বৃহস্পতিবার । ২রা অক্টোবর, ২০২৫ । ১৭ই আশ্বিন, ১৪৩২

মানব সেবায় বিরল দৃষ্টান্ত

আবদুল কাদের খান

২০২৪ এর ৩৬শে জুলাই, বিপ্লব পরবর্তী বিধ্বস্ত বাংলাদেশটাকে পতিত সরকার প্রধান শেখ হাসিনা ”Bottomless basket’ অর্থাৎ ‘তলাছেঁড়া ঝুড়ির’ মতো করে রেখে গণঅভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে গেছে। এখন পুরো দেশটির সর্বত্র হতাশা-নৈরাজ্য এবং আতঙ্ক ও বিপন্নতার ছায়া বিরাজ করছে।

এমনি উদ্বেগজনক উদ্ভিন্ন পরিস্থিতির মধ্যে হঠাৎ করে ‘পজিটিভ বাংলাদেশ’ (‘positive Bangladesh’)-এর একটি খবর পড়ে মনটা বেশ আনন্দিত, উদ্বেলিত হলো।

‘খুলনা গেজেট’ পত্রিকার শেষ পাতায় সিঙ্গেল কলাম-এ প্রকাশিত সংবাদ। শিরোনাম : ‘দুই টাকার হাসি।’ ঝিনাইদহের প্রগতিস্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের এটি ছিল ২১ তম আয়োজন। যে মুহূর্তে বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশে ‘লোভীর নিষ্ঠুর লোভ বঞ্চিতের ক্ষোভ’ সবকিছু গ্রাস করে ফেলেছে, সবকিছু ধ্বংস করে দেশটাকে ফোকলা করে দিয়েছে —দয়া, মানবতা, দুস্থ জনে সেবা’র সব দ্বার এক এক করে বন্ধ হয়ে গেছে, ঠিক সে সময়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলীয় জেলা ঝিনাইদহে একটি মানবসেবী সংগঠনের এ ধরনের কার্যক্রম যথেষ্ট প্রশংসনীয়।

‘দুই টাকার হাসি’ খবরটি থেকে জানা যায়, ঝিনাইদহের ওই সংগঠনের একুশতম আয়োজন হিসেবে সমাজের ছিন্নমূল অনিকেত বাসিন্দাদের অর্থাৎ গরিব অসহায় ক্ষুধার্ত বুভুক্ষু মানুষের জন্য এক ব্যতিক্রমী আয়োজন -‘দুই টাকার হাসি’। এই সংগঠনের উদ্যোগে ইতোপূর্বে আরও বিশ বার এ ধরনের উৎসব হয়েছে। নাম পরিচিতিহীন সমাজের ভাসমান ভিক্ষুক ছিন্নমূলদের নিয়ে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে, যাদের তিন বেলা খাবার জোটে না, ওরাই ছিল এ অনুষ্ঠানের সম্মানিত মেহমান।

‘খুলনা গেজেট’ এর ঝিনাইদহ নিজস্ব প্রতিবেদক পরিবেশিত দুই টাকার হাসি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ শুক্রবার জুম্মাবাদ ঝিনাইদহের প্রগতিস্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এ ভিন্ন ধর্মী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। শহরের পুরাতন ডিসি কোর্ট উন্মুক্ত চত্বরে মাত্র ২ টাকার বিনিময়ে ঝিনাইদহের বিভিন্ন দূর অঞ্চল থেকে আসা সুবিধা বঞ্চিত, অসহায়, দুস্থ দরিদ্র অর্ধশতাধিক নারী পুরুষ ছিল এ অনুষ্ঠানের সম্মানিত মেহমান। মাত্র ২ টাকার বিনিময়ে তাদেরকে ডাল ভাত এবং মাংস খাওয়ানো হয়। প্রতি মাসে একবার মাত্র অর্থাৎ একবেলা দুই টাকার বিনিময়ে ওরা পেট চুক্তি খাবার খেয়ে থাকেন। যেসব ছিন্নমূল মানুষ এই দুই টাকার হাসি অনুষ্ঠানে অংশ নেয়, তাদের মধ্যে অন্যতম ভিক্ষুক বিলকিস বেগম জানান, এ সময় হোটেলে যেনতেনো প্রকার এক প্লেট ভাত ৩০ টাকা, এক প্লেট খিচুড়ি ৫০ টাকা ; সেখানে মাত্র ২ টাকায় প্রত্যেককে পেটপুরে খাওয়ানো এই জামানায় দারুণ অবিশ্বাস্য, বিস্ময়কর ব্যাপার। ওই অনুষ্ঠানের অপর এক মেহমান দরিদ্র রিক্সাচালক রহমত আলী জানান, মাত্র ২ টাকায় পেট পুরে খাওয়ার জন্য ভাত ডাল মাংস পেয়ে সুবিধাবঞ্চিত হতভাগা মানুষেরা এক বেলা খাবার খেয়ে, তুলছেন তৃপ্তির ঢেকুর!

অনুষ্ঠানের আয়োজক ওই সংগঠনের সভাপতি সাজেদ মাহমুদের সাথে কথা বলে প্রতিবেদক জেনেছেন, ২০২১ সালে তারা এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করলেও ২০২৪ সাল থেকে নিয়মিত প্রতি মাসে একদিন এক বেলা করে ছিন্নমূল মানুষের জন্য পেটপূর্তি খাবার তুলে দেওয়ার রেওয়াজ চালু করেছে। কেউ যাতে সংকোচ বোধ না করে বা ইতস্তত না করে, বিনা পয়সায় খাওয়া! সেই জন্য নামমাত্র দুই টাকার বিনিময়ে আগত মেহমানদের পেট পুরে খাবার পরিবেশন করা হয়। তারা যেন মনে করে তারা খাবারটি কিনে খাচ্ছেন। উপরের বর্ণনাটি একটি কাল্পনিক গল্পের মত মনে হলেও এটাই ঝিনাইদহের কতিপয় যুবক তাদের সংগঠন এর মাধ্যমে করে দেখিয়েছেন। সংগঠনের বয়স পাঁচ বছর হলেও দুই বছর যাবত অর্থাৎ ২৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২১ বার এ ধরনের স্বল্প টাকায় খাবার অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন।

বলাবাহুল্য, আমাদের দেশের সমাজে- সংসারে বহু ধনাঢ্য ব্যক্তি আছেন। যেখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, তাদের কোটি কোটি টাকার অঢেল সম্পদ সম্পত্তি। তারা প্রতিদিনের বিলাস ব্যাসনে লাখ লাখ টাকা খরচের মাধ্যমে অপচয় করছেন, কিন্তু পাথরের মত কঠিন হৃদয়ের এইসব বিত্তবান মানুষ একবারও অসচ্ছলতার অন্ধকারে ডুবে থাকা ভ্রাম্যমান পথো ভিক্ষুক, কপর্দক শূন্য মানুষের দিকে –দিনে, সপ্তাহে, মাসে কিম্বা বছরে ভুলে একবারও ফিরে তাকায় না। এটাই সমাজের দেশের জন্য পরিহাস!
ঝিনাইদহে প্রগতি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মহৎ হৃদয়ের যুবকেরা যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা’ সত্যিই মানবতার আকাল চলা এ বাংলাদেশে ব্যতিক্রমী বিরল ঘটনা বলতে হবে।

বলতে দারুণ লজ্জা করছে। তবুও না বলে পারছি না। সমাজের উচু তলার মানুষদের নোংরা মনোবৃত্তির কথা। ওরা উচ্ছিষ্ট যা ফেলে দেয় ডাস্টবিনে, সেখানে লড়াই করে ক্ষুধার্ত মানুষ আর কুকুরে আহার করে। কি বিচিত্র এক দেশ! নাম বাংলাদেশ।

তথাকথিত কতিপয় বিত্তশালী প্রথম জীবনে দেশের গ্রাম অঞ্চলে জন্মেছেন। এলাকায় সুদ মহাজন, ভূমি দস্যুতা, চাঁদাবাজি করে বিত্ত সম্পদ সৃষ্টি করে। বিপুল বিত্ত বৈভবের মালিক হয়ে শহরে এসে গ্রাম থেকে অসদুপায়ে অর্জিত পাহাড় সমান টাকার এই মালিকেরা জমি জায়গা ক্রয় করে, চোখ ধাঁধানো বাড়িঘর দালানকোঠা নির্মাণ করে, শহুরে বাসিন্দা হিসেবে বসবাস করছেন। আবার গ্রামেও তাদের প্রভাব বলয় বিস্তৃত রয়েছে। ওরা শহরের পরিবেশে খানদানি ব্যক্তি বা সাহেব বনে গেছেন। এরা গ্রামের মানুষের রক্ত চুষে, সর্বস্ব লুণ্ঠন করে, শহরে এসে তথাকথিত ভদ্র পাড়ার নাগরিক হয়েছেন! মজার ব্যাপার, গ্রাম অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তাদের বহু রক্তের আত্মীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী। ওদের দুঃসময়ে ওদের জন্য এই শহুরে ভদ্রলোকদের মানবিক কোনো দায় দেনা নেই। তাই অনেক চশমখোর, চামার ভদ্রলোক তাদের আকাশ ছোঁয়া বাড়ির সিংহদ্বারে অর্থাৎ গেটে ছোট্ট প্লেটে লিখে দেন —
‘কুকুর হইতে সাবধান’!

প্রাসাদোপম বহুতলা বিশিষ্ট অট্টালিকার প্রবেশদ্বারে এই প্লেটটি টানিয়ে দিয়ে বোঝানো হয়, বাড়িতে ভয়ানক হিংগ্র কুকুর আছে! যদি কেউ অগত্যা ঢুকে পড়ে, তাহলে তার নসিব (ভাগ্য) খারাপ আছে। যম ও জীবনে টানাটানি হতে পারে। বহিরাগত অতিথি অভ্যাগত নিরীহ মানুষেরা দরজার প্লেটে লেখা কথাগুলো পড়ে সাংঘাতিক আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়ে। সাহস করে কেউ এ বাড়ীর সিংহদ্বার টপকে কোনো দায়-বেদায়-এ ভেতরে ঢুকবার সাহস পায়না। মুহূর্তে তাদের কলিজা (হৃদপিণ্ড) কেঁপে ওঠে। তাতে ওইসব তথাকথিত ভদ্রলোকদের বাড়িতে ভুলে মাছিটিও প্রবেশের চেষ্টা করে না।

সমাজের নিন্দুকেরা বলেন, কুকুরের মত স্বভাবের পেছন অতীতের কলঙ্কিত অপযশ এর নায়ক, দারুণ অর্থ পিশাচ হৃদয়হীন এই নাগরিকেরা আসলে নিজেরাই সারমেয় জীব হিংগ্র কুকুরের চেয়েও নিকৃষ্ট। তাই তারা বিশাল বাড়ির পরিবেশ দ্বারে ওই প্লেট টাঙিয়ে দিয়ে সর্বপ্রকার মানবিক সাহায্য সেবামূলক দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেতে চায়!

সত্যি কথা বলতে কী, নগর জীবনের বিত্তবানদের মধ্যে এমন এক শ্রেণীর বর্ণচোরা স্বার্থগৃধ্নু মানুষের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, যারা সমাজের অসহায় ছিন্নমূল দরিদ্রদের জন্য কখনো কোন কাজে আসে না। আর এই শ্রেণীর দাম্ভিক, স্বার্থপর, স্বেচ্ছাচারী নাগরিকের সংখ্যা শহর নগরে ক্রমশ বেড়েই চলেছে।

পেছনের দিকে একটু ফিরে তাকাই, ২০০৮ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট পর্যন্ত সাড়ে ১৫ বছরে –‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে মানুষের সহায় সম্পদ কুক্ষিগত করেছে এমন নাগরিক এখন দেশের বড় বড় মহানগরীতে অভিজাত এলাকার বাসিন্দা।

আমি কুখ্যাত খুনি, পুলিশ কর্মকর্তার বেশে শেখ হাসিনার লাঠিয়াল বেনজির আহমেদ এবং পলাতক তথাকথিত ভাতের হোটেলের ডিবি হারুন, মুসলিম বিদ্বেষী, ‘র’ এর এজেন্ট পুলিশের ছদ্মবেশে বিপ্লব কুমার সরকার, দারুন সাম্প্রদায়িক পুলিশ কর্মকর্তা প্রলয় কুমার জোদ্দার, পুলিশের এসব কর্মকর্তাদের শিরোমনি পার্শ্ববর্তী বিদেশের মাটিতে বসে ষড়যন্ত্রকারী কুখ্যাত হাবিবুর রহমানের কথা বলছিনা। পুলিশ বিভাগের মূর্তিমান আতঙ্ক খুনি দুশ্চরিত্র লম্পট মেজর রাশেদ মোহাম্মদ খান এর হত্যাকারী ফাঁসির আসামী ওসি প্রদীপের কথা বলছি না। ওদের কথা বলছি না এইজন্য, দেশের মানুষ জেনে গেছে ওরা ছিল খুনি হাসিনার লাঠিয়াল, ইউনিফর্ম পরা দস্যু দুর্বৃত্ত।

আমি বলছি গ্রামাঞ্চলে যারা দুর্বৃত্ত হিসেবে নিজস্ব ‘মাসলম্যানদের’ দিয়ে নিরীহ মানুষের জায়গা জমি দখল করেছে, বিপুল অবৈধ সম্পদের অধিকারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হিসেবে বিশেষ রাজনৈতিক দলের উমেদারী করে অগুনতি অর্থ উপার্জন করে, গ্রামাঞ্চলে ভয়ংকর লুটপাট করে, শহরে নগরে বিশাল বিশাল ইমারত তৈরি করেছে, এইসব পাথুরে হৃদয় মানুষ নামের কুলাঙ্গার এককালে কপর্দকহীন থেকে এখন দেশের বিত্তশালীদের মধ্যে দশ জনের একজন হয়েছে, তাদের কথা বলছি।

ঝিনাইদহের কতিপয় উদার হৃদয়ের অধিকারী যুবকের প্রচেষ্টায় দুস্থ ছিন্নমূল মানুষের মাঝে মাসে অন্তত এক বেলা খাবারের জন্য প্রগতি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি গড়ে উঠেছে। তার সাথে তুলনা করলে, এত বিত্ত-বেসাত এর মালিক এইসব অর্থ পিশাচদের তুলনায় ঝিনাইদহের মানবসেবি এ সংগঠনটি, অনেক এগিয়ে। মানব সেবায় হিমালয় পর্বতের বিশালতা নিয়ে ঝিনাইদহের কতিপয় মানবিক যুবক যা’ করছে, দয়াহীন, রুক্ষ এ সমাজ সংসারে সত্যিই প্রকৃষ্ট এবং বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে রইবে।

(লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট)

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন