ছোটোবেলায় শুনতাম, ‘লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়ায় চড়ে সে!’ কিন্তু সাবেক পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের জীবনে দেখলাম, ছড়াটি সম্পূর্ণ উল্টো ভাবে এদেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জীবনকে ফালাফালা করে দিল। ইদানীং সময়ে মানুষ হর হামেশা ব্যঙ্গ করে বলে, ‘লেখাপড়া করে যে গাড়ির চাপা পড়া সে।’ কতইনা পরিহাস! বাংলাদেশের শিক্ষিত যুবক বেকারের পরিসংখ্যান দেখলে, মুহূর্তে চক্ষু চড়ক গাছ হয়ে যাবে। এদের নিয়ে গত ৫৪ বছরে কোনো একটি সরকার একবারও ভেবে দেখার সময় পায়নি! অথচ এরাও এদেশের শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত নাগরিক হয়ে জন্মেছিল!
আমরা প্রায়শ বুলি আওড়াই–‘Education is the backbone of a nation ’ অর্থাৎ, শিক্ষাই হলো জাতির মেরুদণ্ড।’ আর যারা শিক্ষাদান কাজের সাথে জড়িত, তারা হচ্ছেন শিক্ষক। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষক মানে অত্যন্ত গো-বেচারা, অসহায় একজন। সে নারী হোক কিংবা পুরুষ হোক। শিক্ষকতা পেশায় জড়িতদের মলাটে লেখা থাকে, এরা নাকি জাতি গড়ার সম্মানিত ও গর্বিত কারিগর! অথচ ললাটের দুঃখ ঘোচেনা কোন কালেও। আহারে সম্মানিত শিক্ষক!
একটু স্পষ্ট করে খুলে বলি। যে শিক্ষকদের বলা হয়, ‘Teachers are the architect of a Nation’ অর্থাৎ, শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর।’ কেউ কেউ সাহিত্য করে বলেন, পিতা জন্মদেন সন্তান আর তাকে মানুষ করে গড়ে তোলেন শিক্ষক। অর্থাৎ জন্মের জন্য মা-বাপের কাছে একজন মানুষ ঋণী কিন্তু তার চেয়েও বড় ঋণ রয়েছে শিক্ষাগুরুর কাছে। অথচ সেই শিক্ষাগুরুদের ভাগ্য বিড়ম্বনার অনেক খবরই আমরা জানিনা। জীবন পাতার অনেক খবর অগোচরেই রয়ে যায়!
রাজধানী ঢাকার রাজপথে সরকারের করুণা ভিক্ষা করে হাজার হাজার শিক্ষক শিক্ষিকা করুণ ফরিয়াদ করেছেন। কেউ তাদের কথা শোনার নেই! বলছিলাম, বছরের পর বছর নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের কথা। দেশের রাজধানী শহর ঢাকায় অনাহারে উপেক্ষায় দিনের পর দিন সরকারের কাছে বিভিন্ন নন এমপিও স্কুল কলেজ এবং মাদ্রাসা শিক্ষকরা ফরিয়াদ করেছেন। কিন্তু সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা, সচিব কিংবা সংশ্লিষ্ট বিভাগে দায়িত্বপ্রাপ্তদের ভাব এরকম — ‘তোমরা আর কয়টা দিন অপেক্ষা করো, সবুর কর দেখছি।’
নন এমপিও হাই স্কুল কলেজ এবং আলিম মাদ্রাসার শিক্ষকেরা প্রায় ২২ থেকে ২৫ বছর প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রেখে বিনা বেতনে অর্ধাহারে অনাহারে নিজের খেয়ে পেশাকে ধরে রেখেছেন। ২৫ বছর আগে যে তরুণ-তরুণী শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশ করেছিলেন, এখন সেই মানুষটি প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া পর্যায়ে পৌঁছেছেন। আজও পর্যন্ত তাদের প্রতিষ্ঠানে এমপিওভুক্ত হয়নি! ওদের প্রতিষ্ঠানগুলো কেন কি কারণে এমপিওভুক্ত হচ্ছে না, তাও তাদের জানা নেই। বছরের পর বছর কপর্দক শূন্য গাধার মত খাটছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জমি, বিধিসম্মতভাবে তাদের নিয়োগ পত্র, পাঠদান, পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল, প্রতিষ্ঠানের সব কিছু বহাল আছে। কিন্তু দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষা দিয়ে পাসও করছে, অথচ অনাহার সাদৃশ্য জীবন যাপনে অভ্যস্ত ওইসব হায়ার মাদ্রাসা, হাই স্কুল ও কলেজের শিক্ষকদের কোন্ অজ্ঞাত কারণে এমপিওভুক্তির ব্যবস্থা হচ্ছে না, তাও ওদের জানা নেই। দুঃখ ও উদ্বেগের ব্যাপার এই যে, দেশের অন্যান্য এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের মত এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তারা যথারীতি শিক্ষা বোর্ডের সিলেবাস অনুসরণ করছেন, ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠদান করছেন, পরীক্ষা নিচ্ছেন বছরের পর বছর, অথচ সরকারের কাছ থেকে একটা কানা কড়িও সহযোগিতা পাচ্ছেন না।
এইসব শিক্ষক শিক্ষিকার চাকরিতে যোগদানকালে বয়স ২২ থেকে ২৫ বছর কিংবা ২৫/২৬ বছর ছিল। এখন ওদের বয়স ৪০/৪২/৪৫ বছরে দাঁড়িয়েছে। আর বড়জোর ১৫ বছর তারা চাকরিতে আছেন বা চাকরি করতে পারবেন। পুরো সময়টা গেল বিনা বেতনে চাকরি করে। এমন নজীর কি পৃথিবীর কোথাও আছে? পরিহাসের ব্যাপার, তারা কোথাও বলতে পারছেন না তারা শিক্ষক! এই কলঙ্কের দায় কার? যখন যে সরকার আসছেন বছরের পর বছর এদের সাথে করছেন বঞ্চনা, নানা অজুহাতে। এখন তাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। দারুণ মানবেতর জীবন যাপন করছেন, পরিবার-পরিজন নিয়ে। অনেকের বুকে স্বপ্ন ছিল, এবছর না হোক সামনের বছর প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত হবে। কিন্তু গত ২০ /২২ বছরে শুধু উপেক্ষা ছাড়া আর কিছুই তাদের পাওনা হয়নি।
অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, এইসব হতভাগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যে অনেকেই সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খাওয়ার কারণে বিয়েই হয়নি। ঘর সংসার হয়নি। এদের জীবনের খবর রাজনৈতিক দল জানে না, বর্তমান সরকার জানে না। সমাজ সংসারে এদের বিপর্যয়ের খবর কেউ রাখে না।
এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এইসব উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিরা চাকরিতে থেকেও এমপিওভুক্তির অভাবে দারিদ্র্য-ক্লিষ্টতার শিকার এই বিপন্ন মানুষগুলো এখন কি করবে? ওদের চারিদিকেই তো অন্ধকারে ঘেরা! সরকার কি চান ওরা আত্মহত্যা করুক? আর কতকাল উপেক্ষার শিকার হবে ?
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় বসেছেন যাদের অব্যাহত আন্দোলন ও ত্যাগ স্বীকারের ফসল হিসেবে, তাদের প্রতি এত অবহেলা কেন? ফ্যাসিস্ট পতিত সরকারের সেট করা উচ্চ পর্যায়ের লোকজন আমাদের বিশ্বাস এখনো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ঘাপটি মেরে রয়েছে এবং তারাই এই হতভাগ্যদের বিরুদ্ধে কলকাঠি নাড়ছে। তাদের মনে রাখতে হবে একগুঁয়েমী কোনোমতে ভালো নয়। এই সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা সহ সংশ্লিষ্টদের সবাই শিক্ষক। তাহলে বোঝা উচিত এই হতভাগারা কি নিদারুণ বিপর্যয়ের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। আর কতদিন ওদের নাইট্রিক এসিড টেস্ট নেবেন? আপনাদের ব্যবহার দেখে তো মনে হয় না আপনারা এদেশের মানুষ!
এ কথা স্মরণ করা দরকার, গত ২০২৪ সালে তাদের লাগাতার আন্দোলনের মুখে এই সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কিছু বেশরম কর্মকর্তা আশ্বাস দিয়েছিলেন জুলাই ২০২৫ এর মধ্যে সব ফয়সালা হয়ে যাবে। কোথায় সেই জুলাই ২০২৫ ? এখন তো নভেম্বর, ২০২৫ অতিক্রান্তির পথে ! আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, পরিস্থিতি আয়ত্তে থাকা পর্যন্ত কাজগুলো ভালোয় ভালোয় সম্পন্ন করা কি উচিত নয়? যদি এটি বৃহত্তর আন্দোলনে রূপ নেয় তাহলে আপনাদের আর সামলানোর পথ খোলা থাকবে না। মাইন্ড ইট।
শিক্ষা বিভাগের মাথা মোটা মাথা ওয়ালা আমলাদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলতে চাই— ‘Signal is sufficient for wisor’ অর্থাৎ, জ্ঞানীর জন্য সংকেতই যথেষ্ট।’ আপনারা আশা করি অমনটি ভাববেন না যে, ‘রোম পোড়ে নীরো বাঁশি বাজায়।’ আপনারা অবহেলিত শিক্ষকদের নার্ভ বুঝতে বিলম্ব করলে, সমূহ বিপর্যয়ের দায় আপনাদের নিতে হবে। কারণ ২৪ এর রক্ত অভ্যুত্থানে এরা প্রাণবাজি রেখে যুদ্ধ করেছে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, তাই ওদের ঘর ভেঙে যাওয়ার আগে আপনারা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিন। হিসাব নিকাশ দ্রুত করুন, এটাই আমাদের এই মুহূর্তের পরামর্শ। কথাগুলো ভেবে দেখবেন।
kaderkhan1951@gmail.com
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
খুলনা গেজেট/এনএম

