নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির ইস্তফার দাবিতে নতুন করে বিক্ষোভ ছড়াল মঙ্গলবার। সোমবার কেউ কেউ এই দাবি তুললেও, মঙ্গলবার তা আরও প্রকট হয়েছে। বিদ্রোহের অভিমুখই এখন হয়ে উঠেছে ওলির ইস্তফার দাবি। নেপালের প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পোড়েলের বাসভবনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন উত্তেজিত জনতা।
বিক্ষুব্ধ ছাত্র-যুবাদের বিদ্রোহের মুখে সোমবার রাতেই সমাজমাধ্যমের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছে নেপাল সরকার। এ বার মঙ্গলবার সকাল থেকে ওলির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে নতুন করে পথে নামলেন ছাত্র-যুবারা। স্লোগান উঠল, ‘কেপি চোর, দেশ ছোড়’। নেপালের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের দাবিতেও স্লোগান ওঠে মঙ্গলবার সকালে। ললিতপুর জেলার খুমালতারে নেপালের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পুষ্পকমল দহল ‘প্রচণ্ড’-র বাসভবনে চড়াও হন বিক্ষোভকারীরা। ভাঙচুর করা হয় তাঁর বাড়ি।
সমাজমাধ্যমের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পরেও পরিস্থিতি পুরোপুরি শান্ত হয়নি। বরং নতুন উদ্যমে পথে নেমেছেন ছাত্র-যুবারা। মঙ্গলবার কাঠমান্ডু এবং সংলগ্ন ললিতপুর ও ভক্তপুর জেলার বেশ কিছু এলাকায় কার্ফু জারি করা হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টা (স্থানীয় সময়) থেকে কার্ফু চলছে কাঠমান্ডুর বিভিন্ন প্রান্তে। অনির্দিষ্ট কালের জন্য এই কার্ফু বলবৎ থাকবে বলে জানিয়েছে কাঠমান্ডু জেলা প্রশাসন। একই নির্দেশিকা জারি করেছে ভক্তপুর জেলা প্রশাসনও। ললিতপুরের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে সকাল ৯টা (স্থানীয় সময়) থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কার্ফু জারি রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা প্রশাসন।
তবে কার্ফু উপেক্ষা করেই মঙ্গলবার ফের পথে নামতে দেখা গিয়েছে নেপালের ছাত্র-যুবাদের। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ‘দ্য কাঠমান্ডু পোস্ট’ অনুসারে, মঙ্গলবার সকালে কাঠমান্ডুর নিউ বানেশ্বর এবং অন্য এলাকায় রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেছেন তরুণেরা। কাঠমান্ডু জেলার কালেঙ্কি এবং বানেশ্বরে, ললিতপুর জেলার চাঁপাগাঁও-সহ বেশ কিছু এলাকায় বিক্ষোভ হয়েছে। কালেঙ্কিতে রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ হয়েছে। কয়েক জন বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ।
সমাজমাধ্যমের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপানোকে কেন্দ্র করে সোমবার উত্তাল হয়ে ওঠে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু। সরকারি নিয়মবিধি না মানায় সম্প্রতি ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটস্অ্যাপ, এক্স, ইউটিউব-সহ ২৬টি সমাজমাধ্যমকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল নেপাল সরকার। তারই প্রতিবাদে সোমবার রাস্তায় নেমেছিলেন নেপালের ছাত্র-যুবারা। বিক্ষোভ দমাতে আসরে নামে পুলিশ। নেপাল পুলিশের দাবি, বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে তারা শূন্যে গুলি চালিয়েছিল। তবে বিক্ষোভকারীদের দাবি, তাঁদের লক্ষ্য করেই গুলি চালানো হয়েছে।
সোমবারের বিক্ষোভে এখনও পর্যন্ত ১৯ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। এত জন তরুণের মৃত্যুর জন্য নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির দিকেই আঙুল তুলছেন বিক্ষুব্ধ জনতা এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি। নেপাল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক গগনকুমার থাপা তরুণদের মৃত্যুর জন্য সরাসরি নিশানা করেছেন প্রধানমন্ত্রী ওলিকেই। তাঁর বক্তব্য, এত জনের মৃত্যুর দায়িত্ব নিতে হবে ওলিকেই।
তিনি বলেন, “এই ঘটনার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিতে হবে। তরুণ প্রজন্মের (জেন জ়েড) শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের সময় যে অবাঞ্ছিত ও হিংসাত্মক ঘটেছে, তা দুঃখজনক এবং অস্বাভাবিক। বিক্ষোভ সামলানোর নামে সরকার যে চরম দমন-পীড়ন চালিয়েছে তা নিন্দনীয় এবং ক্ষমার অযোগ্য।” তাঁর দাবি, সরকারের এই আচরণকে কোনও ভাবেই সমর্থন করা যায় না। নেপালের প্রধান বিরোধী দল সিপিএন শিবিরও। প্রধানমন্ত্রী ওলির পদত্যাগের দাবি তুলেছে তারা।
ওই ঘটনার পর আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশ্নের মুখে পড়েছে নেপাল সরকার। সোমবার বেশি রাতের দিকে কাঠমান্ডুতে অবস্থিত সাতটি দূতাবাসের তরফে বিবৃতি জারি করা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জাপান, কোরিয়া, ব্রিটেন এবং আমেরিকার দূতাবাসের তরফে বিবৃতিটি দেওয়া হয়েছে। সোমবারের ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করে তারা উল্লেখ করেছে, “আমাদের সরকার শান্তিপূর্ণ সমাবেশ এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারকে সমর্থন করে। সব পক্ষকে সংযত থেকে উত্তেজনা এড়িয়ে মৌলিক অধিকারগুলি সুরক্ষিত করার অনুরোধ জানাচ্ছি।”
সোমবারের ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’ও। তারা এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, নেপালে বিক্ষোভকারীদের দমাতে গুলি চালানো হয়েছে। এর ফলে বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারীর মৃত্যু হয়েছে এবং অনেকে গুরুতর আহত হয়েছেন বলে দাবি অ্যামনেস্টির। এ দিকে সোমবার বেশি রাতের দিকে নেপালের প্রধানমন্ত্রী ওলি এক বিবৃতিতে দাবি করেছেন, কিছু ‘বহিরাগত উপাদান’-এর জন্যই তরুণদের বিক্ষোভ হিংসাত্মক হয়ে উঠেছিল। তরুণ প্রজন্মের দাবির প্রতি সরকারের কখনও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না। তাঁর দাবি, সমাজমাধ্যমগুলিকে নিষিদ্ধ করার কোনও নীতি সরকারের নেই।
খুলনা গেজেট/এনএম