মঙ্গলবার । ৪ঠা নভেম্বর, ২০২৫ । ১৯শে কার্তিক, ১৪৩২

ইসলামের দৃষ্টিতে ঋণের দায়বদ্ধতা ও অনাদায়ের ভয়াবহতা

মাওঃ মোঃ ফজলুর রহমান

ইসলামে ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে অত্যাধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ঋণের প্রথম অবস্থা হলো দুশ্চিন্তা আর শেষ অবস্থা হলো ঝগড়া-বিবাদ। হাদিস শরীফে ঋণ কে বলা হয়েছে ভালোবাসার কাঁচি। অর্থাৎ কাঁচি যেমন কোন কিছুকে কেটে আলাদা করে দেয় ঠিক তেমনি ঋণও মানুষের মধ্যকার সুসম্পর্ক, ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্ববোধকে নষ্ট করে দেয়। তাই যথা সম্ভব ঋণ থেকে দূরে থাকা কর্তব্য। অগত্যা নিরুপায় হয়ে ঋণ নিলে সময়মতো তা পরিশোধ করে দিতে হবে। ঋণ পরিশোধে টাল-বাহানা বা ধোঁকা প্রতারণা করলে, তা তার জন্য বিরাট আজাব ও গজবের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

ঋণ পরিশোধে টাল-বাহানা করা মুনাফিকের লক্ষণ। আর সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ না করে মারা গেলে, পরকালে এ কারণে নিজের নেকী ঋণদাতা কে দিয়ে দিতে হবে। যদি তার নেকী না থাকে, তাহলে ঋণদাতার গুনাহ নিজের ঘাড়ে নিতে হবে। এমনকি কোনো ব্যক্তি যদি ঋণ রেখে মারা যান তবে তার রেখে যাওয়া সম্পদ থেকে আগে ঋণ পরিশোধ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ঋণ পরিশোধের পর সম্পদ থাকলে তা উত্তরাধিকারদের মধ্যে বণ্টন করতে হবে। আগে ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘দ্রুততার সঙ্গে কাজ করার প্রবণতা শয়তানের পক্ষ থেকে সৃষ্ট। তবে পাঁচটি ক্ষেত্র ব্যতিত। অর্থাৎ পাঁচটি কাজ দ্রুততার সঙ্গে করতে হয়। আর তাহলো- ১) মেয়ে বয়প্রাপ্ত হলে তাকে বিবাহ দেওয়ার ব্যবস্থা করা। ২) মেয়াদ এসে গেলে ঋণ পরিশোধ করা। ৩) কেউ মৃত্যুবরণ করলে তার দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা। ৪) মেহমান এলে তাকে আপ্যায়ন করা। ৫) গোনাহ হয়ে গেলে তাওবা করা।

হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, একদা নবী করীম (সাঃ) এর নিকট জানাযা আনা হলো, যেন তিনি জানাযার নামায পড়ান। অতঃপর নবীজি (সাঃ) বললেন, ‘তার উপর ঋণ আছে কী?’ লোকেরা বলল, ‘হ্যাঁ’। রাসুল (সাঃ) বললেন, ‘জিবরাইল (আঃ) আমাকে যার উপর ঋণ রয়েছে তার জানাযা পড়াতে নিষেধ করেছেন।’ হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঋণ পরিশোধ করার ইচ্ছা নিয়ে কারো কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে, আল্লাহ তায়ালা তার ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করে দেন। আর যে ব্যক্তি ঋণ আত্মসাৎ করার মনোভাব নিয়ে কারো কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে, আল্লাহ তায়ালা তাকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করেন, (বুখারী)।’

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রায়ই এই দু’আ করতেন- ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট গুনাহ ও ঋণ থেকে পানাহ চাচ্ছি।’ তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো যে, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি ঋণগ্রস্ততা থেকে বেশী বেশী পানাহ চান, এর কারণ কী? উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন- ‘মানুষ যখন ঋণগ্রস্ত হয়, তখন সে কথা বলতে গিয়ে মিথ্যা বলে এবং ওয়াদা করলে তার খিলাফ করে। (সুনানে নাসায়ী)।’

হযরত শুহাইব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কারো নিকট থেকে ঋণ নেয় এমতাবস্থায় যে, সেই ঋণ পরিশোধ করার তার কোন ইচ্ছা নেই, তবে সে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলার নিকট সাক্ষাত করবে চোর হয়ে। (সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম)।’

হযরত আবু মুসা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেন, ‘নিষিদ্ধ কবীরা গুনাহের পর বড় শুনাহ হলো, কোন ব্যক্তি ঋণী হয়ে মৃত্যুবরণ করা এবং মৃত্যু পর এ পরিমাণ সম্পদ রেখে না যাওয়া-যা দ্বারা সেই ঋণ পরিশোধ করা যায় (সুনানে আবু দাউদ)।’

হযরত শুহাইব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি (বিবাহের সময়) স্ত্রীর মোহর নির্ধারণ করেছে সত্য, কিন্তু সেই মোহর আদায় করার নিয়ত ছিল না, তবে সে ব্যক্তি যেদিন মরবে, ব্যভিচারী হয়ে মরবে। আর যে ব্যক্তি কোন ঋণ নিয়েছে, কিন্তু নিয়ত ছিল না-উক্ত ঋণ সে আদায় করবে, তবে সে ব্যক্তি আত্মসাৎকারী হয়ে মরবে এবং তাদের উভয়ের ঠিকানা হবে জাহান্নাম।’

উল্লেখিত হাদিস সমূহের দ্বারা ঋণের কঠিন দায়বদ্ধতা ও ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে জানা গেল। তাই পারতপক্ষে ঋণ না নেয়াই কর্তব্য। আর একান্ত নিরুপায় হয়ে ঋণ গ্রহণ করলে তা যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি পরিশোধ করে দিতে হবে। আল্লাহ তায়ালা সকলকে সুদ ও ঋণ মুক্ত জীবন যাপন করার তাওফিক দান করুন, আমীন।

লেখক : প্রধান শিক্ষক, পশ্চিম বানিয়াখামার দারুল কুরআন বহুমুখী মাদ্রাসা।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন