সম্প্রতি প্রকাশিত হলো ২০২৫ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল। ফলাফল গতানুগতিক নয়। ১১ টি শিক্ষা বোর্ডের অধীন ১২ লাখ ৫১ হাজার ১১১ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। গড় পাসের হার ৫৮.৮৩ শতাংশ। এবারের পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৬৯ হাজার ৯৭ জন শিক্ষার্থী, যেখানে ২০২৪ সালে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন। অর্থাৎ জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ৭৬ হাজার ৮১৪ জন। ফলাফলে দেখা গেছে, ২০২৫ সালে দেশের ২০২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব পরীক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছেন। গত বছর শূন্য পাসের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৬৫। একবাক্যে স্বীকার করতে হবে, এবার ফলাফল বিপর্যয় ঘটেছে।
সরকার এবং শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য হলো- লেখাপড়ার মানোন্নয়ন, গতানুগতিক খাতা মূল্যায়ন রোধ এবং নকলের পরিবেশ নির্মূল করা। এবারের ফলাফলে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বার্তা দেওয়া হলো-‘আর গাফিলতি নয়’।
এবারের ফল বিপর্যয়কে বিজ্ঞজন বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করছেন। আমি আমার কিছু বিশ্লেষণ তুলে ধরার চেষ্টা করছি মাত্র। আমি মনে করি, এই গাফিলতির জন্য এককভাবে নয় বরং শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক এমনকি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও হতে পারে।
ক) ফলাফলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বার্তা দেওয়া হলো, তাদেরকে পড়ার টেবিলে বসতে হবে, পড়ায় মনোযোগী হতে হবে। কোভিড ১৯ এর পর থেকে শিক্ষার্থীরা পড়ার টেবিল থেকে ছিটকে পড়েছে। তাদেরকে এখন থেকে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে হবে, গাফিলতি পরিত্যাগ করতে হবে, ক্লাসমূখী হতে হবে। মোবাইলকে লেখাপড়ার কাজে ব্যবহার করা শিখতে হবে।
খ) অধিকাংশ অভিভাবক মনে করেন শিক্ষকবৃন্দ সঠিকভাবে পাঠদান করেন না। তাঁদেরকে এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। শিক্ষকদের ত্রুটি না ধরে অভিভাবক হিসেবে নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সজাগ হতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে সন্তান কার সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলছে, কখন বাড়ি থেকে বের হচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে, কখন বাড়ি ফিরছে। সন্তান কি কলেজে, না কি অন্য কোথাও গমন করছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিতে হবে সন্তান কলেজে গেলেও ক্লাস করছে কি না। ক্লাসের পড়া সঠিকভাবে সম্পন্ন করছে কি না। সন্তানের সামনে শিক্ষককে উদ্দেশ্য করে বিরূপ মন্তব্য থেকে বিরত থাকুন, না-হলে সেও শিক্ষক সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করতে উৎসাহিত হবে। তাহলে শিক্ষকের নির্দেশনা পালন করতে উদ্বুদ্ধ হবে। সন্তানের মোবাইল ব্যবহারের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
গ) এবার আসি শিক্ষকদের প্রসঙ্গে। নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ফলাফল যদি ভালো না হয়, সেটা শিক্ষকেরও লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, শিক্ষার্থী ভালো ফলাফল করলে সেটা প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি বাড়িয়ে দেয়, যার অংশীদার শিক্ষক নিজেই। সেজন্য শিক্ষককে যথাসময়ে প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে নিয়মিত শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। শ্রেণি কার্যক্রমে আনতে হবে নতুনত্ব, শিক্ষক হবেন একজন গবেষক যার গবেষণার মাধ্যমে শিক্ষার্থী আকৃষ্ট হয়ে শ্রেণিমুখী হবে। নিয়মিত ক্লাস টেস্ট পরীক্ষা গ্রহণ করে শিক্ষার্থীকে পড়াশোনার মধ্যে নিমজ্জিত করে রাখতে হবে। খাতা-কলমে নয়, বাস্তবতার আলোকে শিক্ষার্থীদের হাজিরার রেকর্ড সংরক্ষণ করে প্রতিষ্ঠান প্রধানকে অবহিত করতে হবে। শিক্ষককে কোচিং বাণিজ্য পরিত্যাগ করে শ্রেণি পাঠদানে আন্তরিক হতে হবে।
ঘ) প্রতিষ্ঠান প্রধান শিক্ষকের উপস্থিতি এবং শ্রেণি কার্যক্রম নিয়মিত তদারকি করার পদক্ষেপ নিশ্চিত করবেন। আগ্রহী, উদ্যোগী এবং উদ্যমী শিক্ষকদেরকে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করবেন। শিক্ষার্থীর হাজিরা নিশ্চিত করতে জরিমানা, অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে পরবর্তী শ্রেণিতে পড়ার অনুমতি না দেওয়া, প্রতিষ্ঠানের নিয়ম-শৃখলা ও পদক্ষেপ সম্পর্কে অভিভাবকদের অবহিত করে সহযোগিতা চাইবেন; না পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে কিছু দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারলে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা নির্দেশনা পালনে যত্নবান হবেন। প্রতিষ্ঠানের ভিতরে মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে। শিক্ষকের কোচিং বাণিজ্য বন্ধের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
ঙ) পূর্ব থেকেই ছিল, কিন্তু বিগত সরকার পতনের পর থেকে বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার বহুসংখ্যক শিক্ষক রাজনৈতিক কার্যক্রমে মনোযোগী হয়ে পড়েছেন। চাকরিস্থলে উপস্থিত না হয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের নজির রয়েছে শত-সহস্র। অথচ মাস শেষে ঠিকই বেতন গ্রহণ করছেন অনৈতিকভাবে। প্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষ, মাদ্রাসার সুপার তথা প্রতিষ্ঠান প্রধান ঐ শিক্ষকের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণে ভয় পাচ্ছেন। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে প্রতিষ্ঠান প্রধানকে ফ্যাসিস্টের দোসর হিসেবে ট্যাগ দিয়ে লাঞ্ছিত করার নজিরও বিদ্যমান আছে। অবাক কা- হলো, ধর্মীয় রাজনীতির সাথে যুক্ত শিক্ষকগণও হিংস্রতায় পিছিয়ে নেই! আমরা জানি, সরকারি চাকরিজীবীরা কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারেন না, কিন্তু সরকারি চাকরিজীবীরাও অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি রাজনৈতিক মিছিল-মিটিং এ অংশগ্রহণ করছেন, এমন দৃশ্যও নজরে আসছে। শিক্ষক কোনো অনৈতিকতার আশ্রয় নিলে প্রতিষ্ঠান প্রধান যেন যথাযথ আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে সেজন্য প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষকের বেতনের দিকে সুনজর দেওয়া সরকারের কর্তব্য। প্রচলিত বেতনে মানসম্মত জীবনধারণ কঠিন, বিধায় অনেক শিক্ষক কোচিং বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছেন। উন্নত রাষ্ট্র ও বর্তমান বাজারের সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে প্রচলিত বেতন কাঠামোর আমূল সংস্কারের মাধ্যমে শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো তৈরি করে তাঁদেরকে ভিন্ন পেশায় নিরুৎসাহিত করতে হবে, পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি সকল শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা জরুরি।
শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, যার কারিগর হলো শিক্ষক। শিক্ষা ব্যবস্থার এই ভয়াবহ বিপর্যয় রোধকল্পে কাজ করতে হবে সমন্বিতভাবে। শিক্ষক শ্রেণিতে যথাযথ পাঠদান ও নির্দেশনা প্রদান করবেন, শিক্ষার্থীকে শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক পড়ার টেবিলে বসতে হবে, সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়তে অভিভাবককে হতে হবে সজাগ ও সচেতন। শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর দায় চাপিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুললে শিক্ষার্থী অনৈতিকতার প্রশ্রয় পাবে; নষ্ট হবে তার ভবিষ্যৎ। প্রতিষ্ঠান প্রধানকে যথাযথ তদারকি ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে শিক্ষার্থীদেরকে প্রতিষ্ঠান ও ক্লাসমূখী করতে হবে। প্রশাসন, রাষ্ট্র তথা সরকারকে শিক্ষকের চাহিদা মোতাবেক বেতন প্রদান করে শ্রেণি কার্যক্রমে চাপের মুখে রাখতে হবে। অর্থাৎ শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, প্রতিষ্ঠান প্রধান এবং সরকারের সমন্বিত প্রচেষ্টাতেই শিক্ষার্থী আত্মসচেতন হয়ে পুনরায় পড়ার টেবিলে বসলেই ফিরে আসবে পড়ার পরিবেশ। ফলে শুধু এইচএসসি বা সমমান নয়, বরং সকল পরীক্ষার ফলাফল বিপর্যয় রোধ হবে। শিক্ষার মানোন্নয়নের মাধ্যমে আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার প্রয়াস পাবো।
লেখক : জেলা অ্যাম্বাসেডর শিক্ষক ও প্রভাষক, সরকারি ফুলতলা মহিলা কলেজ, খুলনা।
খুলনা গেজেট/এনএম
								
    
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
