোষণা হবে।
রায় টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বড় পর্দায় দেখানো হবে। ট্রাইব্যুনালের অনুমতি সাপেক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং তাদের মাধ্যমে দেশি ও বিদেশি গণমাধ্যম রায় সরাসরি সম্প্রচার করতে পারবে।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য স্থাপিত হয়েছিল এই ট্রাইব্যুনাল। গত ১৪ বছরে ১৫৫ জনের বিচার শেষ হয়েছে এই ট্রাইব্যুনালে। সেই সময় বিচার কার্যক্রম সরাসরি সম্প্রচার করার কোনো ব্যবস্থা ছিল না।
ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন– বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। গত বছরের ৫ আগস্ট গণআন্দোলনের মুখে বাধ্য হয়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও ভারতে আছেন বলে ধারণা করা হয়। তাদের পলাতক দেখিয়ে এ মামলার বিচারকাজ চলে। এ মামলায় অপর আসামি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন অপরাধের দায় স্বীকার করে ‘রাজসাক্ষী’ হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন।
গত ২৩ অক্টোবর উভয় পক্ষের শুনানি, যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পর সমাপনী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মামলাটির বিচারকার্য শেষ হয়। সেদিন রায়ের তারিখ ঘোষণার জন্য ১৩ নভেম্বর নির্ধারণ করেছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
রায়ে স্বচ্ছতা দাবি মির্জা ফখরুলের
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে রায়ে স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। রোববার বিকেলে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এই দাবি জানান।
বিএনপি মহাসচিব লেখেন, সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণা করতে যাচ্ছে, যেখানে গত বছরের ঢাকায় সংঘটিত প্রাণঘাতী সহিংসতা ও দমনপীড়নের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে। আমরা পূর্ণ ন্যায়বিচার দাবি করছি।
প্রসিকিউশনের বক্তব্য
অভিযুক্তরা দণ্ডিত হলে তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে ভিকটিমদের পরিবারগুলোর মধ্যে বণ্টনের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ আবেদন জানিয়েছেন প্রসিকিউশন। গতকাল রোববার প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম সাংবাদিকদের বলেন, ট্রাইব্যুনালের আইনের বিধান অনুযায়ীই এই আবেদন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, যেহেতু আইনে রয়েছে, তাই আমরা দোষীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার আবেদন করেছি। ন্যায়বিচারের স্বার্থে ট্রাইব্যুনাল যে আদেশ দেবেন, প্রসিকিউশন তা মেনে নেবে।
প্রসিকিউটর আরও জানান, এই মামলায় শেখ হাসিনা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চাওয়া হয়েছে। প্রসিকিউশন বিশ্বাস করেন, এ মামলায় আনা পাঁচটি অভিযোগই তারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছেন।
রাষ্ট্রপক্ষের এই আইনজীবী বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার রায় ঘোষণার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনাকে নারী হিসেবে কোনো রকমের সহানুভূতি বা বিশেষ সুবিধা দেওয়া হবে না।
অন্যদিকে, শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল খালাস পাবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। তিনি বলেন, আমার প্রত্যাশা, আমার মক্কেলরা খালাস পাবেন।
মামলার বিচার কার্যক্রম
চলতি বছর ১০ জুলাই অভিযোগ (চার্জ) গঠনের মধ্য দিয়ে এ মামলার আনুষ্ঠানিকভাবে বিচারকাজ শুরু হয় এবং ২৩ অক্টোবর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়। গত বছর ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত অভিযোগ গঠনের পর থেকে তিন মাস ১৩ দিনের মধ্যে বিচার শেষ হলো।
ট্রাইব্যুনাল ঘিরে কড়া নিরাপত্তা
আজ রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে গতকাল থেকে পুরোনো হাইকোর্ট ভবন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। গতকাল থেকে হাইকোর্ট মাজার-সংলগ্ন ট্রাইব্যুনাল এলাকায় সতর্ক অবস্থান নিয়েছেন সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ, এপিবিএন ও বিজিবি সদস্যরা।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও তৎসংলগ্ন এলাকায় পর্যাপ্ত সংখ্যক সেনাসদস্য মোতায়েন করে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গতকাল সেনাবাহিনীকে চিঠি দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।
এ ছাড়া ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে মোতায়েন করা হয়েছে কয়েক হাজার পুলিশ সদস্য। পাশাপাশি রাজধানীজুড়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন বিজিবি ও সেনাসদস্যরা।
একনজরে শেখ হাসিনার বিচার
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানের সময় ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যাসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য গত বছরের ১৪ আগস্ট ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় অভিযোগ করেন শহীদ সিয়ামের বাবা বুলবুল ফকির। এতে প্রথম অভিযোগ ছিল শেখ হাসিনাসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে।
অভিযোগে বলা হয়েছে, এক থেকে ৯ নম্বর আসামির নির্দেশে ও পরিকল্পনায় অন্য আসামিরা দেশি এবং আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে আন্দোলনকারী সাধারণ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে। এসব অভিযোগ যাচাই-বাছাই ও পর্যালোচনা করে মামলা হিসেবে ট্রাইব্যুনালের ‘কমপ্লেইনার’ রেজিস্টারে নথিভুক্ত করা হয়। সে ক্ষেত্রে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মামলার বাদী চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
এরপর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ শুরু হয় গত বছরের ১৭ অক্টোবর। সেদিনই এ মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর তদন্ত সংস্থার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছর ১৬ মার্চ সাবেক আইজিপি মামুনকে এ মামলায় আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা চলতি বছরের ১২ মে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। আর প্রসিকিউশন শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে গত ১ জুন। প্রসিকিউশনের দাখিল করা অভিযোগপত্রটি ছিল ১৩৫ পৃষ্ঠার। এর সঙ্গে আট হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার বিভিন্ন নথি ও তথ্যপ্রমাণ জমা দেওয়া হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার জানে আলম খান ও মো. আলমগীর।
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান দমনে এক হাজার ৪০০ জনকে হত্যা ও ২৫ হাজার মানুষকে অঙ্গহানির উস্কানি, প্ররোচনা ও নির্দেশ দান, ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’সহ মোট পাঁচটি অভিযোগ আমলে নিয়ে গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এর মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রথম মামলার বিচার শুরু হয়। উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ২৩ অক্টোবর শেষ হয় মামলার বিচার। চলতি বছর গত ২ জুলাই আদালত অবমাননার দায়ে শেখ হাসিনাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন একই ট্রাইব্যুনাল।
খুলনা গেজেট/এইচ

