খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কেডিএ) ময়ূরী আবাসিক প্রকল্পে প্লট ভাগ বাটোয়ারা করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করেছেন আওয়ামী লীগ নেতা, মন্ত্রী, এমপি ও সরকারের কর্মকর্তারা। প্রথম দফাতে সংরক্ষিত কোটার নামে খুলনার সংসদীয় আসনগুলোর এমপি, মন্ত্রী, সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদসহ আওয়ামী লীগের ৭৯ জন আস্থাভাজন ব্যক্তি প্লট পান।
২০২০ ও ২০২২ সালে দুই দফায় কোনো ধরনের বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই আবাসিক প্রকল্পের কোটি টাকা মূল্যের ৪৭টি প্লট আওয়ামী লীগ নেতা, মন্ত্রী, এমপি ও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা ভাগ করে নেন। এসব প্লটে অনিয়মের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এরই মধ্যে সরকারের কিছু কর্মকর্তা প্লট বিক্রি করে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তবে নিয়ম না মানায় সাংবাদিক ফারজানা রূপা এবং সাবেক এমপি গ্লোরিয়া সরকার ঝর্ণার প্লট বাতিলের উদ্যোগ নিয়েছে কেডিএ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এখনও সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের নামে কোটি টাকা মূল্যের প্লটগুলো বহাল রয়েছে। অনিয়মের মাধ্যমে বরাদ্দ হওয়া প্লটগুলোর বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কেডিএর বর্তমান সদস্য (এস্টেট) ইকবাল হোসেন, সচিব মো. বদিউজ্জামানও একই কায়দায় প্লট হাতিয়েছেন। মূলত প্লট পাওয়া কর্মকর্তাদের বাঁচাতেই অনিয়মের মাধ্যমে পাওয়া প্লটগুলোর বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
কেডিএ থেকে জানা গেছে, গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে ময়ূরী আবাসিক প্রকল্পের প্লট বিক্রির আবেদন শুরু হয় ২০১৫ সালের ১৬ আগস্ট, চলে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত। আবেদন জমা পড়ে ২ হাজার ৩৬০টি। আবেদনের সময় ৩ কাঠার ক্ষেত্রে দেড় লাখ এবং ৫ কাঠার প্লটের ক্ষেত্রে আড়াই লাখ টাকা জামানত নেওয়া হয়। এই টাকা প্রায় ৯ মাস ব্যাংকে রেখে সুদ তুলেছিল কেডিএ। ২০১৬ সালে প্লট বরাদ্দ দেওয়া শুরু হয়। ২০১৯ সাল পর্যন্ত কয়েক ধাপে মোট ৬২৯ প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়।
সূত্রটি জানায়, ২০২০ সালে প্রকল্পের অবকাঠামোর কাজ শেষ হলে বেশ কিছু প্লট ফাঁকা পাওয়া যায়। নিয়ম অনুযায়ী, আবেদনকারীদের মধ্য থেকে ওই প্লট বরাদ্দ দেওয়ার কথা থাকলেও সেই নিয়ম মানা হয়নি। ওই বছর ৩২টি প্লট আওয়ামী লীগ নেতা ও কেডিএ কর্মকর্তারা ভাগ করে নেন। বিষয়টি নিয়ে যাতে কেউ আপত্তি না তোলে এজন্য তৎকালীন পূর্তমন্ত্রীর এপিএস, উপ-সচিব, দুদক সচিবসহ সরকারের জেষ্ঠ্য কর্মকর্তাদেরও প্লট দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখেন কেডিএর তৎকালীন পরিচালক ড. শাহানুর আলম ও পরিচালক (এস্টেট) ছাদেকুর রহমান।
তাদের সঙ্গে ওই সময় প্লট নিয়েছিলেন সাবেক এমপি গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার, পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক সাইফুর রহমান খান, দুদকের সাবেক সচিব ড. মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, ডিআইজি হাফিজুর রহমান, পূর্ত (অডিট) বিভাগের মহাপরিচালক আনিচুর রহমান, সাবেক বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব।
পরবর্তীতে ২০২২ সালে আরেক দফা প্লট ভাগাভাগি হয়। ওই সময় সাবেক এমপি আকতারুজ্জামান বাবু, সাবেক এমপি রুনু রেজা ও ৩ স্বজন, কেডিএর বর্তমান সচিব, পূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপসচিব নায়লা আহমেদ, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমডিএ বাবুল রানাসহ কয়েকজন।
প্লট বাগাতে ইচ্ছামতো নিয়ম তৈরি
কেডিএর প্লট বরাদ্দের বিবরণী পূর্ত মন্ত্রণালয়ে অনুমোদন হয় ২০১৪ সালের ৩০ জুন। সেখানে ৩ কাঠা প্লটের কাঠাপ্রতি দর ছিল ৯ লাখ এবং ৫ কাঠা প্লটের কাঠাপ্রতি দর ছিল সাড়ে ৯ লাখ টাকা।
২০১৫ সালের ১৮ আগস্টের কেডিএর ৫৩২তম বোর্ড সভায় প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারীদের প্লট বরাদ্দ নীতিমালা অনুমোদন হয়। ওই নীতিমালায় বলা হয়, প্রেষণে আসা কর্মকর্তাদের চাকরির মেয়াদ এক বছর পূর্ণ হলে তারা কর্মকর্তা কোটায় আবেদন করতে পারবেন। পরে ছয় মাসের মধ্যেই এই নিয়ম বদলে ফেলেন তৎকালীন কর্মকর্তারা।
২০১৬ সালের ১৩ মার্চ অনুষ্ঠিত বোর্ড সভায় প্রেষণে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে ‘চাকরিকাল এক বছর পূর্ণ’ হলে এর স্থলে ‘চাকরিরত অবস্থায় থাকলে’ সংযোজন করা হয়। এর মাধ্যমে কেডিএতে প্রেষণে এলেই প্লট নিশ্চিত হয়।
এরপর কর্মকর্তারা হাত দেন কম দামে পাওয়ার দিকে। ২০১৭ সালের নভেম্বরে প্রকল্পের ডিপিপি সংশোধনের সময় অন্যদের জন্য ৯ লাখ টাকা মূল্যে হলেও কেডিএ কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বোর্ড সদস্যদের জন্য কাঠাপ্রতি মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৫ লাখ টাকা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কম দামে প্লট বরাদ্দের সুযোগ নিতে কেডিএতে প্রেষণে বদলি হয়ে আসেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। প্লট বরাদ্দ ও রেজিস্ট্রি হওয়ার পর তারা চলেও যান। প্লট বরাদ্দ শুরুর পর থেকে শুধু কেডিএর সচিব পদে এসেই প্লট বাগিয়েছেন ৫ জন। পরিচালক (এস্টেট) হিসেবে প্রেষণে এসে নিয়েছেন দু’জন। আর বোর্ড সদস্য হিসেবে প্লট নিয়েছেন ৮ জন।
প্লট বরাদ্দের নীতিমালায় রয়েছে, প্লট বরাদ্দের আগে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আবেদন চাইতে হবে। সেই আবেদন বৈষয়িক শাখায় যাচাই-বাছাই হয়ে কেডিএর প্লট বরাদ্দ কমিটির সভায় তোলা হবে। সুপারিশ সভায় উত্থাপন হলে বোর্ড সিদ্ধান্ত নেবে।
আগের প্লট বরাদ্দের ক্ষেত্রে নিয়মগুলো মানা হলেও শেষ ১৫টির ক্ষেত্রে এর কিছুই মানা হয়নি। ২০২২ সালের ২৪ মে বোর্ড সভার আলোচ্যসূচিতেও প্লট বরাদ্দের বিষয়টি ছিল না। সভায় বিবিধ বিষয়ে প্রস্তাব তুলে ১৫টি প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়।
সংরক্ষিত কোটার নামে প্লট নিয়েছেন যারা
আবাসন প্রকল্পটিতে পূর্ত মন্ত্রীর জন্য সংরক্ষিত কোটায় প্লট নিয়েছেন ৭৯ জন। তাদের মধ্যে ৫ কাঠার প্লট নিয়েছেন কেসিসির অপসারিত মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক, তার ভাই আবদুল জলিল তালুকদার, সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান, সাবেক ভূমিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ, প্রয়াত এমপি মোস্তফা রশিদী সুজা, সাবেক এমপি কবিরুল হক মুক্তি, মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম, খালিশপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম বাশার, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদীন রশিদী সুকর্ন এবং ফুলতলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আকরাম হোসেন।
সংরক্ষিত কোটায় তিন কাঠার প্লট পান জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শরফুদ্দিন বিশ্বাস বাচ্চু, ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ ও তার ভাই খালেকুজ্জামান, মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি শাহজালাল হোসেন সুজন এবং সদর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম।
কেডিএর বৈষয়িক বিভাগের বেশিরভাগ কর্মকর্তা নতুন যোগ দিয়েছেন। পুরাতন প্লট ভাগ বাটোয়ারার বিষয়ে তারা কেউই কোনো তথ্য দিতে পারেননি।
কেডিএর সিনিয়র বৈষয়িক কর্মকর্তা আবদুল্লাহ কবি সাদ জানান, প্লট নিয়ে কোনো তদন্তের বিষয়ে কোনো চিঠি পাইনি। অডিটে ফারজানা রূপার আয় সনদ জাল এবং গ্লোরিয়া ঝর্ণা নির্ধারিত সময়ে টাকা পরিশোধ না করায় তাদের প্লট দু’টি বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।
খুলনা নাগরিক নেতারা বলেন, জনগণের টাকায় প্রকল্প তৈরি করে কিভাবে লুটপাট হয় তার উদাহরণ ময়ূরী প্রকল্প। অবিলম্বে তদন্ত করে অনিয়মের মাধ্যমে নেওয়া প্লট বাতিল ও জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা করা উচিত।
খুলনা গেজেট/এনএম

