রপ্তানি বাড়াতে উৎপাদন বৃদ্ধিতে নজর

একরামুল হোসেন লিপু

খুলনা অঞ্চলের রপ্তানি আয়ের বড় অংশ আসতো কাঁচাপাট ও পাটপণ্য থেকে। দ্বিতীয় অবস্থানে চিংড়ি। গত একদশক ধরে কাঁচাপাট রপ্তানিতে ধস নেমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা, পার্শ্ববর্তী দেশের ভেনামির সহজলভ্যতাসহ নানা কারণে সাদা সোনা খ্যাত চিংড়িরও জৌলুস কমছিল। এমন অবস্থায় চিংড়ির হারানো গৌরব ফেরানোর উদ্যোগ নিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর। তাদের তৎপরতায় বাড়ছে চিংড়ি উৎপাদন।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ৫ বছরে খুলনাঞ্চল থেকে চিংড়ি রপ্তানি করে আয় হয়েছে ১১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। আগামী ৫ বছরের মধ্যে এটা দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা রয়েছে।

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত পাঁচ বছরে খুলনাঞ্চল থেকে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৩৮৮ মেট্রিক টন মৎস্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১৩ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা। এছাড়া গত পাঁচ বছরে ১ লাখ ২ হাজার ৩৩৯ দশমিক ৬২৯ টন চিংড়ি রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১১ হাজার ৩০১ কোটি টাকা।

সূত্র জানায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে খুলনাঞ্চলে মোট চিংড়ি উৎপাদিত হয়েছে ১ লাখ ২৩ হাজার ১৫১ দশমিক ১৭ মেট্রিক টন। এরমধ্যে রপ্তানি হয়েছে ১৯ হাজার ৫১২ মেট্রিক টন। যা থেকে আয় হয়েছে দুই হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে খুলনাঞ্চল হতে চিংড়ি রপ্তানির হার ৪২ দশমিক ১৯ শতাংশ।

মৎস্য অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, চিংড়ি উৎপাদন বৃদ্ধিতে খুলনা মৎস্য অধিদপ্তর বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে দশ হাজার ৭৫০ জন চিংড়ি চাষিকে উন্নত চিংড়ি চাষ বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান, সাড়ে সাত হাজার চাষিকে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি উপকরণ প্রদান, ক্লাস্টার ভিত্তিক চিংড়ি চাষের মাধ্যমে সনাতন চিংড়ি চাষিদের উৎপাদন ২-৫ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা। এছাড়া মাঠ দিবসের মাধ্যমে ক্লাস্টার চিংড়ি চাষীদের ফলাফল প্রদর্শন করার মাধ্যমে অন্যান্য চাষীদের উদ্বুদ্ধ করা, চিংড়ি চাষিদের খামারের বায়োসিকিউরিটি ও হাইজিন নিশ্চিত করার মাধ্যমে গুণগত ও মানসম্মত চিংড়ি উৎপাদনে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করা, থার্ড পার্টি সার্টিফিকেসন অর্জনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির ভালো দাম পাওয়ার বিষয়ে চাষীদের উদ্বুদ্ধ করা প্রভৃতি।

খুলনা বিভাগীয় মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা লিপটন সর্দার বলেন, রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নাই। এক্ষেত্রে চিংড়ির উৎপাদন ও গুণগত মান বৃদ্ধিতে সরকারকে শুধু চিংড়িকে কেন্দ্র করে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণ করা জরুরি। পাশাপাশি সরকারের নীতি নির্ধারণেও চিংড়িকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। চিংড়ি চাষের এলাকা নির্ধারণ বা জোনিং, অবকাঠামো উন্নয়ন, সময়মতো পানি ও রোগমুক্ত পোনা, মানসম্মত খাবারের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। চিংড়ি চাষের ইনপুটস সমূহ (পোনা, খাদ্য, ঔষধ ও খামারে ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থের মান নির্ধারণে) নিয়মিত পরীক্ষণ ও কঠোর মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। চিংড়ি সমৃদ্ধ জেলাসমূহে চিংড়ির উৎপাদন ও মান নিয়ন্ত্রণের জন্য মৎস্য অধিদপ্তরে জনবল বৃদ্ধিতে আলাদা জনবল কাঠামোর ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানো তথা অধিক ফলনশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। চিংড়ির রোগ নির্ণয় ও নিরাময়ে মৎস্য অধিদপ্তরের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। ক্রেতার আস্থা তৈরিতে রপ্তানিকারককে অধিক দায়িত্বশীল হতে হবে এবং চিংড়ির ভ্যালু চেইনের সকল স্তরে কঠোর মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে।

হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিকারকদের সংগঠন ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তরিকুল ইসলাম জহির বলেন, এক সময় খুলনাঞ্চলে ৬৩ টি প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানি ছিল। উৎপাদন ও আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ায় নানা কারণে ৩৩ টি কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যাংকের সুদ ও বিদ্যুতের বিল বেড়ে যাওয়ার পরও কিছু কোম্পানি টিকে আছে। হিমায়িত চিংড়ি শিল্প সম্প্রতি আবারও কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

তিনি বলেন, “চিংড়ি শিল্পকে আরো চাঙ্গা করতে হলে সরকারিভাবে রপ্তানিকারকদের ভর্তুকি দিতে হবে। বিদ্যুৎ ও অন্যান্য উৎপাদন খরচে ভর্তুকি দিতে হবে।

চিংড়ি রপ্তানিকারকদের অভিমত, দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখে চিংড়ি শিল্প। ইউরোপের দেশগুলোতে চিংড়ি ও অন্যান্য মাছের চাহিদা এবং মূল্য কমে গেছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারেও চাহিদা ও মূল্য কমে যাওয়ায় রপ্তানির ওপর প্রভাব পড়েছে। বিদেশের ক্রেতারা সময় মতো মূল্য পরিশোধও করেন না। আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে অনেকেই চিংড়ি রপ্তানি বন্ধ রেখেছিলেন। পাশাপাশি ভাইরাসের কারণেও খুলনাঞ্চলে চিংড়ি উৎপাদন কমেছে। তবে চিংড়ি রপ্তানি বেড়ে যাওয়ায় আশা করা যাচ্ছে উৎপাদনও বাড়বে।

খুলনার চিংড়ি রপ্তানিকারকরা মনে করেন, করোনা পরিস্থিতির ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ভেতরে আবার বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সম্প্রতি কয়েক বছর চিংড়ি শিল্পে অচল অবস্থা তৈরি হয়েছিল। একের পর এক শিপমেন্ট বাতিল হওয়ায় রপ্তানিকারকরা ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়েন। কিন্তু সম্প্রতি কয়েক মাস চিংড়ি রপ্তানি কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এতে নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টরা।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন