ব্রিটিশ ভারত আমলে অবিভক্ত ভারতে তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একটি অবিস্মরণীয় উক্তি, কারণে অকারণে আমাদের দেশের রাজনীতির দিকে তাকিয়ে বারবার মনে পড়ে। মহান নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উক্তি : ‘গণতন্ত্রের প্রশ্নে জনগণের রায়-ই শেষ কথা।’ কথাটি বিশ্লেষণ করলে এমনটি দাঁড়ায়, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোয় সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে জনগণ গোপন ব্যালটের মাধ্যমে রায় দিয়ে তার যোগ্য প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করবে। জনগণের নিরঙ্কুশ রায় অর্জন করে, জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে, শাসক নয় গণমানুষের সেবক হিসেবে নির্বাচিতরা রাষ্ট্র পরিচালনা করবে।
অথচ নির্মম বাস্তবতা, আমরা কি লক্ষ্য করলাম! ১৯৭১ এর ২৬শে মার্চ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের নয় মাস পর কঠিন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আমরা প্রিয় মাতৃভূমি হানাদারমুক্ত করলাম, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করলাম। এই অঞ্চলের গণমানুষের আশা-আকাঙ্খা ছিল এবার নাগরিক হিসেবে আমার মৌলিক অধিকারগুলো আর কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না। কোন জল্লাদ শাসক আর বাংলাদেশের মানুষকে বৈষম্যের জিঞ্জিরে আটকাতে পারবে না।
১৯৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বর কাগজে কলমে আমরা বিজয় অর্জন করলাম ঠিকই, কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেছে, কীসের বিজয়, কার বিজয়? নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে অসংখ্য তাজা প্রাণ বলি হলো, অকাতরে অসংখ্য মানুষ জীবন দিল, আমরা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর জুলুমের শিকার হলাম, বছরের পর বছর। শেষে যে বিজয় পেলাম এটা কার বিজয়?
কারণ, ৯৩ হাজার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, যুদ্ধ বন্দী সৈনিক আত্মসমর্পণ করল সম্মিলিত বাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরার কাছে! এরকমটাই কি কথা ছিল? মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল (পরে জেনারেল) এমএজি ওসমানী যুদ্ধ শেষে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে কোথায় হারিয়ে গেল? যিনি গোটা নয় মাস যুদ্ধ অঙ্গন চরিয়ে বেড়িয়েছেন? মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের দিন রেসকোর্স ময়দানে আতাউল গনি ওসমানীর না থাকাটা ছিল ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী ষড়যন্ত্রের একটি অংশ। প্রশ্ন ওঠে, কেন ওসমানীর হেলিকপ্টারে গুলিবর্ষণ করা হলো? ঐদিন কারা এটা করেছিল? এ প্রশ্নের জবাব বাংলাদেশের গণমানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে অনেককাল, কে দেবে এর জবাব?
ঘটনার এখানেই শেষ নয়, মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষরের সময় দাদাগিরি করা হলো, পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান জেনারেল এএকে নিয়াজী আত্মসমর্পণ দলিলে সই করেন, ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল অরোরার কাছে। কি বিচিত্র বিস্ময়। মুক্তিযুদ্ধ করলো বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, অথচ সালেন্ডার দলিলে সই করার সময় দেখানো হলো ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তান ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে! আমাদের মুক্তিযুদ্ধটা তাহলে কে বা কারা ছিনতাই করলো? এ প্রশ্নটি বাংলাদেশের জাতিসত্তার সাধারণ নাগরিক হিসেবে মনে জাগা স্বাভাবিক। কেন এমনটি হলো, মুক্তিযুদ্ধের শেষ লগ্নে ১৯৭১এর ৩ ডিসেম্বর পাক বাহিনী অতর্কিতে ভারতের উপর বিমান হামলা চালায়। ঠিক সেই সময়, ভারত তার নীলনকশা অনুসারে ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ১৫ ডিসেম্বর মাত্র ১৩ দিন সম্মিলিত বাহিনী হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধ করে, চাণক্যবাদী ভারত যুদ্ধের সমস্ত ফসল, শেষমেষ সমস্ত তৎপরতা, তুলে নিল নিজেদের অনুকূলে।
অথচ প্রকৃত সত্য এই বাংলাদেশের প্রতিটি ঘর তখন দুর্গে পরিণত হয়েছিল, বাংলাদেশের ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) মুক্তিবাহিনী বাংলার ঘরে ঘরে গড়ে তুলেছিল দুর্ভেদ্য দুর্গ। অথচ বিশ্বের কাছে ওই ১৩ দিন যুদ্ধে ভারত পিছনে থেকে অংশ নিয়ে দেখালো সমস্ত কৃতিত্ব যেন তাদের। আর যারা সম্মুখ সমরে সাহসীভাবে যুদ্ধ করলো, তারা রয়ে গেল অগোচরে।
যে কথা বলছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের লুকোচুরি সেই ইতিহাস নতুন প্রজন্ম খুব একটা জানে না। সেজন্য কিছু কিছু বয়ান জরুরি। তাজউদ্দীন আহমেদের মেয়ে সিমি হোসেন রিমি তাঁর ‘নেতা ও পিতা’ বইতে যা লিখেছেন, তা শুনলে নতুন প্রজন্মের মুজিব ভক্তদের পিলে চমকে উঠবে!
সিমি হোসেন রিমি লিখেছেন, ‘২৫শে মার্চ প্রথম রাতে শেখ মুজিব কল্পনাও করেননি ২৫শে মার্চ রাত কালরাত হিসেবে অপারেশন সার্চলাইট এর মাধ্যমে বাংলাদেশের গণমানুষকে পাইকারিহারে পাকবাহিনী হত্যা করবে। শেখ মুজিব ঐ রাত্রে তাজউদ্দীন আহমেদকে বলেন, যা যা বাসায় ফিরে যা, আজ সব আলোচনা ভেস্তে গেছে, ২৭ শে মার্চ হরতাল ডেকে দিস।’
‘তাজউদ্দীন আহমেদ অনেক অনুনয় বিনয় করে বললেন, মুজিব ভাই, আপনি স্বাধীনতার ঘোষণাটা দিয়ে দেন, উনি কোনোমতেই রাজি হলেন না। উনি মনে মনে প্রস্তুত থাকলেন, পাক সরকার তাকে গ্রেফতার করবে, তিনি পরে পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন। অথচ মুজিব জানতেন না, ২৫ শে মার্চ রাত্রে অভাবনীয় এক ম্যাসাকার হতে যাচ্ছে, গণহত্যা পরিকল্পনা করেছে পাকিস্তান বাহিনী।’
‘১৯৭১এর ২৫ মার্চ রাতে প্রথম প্রহরে বাঙালি পুলিশ মিলিটারি প্রত্যেককে নিরস্ত্র করা হয়, অনেকেই বুঝে ফেলে এরপর কি হতে যাচ্ছে, বহু জায়গা থেকে শেখ মুজিবকে জানানো সত্ত্বেও তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে রাজি হননি। তাজউদ্দীন টু ইন ওয়ান (রেডিয়ো) নিয়ে অনেক অনুনয়-বিনয় করে ফিরে গেলেন শেখ মুজিবের কাছ থেকে, কোন ঘোষণা আদায় করতে পারলেন না।’
একটু পূর্বের ইতিহাস বলি, ‘১৯৭১ এর ২৫ শে মার্চ বিকাল পর্যন্ত জুলফিকার আলী ভুট্টো, সামরিক প্রধান ইয়াহিয়া খান, শেখ মুজিব বৈঠক হয়, অবশেষে আলোচনা নিষ্ফল হয়। আলোচনা শুরু হয় ১৬ ই মার্চ থেকে। ঢাকার হোটেল শেরাটনে আলোচনা ভেস্তে যাবার পর বিমর্ষভাবে মুজিব ঘরে ফিরে আসেন। আমরা তখন সংগ্রামের সাথে সম্পৃক্ত। দেশবাসীকে জানালেন সব আলোচনা নিষ্ফল হয়েছে অথচ তিনি সাড়ে সাত কোটি মানুষের জীবন রক্ষা সম্পদ রক্ষা অস্তিত্ব রক্ষার কোন প্রস্তুতি নিলেন না। ২৫ শে মার্চ বিকেলে ইত্তেফাক, হলিডে পত্রিকার টেলিগ্রাম সংখ্যা বের হয়, তাতেই স্পষ্ট হয় কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। ষড়যন্ত্র স্পষ্ট হয়, ২৫ শে মার্চ ১৯৭১ মধ্যরাতে।’
মার্চের গোড়ার দিকে, একাত্তরের তেসরা মার্চ যখন ইয়াহিয়া খান কর্তৃক জাতীয় পরিষদের অধিবেশন তারিখ পিছিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়, বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় বাঙালি সংগ্রামী জনতা প্রচণ্ড রোষে ফেটে পড়ে। বাঁশের লাঠি নিয়ে রাজপথে নামে। সবার কণ্ঠে একই স্লোগান :- ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’। ‘পিণ্ডি না ঢাকা, ঢাকা, ঢাকা’। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। তারপরের ইতিহাস সাতই মার্চের ইতিহাস। চার, পাঁচ, ছয় মার্চ ১৯৭১ অনেক রক্ত ঝরে। ৭ই মার্চ শেখ মুজিব বক্তব্য দেন। কিন্তু কোনোভাবেই পুরো বাংলাদেশকে স্বাধীন বলে কোন স্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া হয়নি। এমনকি পঁচিশে মার্চ রাতেও না। কেউ এর প্রমাণ দিতে পারবে না। সত্তরের সাতই ডিসেম্বর জনগণ যে রায় দেয় কার উপর ভিত্তি করে শেখ মুজিব দেশে এসে বাহাত্তরের ১০ই জানুয়ারির পর নিজে প্রধানমন্ত্রী হয়ে দেশের দায়িত্ব নেন। কোথায় গণতন্ত্র কোথায় ন্যায়বিচার। নিজেই মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন কোন নির্বাচনেরও প্রয়োজন হয়নি।
যে প্রশ্ন নিয়ে শুরু করেছিলাম, সোহরাওয়ার্দির গণতন্ত্র ছিল জনগণের রায়ই শেষ কথা। আর শেখ মুজিব একনায়কতন্ত্রের মাধ্যমে ১৯৭৩ এ মার্চে যে নির্বাচন দেন তা ছিল ব্যালট প্রতারণার নির্বাচন। যারা নিজের দলের শেষ পর্যন্ত ব্যালট কেটে বিজয়ী ঘোষণার পরও পরাজিত হন তাদেরকে হেলিকপ্টারে গিয়ে ব্যালট পেপার সিল দিয়ে এনে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। পাশের দেশের লুটপাট বাহিনী আর বাংলাদেশের সরকার দলীয় বাহিনী মিলে যখন দেশটাকে তলাছেঁড়া ঝুড়িতে পরিণত করেন, তখন দেশে গণ-দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। শেখ মুজিব ৪,৩০০ নোঙ্গরখানা খোলার নির্দেশ দেন। সেখানেও তার দলীয় লোকদের মাধ্যমে রুটি বিতরণ করা হতো। কতজন যুবতী যে সম্ভ্রম হারালো। তাও টাইমস গার্ডিয়ান পত্রিকায় লিপিবদ্ধ আছে। পাকিস্তানি সৈন্যরা মুজিব ইন্দিরা কৌশলী ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ১৯৫ জন হাইপ্রোফাইল যুদ্ধবন্দীসহ ভারত পাকিস্তান সিমলা চুক্তির মাধ্যমে সকল পাকিস্তানি সৈন্য ফেরত যায়। একজনেরও বিচার করা সম্ভব হয়নি। অথচ বাংলাদেশে যুদ্ধ অপরাধের জন্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ, মীর কাসেম আলী, কামরুজ্জামান এদেরকে ফাঁসি দেয়া হয়।
এখন প্রশ্ন, গণতন্ত্র মানে ‘আপনি বলেন আমাকেও বলতে দেন।’ অথচ হাসিনার আমলে এখানে বিষয়টি সেভাবে দেখা হয়নি। পাশের দেশের প্রেসক্রিপশনে কাজগুলো হাসিল করা হয়েছে। ২৪ এর গণ-অভ্যুত্থানের পর জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, সত্যিই কি ২০০৮ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বিচিত্র গণতন্ত্রের কুৎসিত নায়িকা শেখ হাসিনা ২০০০ তরুণকে নির্বিচারে হত্যা করে, প্রায় এক হাজার জনকে চোখে গুলি করে অন্ধ করে, বিশ হাজার তরুণকে পঙ্গু করে পালিয়ে পার পেয়ে যাবে? হাসিনার গণতন্ত্রের সাথে বাংলাদেশের বর্তমান নেতৃত্বে যারা আছেন তাদের বেশ কয়েকটি দলের বক্তব্যে কোন অসংগতি না থাকায় কথাগুলো বলতে হলো। সংবিধান বাতিলের প্রশ্ন, দেশে হাসিনা যুগের অপরাধীদের বিচারের প্রশ্ন, লুটেরাদের মালামাল ফিরিয়ে আনার প্রশ্ন, এসব গুলি উপেক্ষা করে, যারা নির্বাচন নির্বাচন রব উঠাচ্ছেন, তাদের কাছে প্রশ্ন, নির্বাচন যদি সত্যিই করতে হয়, তাহলে তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করা হোক। যে জনগণ দেশের মন্ত্রিপরিষদের নেতৃত্বের ভাগ্য নির্ধারণ করবে তাদের স্থানীয় নেতৃত্ব গড়ে তুলতে আগেই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন করতে দিন। কারণ, আব্রাহাম লিংকনের গেটিস বার্গের বক্তৃতার সেই অবিস্মরণীয় উক্তি :“I am by the people to people for the people”
আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দের সত্যিই যদি দেশের আপামর মানুষের প্রতি দরদ থাকে তাহলে আসুন আমরা তৃণমূল পর্যায় থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে জনরায় কার অনুকূলে আসে, তার জন্য অপেক্ষা করি।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
খুলনা গেজেট/এনএম

