গত ২৫ মে রাতে উপজেলার মোছাব্বরপুর গ্রামে গুলি করে হত্যা করা হয় রনি ওরফে কালা রনি নামের যুবককে। ঠিক এক মাস পরেই ২৬ জুন রাতে মাদক বিক্রেতা সোহাগের বাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয় সাব্বির নামের আরেক জনকে। এর দুই মাস পর একইভাবে গুলি করে হত্যা করা ইমরান হোসেন মানিক নামের আরেক যুবককে।
পুলিশ বলছে, তিন যুবকই খুলনার শীর্ষ সন্ত্রাসী রনি চৌধুরী ওরফে গ্রেনেড বাবুর মাদক সিন্ডিকেট ‘বি কোম্পানি’র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। হত্যাকারীরাও একই গ্রুপের সদস্য। মাদক বিক্রি ও টাকা ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরেই একই গ্রুপের ব্যক্তিদের হাতে তারা খুন হয়েছেন। খুনীদের বড় একটি অংশ খুলনা শহরে মাদক বিক্রি ও সরবরাহের কাছে সম্পৃক্ত।
সর্বশেষ গত ৬ নভেম্বর রাতে সোহেল হাওলাদার নামে আরেক যুবককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশের ভাষ্য, আগের হত্যায় জড়িতরা এই হত্যায় সম্পৃক্ত।
রূপসা উপজেলার এই চারটি হত্যাকা- শুধু উদাহরণ মাত্র। মাদক বিক্রি, টাকার ভাগ, মাদক বিক্রির এলাকা নিয়ন্ত্রণ এবং আধিপত্য বিস্তার নিয়ে একের পর এক হত্যাকান্ড ঘটছে খুলনায়। অভ্যুত্থানের পর গত ১৫ মাসে খুলনা মহানগরীতে ৪১টি হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৫টির পেছনেই মাদক ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধের বিষয়টি উঠে এসেছে।
মামলার তদন্তে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, বিগত দিনে আইন শৃংখলা তৎপরতায় বেশিরভাগ সন্ত্রাসী কারাগারে অথবা পলাতক ছিল। মহানগরীতে সমমর্যাদার একাধিক সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয় ছিল। এর মধ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসী নূর আজিজ ও শেখ পলাশকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আশিক বাহিনীর প্রধান আশিক পলাতক, সেকেন্ড ইন কমান্ড সজিবও গ্রেপ্তার হয়েছে। এই সুযোগে পুরো সিন্ডিকেট গ্রেনেড বাবু নিয়ন্ত্রণাধীন বি কোম্পানির দখলে চলে গেছে। তারা বেপরোয়া হয়ে নিজেরাই এখন খুনোখুনিতে জড়াচ্ছে। তুচ্ছ কারণে গুলি ও হত্যার ঘটনা ঘটছে।
একের পর খুন, গ্রেপ্তার নেই, পরিবারগুলো হতাশ
গত ৪ মাসের ব্যবধানে শুধু মহেশ্বরপাশা ও আশপাশের এলাকাতেই তিন জনকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। আড়ংঘাটা এলাকায় মামুন শেখ নামের আরেক জনকে হত্যা করতে গেলে গুলি লক্ষ্যভ্রস্ট হয়ে মারা গেছেন ইমদাদুল হক নামের এক শিক্ষক।
এর মধ্যে গত ১১ জুলাই মহেশ্বরপাশা পশ্চিমপাড়া নিজ বাড়ির সামনে বহিষ্কৃত যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমান মোল্লাকে গুলি করে ও পায়ের রগ কেটে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।
৩ আগস্ট মহেশ্বরপাশা উত্তর বণিকপাড়া এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় ঘের ব্যবসায়ী আলামিন হাওলাদারকে। গত ১ অক্টোবর নিজ ঘরে খুন হন তানভীর হাসান শুভ। তিনটি ঘটনায় দৌলতপুর থানায় অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে পৃথক তিনটি মামলা হয়েছে। মাহাবুব হত্যায় গত জুলাই মাসে ৪ জনকে আটক করা হয়। গত দুই মাস ধরে সেই মামলার অগ্রগতি নেই। অন্য মামলাগুলোর প্রধান আসামিরা কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।
শুভ হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এস আই বদিউর রহমান বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি, খুব দ্রুত ভালো খবর শোনাতে পারবো।
একই ধরনের বক্তব্য দেন আলামিন হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন।
নিহত মাহবুবের বাবা ও মামলার বাদি আবদুল করিম মোল্লা বলেন, ‘খুনীদের সবাই চেনে, অথচ তিন মাস হয়ে গেল মাহাবুবের খুনীরা ধরা পড়লো না। এর মধ্যে বাড়ির পাশে শুভ খুন হলো। মাহাবুবের খুনীরা ধরা পড়লে শুভ ছেলেরা হয়তো বেঁচে যেত।’
আলামিনের বড় ভাই ও মামলার বাদি আওলাদ শেখ বলেন, ‘দুই মাস হয়ে গেল, কেউ ধরা পড়লো না। বিচার চাইতেও এখন ভয় লাগে।’
নগরীর দৌলতপুর থানার ওসি রফিকুল ইসলাম বলেন, তিনটি মামলা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। দ্রুত আসামিরা ধরা পড়বে।
খুলনা সচেতন নাগরিক কমিটির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট কুদরত ই খুদা বলেন, অভ্যুত্থানের পর পুলিশের ভেঙে পড়া মনোবল এখনও ঠিক হয়নি। থানা ও ফাঁড়ি পর্যায়ে পুলিশের সব কর্মকর্তা সমান সক্রিয় নয়। সন্ত্রাসীদের তথ্য পেলেও তারা আগের মতো গ্রেপ্তারে সক্রিয় হচ্ছেন না। এই সুযোগে সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। হত্যাকান্ড ও অপরাধ বাড়ছে।
দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, রাজনৈতিক সরকার আসা পর্যন্ত পুলিশের মাঠ পর্যায়ের সদস্যরা গা বাঁচিয়ে চলতে চাইছেন, অনেকে নিস্ক্রিয় থাকছেন। এর সঙ্গে সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে। মানুষ দিন দিন মারমুখী হয়ে উঠছে। অল্পতেই খুনোখুনিতে জড়াচ্ছে।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার জুলফিকার আলী হায়দার বলেন, অভ্যুত্থানের পর পুলিশের ঘুরে দাড়াতে সময় লেগেছে। এই সুযোগে বেপরোয়া হয়ে ওঠা সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো এলাকা দখল নিয়ে বিরোধে জড়ায়। তখন কিছু হত্যাকান্ড সংগঠিত হয়। এরপর দুই বাহিনী প্রধানসহ বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করার পর ফাঁকা মাঠ দখল করতে অন্য গ্রুপ নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে। যারা খুন হয়েছে, তারা এসব বাহিনীর সদস্য।
তিনি বলেন, ৯ শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ মোট ৫৪ সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার হয়েছে, বাকিরাও দ্রুত গ্রেপ্তার হবে। মানুষ আগের মতো পুলিশকে তথ্য দিচ্ছে না, অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পুলিশের ঘুরে দাড়ানো এবং সন্ত্রাস দমন করতে জনগণকে সহযোগিতা করতে হবে। তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে।
খুলনা গেজেট/এনএম

