দক্ষ, সৎ, যোগ্য, দেশপ্রেমিক নেতা প্রয়োজন : মালয়েশিয়া উদাহরণ

এ এম কামরুল ইসলাম

৫৪ বছর দেশ স্বাধীন হলেও আমরা একজন দক্ষ, সৎ, যোগ্য, দেশপ্রেমিক শাসক পাইনি বললে ভুল হবে না। আমাদের চরিত্রে কালিমা লেপন করেছে আন্দোলন, সংগ্রাম, জ্বালাও-পোড়াও, হত্যা, ক্যু, দুর্নীতি নামক নানা উপসর্গ। কোন সরকার ভাল কাজ করলেও তা বিরোধীপক্ষ সমর্থন করে না। বরং দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে প্রতিহত করতে চেষ্টা করে। আমরা যে যেখানে যেভাবে পারি নিজের স্বার্থ হাসিল করতে তৎপর থাকি। নিজের কাজটি সঠিকভাবে পালন না করে, অন্যের কাজের বিরূপ সমালোচনা করা আমাদের মজ্জাগত দোষ। অথচ যে যার জায়গায় সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে এমনিতেই দেশ উন্নত হয়ে যাওয়া কঠিন কিছু নয়। আমরা সবাই মুখে যা বলি, মনে মনে তা পালন করি না। বিশেষ করে যারা ক্ষমতায় যায় তারা মনে করে-সকল অবৈধ কাজের লাইসেন্স তারা পেয়ে গেছে। অতএব যেভাবে হোক ক্ষমতায় থাকতে থাকতে নিজের আখের গুছিয়ে নিতে হবে। শুধু রাজনৈতিক দলের মধ্যে এই প্রবণতা আছে বললে ভুল হবে। আমলা, কামলা, ব্যবসায়ী, দিনমজুর, শিক্ষক, ছাত্র সবার মধ্যে একই চিন্তা কাজ করে। যারা প্রকৃত ভাল মানুষ তারা গোবেচারা। তাদের সাথে কেউ থাকে না। ভাল মানুষের মধ্যে যাদের যোগ্যতা আছে তারা সুযোগমতো বিদেশে পাড়ি জমান, আর যাদের সেই সুযোগ নেই তারা দেশের মধ্যে ধুঁকে ধুঁকে একদিন শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করেন।

মালয়েশিয়া ১৯৫৭ সালে বৃটিশদের কাছ থেকে স্বাধীন হলেও সম্পূর্ণ আলাদা রাষ্ট্রে রূপ নেয় ১৯৬৩ সালে। আমাদের চেয়ে আট বছর আগে রাষ্ট্র গঠন করে তারা কোথায়, আর আমরা কোথায়?

মালয়েশিয়ার এই অভূতপূর্ব উন্নয়নের মূল নায়ক একজন দক্ষ, সৎ, যোগ্য, দেশপ্রেমিক নেতা। তিনি হলেন ড. মাহাথির মোহাম্মদ।

মালয়েশিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদের রাজনৈতিক জীবনের টাইমলাইন।

১৯৬৪ প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন (UMNO দলের হয়ে)।
১৯৬৯ নির্বাচনে পরাজিত হয়ে সংসদ হারান, পরে দলের ভেতরে সমালোচনার কারণে বহিস্কৃত হন।

১৯৭০ প্রধানমন্ত্রী তুন আবদুল রাজ্জাক ক্ষমতায় এলে UMNO-তে ফিরিয়ে আনা হয়।

১৯৭৪ আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং শিক্ষামন্ত্রী হন।

১৯৭৬ তুন হুসেইন ওন প্রধানমন্ত্রী হলে মাহাথির উপ-প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন।

১৬ জুলাই ১৯৮১ তুন হুসেইন ওন পদত্যাগ করলে মাহাথির মালয়েশিয়ার ৪র্থ প্রধানমন্ত্রী হন।

১৯৮১-২০০৩ টানা প্রায় ২২ বছর প্রধানমন্ত্রী, মালয়েশিয়ার ইতিহাসে দীর্ঘতম সময়।

১৯৯১ Vision ২০২০ ঘোষণা করে মালয়েশিয়াকে উন্নত রাষ্ট্রে রূপান্তরের লক্ষ্য স্থির করেন।

২০০৩ প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে অবসর নেন।

২০০৮ আনোয়ার ইব্রাহিমের নেতৃত্বাধীন বিরোধীদলকে পরোক্ষভাবে সমর্থন দেওয়া শুরু করেন।

২০১৬ নতুন রাজনৈতিক দল Parti Pribumi Bersatu Malaysia (PPBM) গঠন করেন।

১০ মে ২০১৮, ৯২ বছর বয়সে আবার নির্বাচনে জয়ী হয়ে মালয়েশিয়ার ৭ম প্রধানমন্ত্রী হন।

মার্চ ২০২০ রাজনৈতিক সংকটে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ করেন।

ড. মাহাথীর মোহাম্মদের অবদান

১. অর্থনৈতিক রূপান্তর ও Vision ২০২০

১৯৯১ সালে তিনি Vision ২০২০ ঘোষণা করেন, যার লক্ষ্য ছিল ৩০ বছরের মধ্যে মালয়েশিয়াকে একটি উন্নত দেশে পরিণত করা। এতে বছরে গড় অর্থনৈতিক বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল প্রায় ৭%।

তাঁর শাসনকালে মালয়েশিয়াকে কৃষিভিত্তিক থেকে উৎপাদন, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি নির্ভর অর্থনীতিতে রূপান্তরে সাহায্য করেছেন।

২. মেগা-ইনফ্রাস্ট্রাকচার এবং আধুনিকীকরণ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে
তিনি মূল ভূমিকায় ছিলেন :

পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারস (তৎকালীন বিশ্বে সর্বোচ্চ বিল্ডিং)

কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (KLIA)

নর্থ সাউথ এক্সপ্রেসওয়ে

পুত্রাজায়া (নতুন ফেডারেল প্রশাসনিক রাজধানী)

মাল্টিমিডিয়া সুপার করিডোর (MSC), যা প্রযুক্তি বিনিয়োগ ও তথ্য প্রযুক্তি খাত বাড়ানোর পরিকল্পনা ছিল ।

৩. Look East Policy এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব
১৯৮২ সালে তিনি Look East Policy প্রবর্তন করেন, যা জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার উন্নয়নমুখী নীতি ও দক্ষতা অনুসরণের ওপর ভিত্তি করে ছিল। এর ফলে প্রযুক্তিগত অংশীদারিত্ব এবং করনীয় কাজের নৈতিকতা বৃদ্ধি পায় ।

৪. প্রশাসনিক সংস্কার ও উচ্চ নৈতিকতার প্রয়াস : সরকারি আধিকারিকদের জন্য নামপ্লেট, সময় মেনে চলা, ক্লায়েন্টস চার্টার ইত্যাদি প্রচলন করা হয়, যা সু-শাসন ও জবাবদিহিতা বাড়াতে সহায়তা করে ।

বেশ কিছু সংস্থার উদারায়ন ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধিতে অ্যান্টিকরাপশন এজেন্সি এবং পাবলিক কমপ্লেন্টস ব্যুরো প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

৫. রাজনৈতিক প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ : ১৯৮৭ সালে Operation Lalang নামে একটি কঠোর নির্বাপণ অভিযান চালানো হয়, যেখানে অনেককে আটক করে আইনের বাইরে রাখা হয় যা নির্দেশ করে তাঁর শাসনামলে কেবল উন্নয়নের দিকেই নয়, নির্ভরযোগ্যতা এবং রাজতান্ত্রিক পরিবর্তনের কঠোর হস্তক্ষেপও চালু ছিল।

১৯৮৮ সালের বিচারিক সংকট (judicial crisis) এবং বিচারপতির বরখাস্তের মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে প্রভাবিত করা হয়েছিল।

৬. দ্বিতীয় মেয়াদ : ২০১৮-২০২০ : ২০১৮ সালে বিপুল অবাধ ও অবিচ্ছিন্ন ক্ষমতার পর তিনি একটি ঐতিহাসিক রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন ঘটান এবং ক্ষমতায় আসেন। ষড়যন্ত্রমূলক ১গউই কেলেঙ্কারি মোকাবেলায় অভিযানের সূচনা করেন।

তাঁর দ্বিতীয় কাল ছিল সংক্ষিপ্ত, তবে তা ছাড়া অপ্রতিরোধ্যভাবে দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে তার গুরুত্ব রয়ে যায়।

তাঁর আমলে ডেপুটি প্রাইম মিনিষ্টার আনোয়ার ইব্রাহিমকে বিভিন্ন মেয়াদে জেলে রাখা হয়। পরবর্তীতে আনোয়ার ইব্রাহিমকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসানো হয়। এটা আমার মতে সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও দেশের কল্যাণে সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল।

আনোয়ার ইব্রাহিমের জেল জীবনের সময়কাল অভিযোগ/মামলায় সাজার মেয়াদ/বাস্তবে কারাগারে কাটানো সময়/মুক্তির কারণ

সেপ্টেম্বর ১৯৯৮ সেপ্টেম্বর ২০০৪ দুর্নীতিও সমকামিতা (মাহাথির আমলে) দুর্নীতি : ৬ বছর <br> সমকামিতা : ৯ বছর প্রায়।

২০০৪ সালে ফেডারেল কোর্ট সমকামিতার সাজা বাতিল করে।

ফেব্রুয়ারি ২০১৫ মে ২০১৮ সমকামিতা (সাঈফুল নামাজুদ্দিন মামলা) ৫ বছর। ২০১৮ সালে রাজকীয় ক্ষমা পেয়ে মুক্তি পান।

আমরা যদি বর্তমান মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের জেল জীবন নিয়ে পর্যালোচনা করি তাহলে একটা জিনিস প্রতীয়মান হয় যে, ড. মাহাথির মোহাম্মদের শাসন আমলে তিনি জেলে ছিলেন প্রায় ৯ বছর। আবার তিনি রাজকীয় ক্ষমাও পেয়েছিলেন ড. মাহাথিরের আমলেই। ইচ্ছে করলে ড. মাহাথির তাঁর ক্ষমতা দিয়ে আনোয়ার ইব্রাহিমকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারতেন। তাতে তাঁর পথের কাঁটা চিরতরে বিদায় হয়ে যেতো। কিন্তু তিনি তা করেন নি। বরং সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার স্বার্থে আনোয়ার ইব্রাহিমকে আটক রেখে দেশকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং এক পর্যায়ে রাষ্ট্রের স্বার্থে তাঁকেই ক্ষমতায় বসিয়ে নিজে অবসর নিয়েছিলেন।

একইভাবে আনোয়ার ইব্রাহিম ক্ষমতায় এসে ড. মাহাথির মোহাম্মদকে কোন নির্যাতন করেননি। বরং তাঁর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন। এটাই প্রকৃত রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও পারস্পরিক সৌহার্দ্য এবং দেশকে এগিয়ে নেওয়ার কৌশল।

পক্ষান্তরে আমাদের দেশে আমরা ৫৪ বছরে কী দেখলাম। স্বাধীনতার ৪/৫ বছরের মধ্যে আমরা বঙ্গবন্ধুকে স্ব পরিবারে নিশ্চিহ্ন করলাম। জিয়াউর রহমানকে হত্যার করলাম। আব্দুস সাত্তারকে জোর করে গদিছাড়া করলাম। এরশাদকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে জেলে ঢুকালাম। খালেদা জিয়াকে হরতাল অবরোধ দিয়ে গদিছাড়া করলাম। শেখ হাসিনাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করলাম। এখন ড. ইউনুস সরকারের বিরুদ্ধে টালমাটাল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে তাঁকেও অপমান অপদস্ত করার ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু কেন আমাদের জাতির এই লজ্জাজনক অবস্থা। এর জন্য দায়ী কে? আমরা কখনোই রাজনৈতিক শিষ্টাচার শিখবো না? আন্দোলন সংগ্রাম করে, রাষ্ট্রনায়ককে হত্যা করে, রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকা- করে সাময়িক নেতা হওয়া যায়। কিন্তু কখনো রাষ্ট্রের কল্যাণ করা যায় না।

ক্ষমতার লোভে দেশের কথা চিন্তা না করে আমাদের দেশের নেতারা যতদিন নিজের স্বার্থ নিয়ে চলবে ততদিন এই জাতির কোন পরিবর্তন হবে না। তাই আসুন, আমরা মালয়েশিয়া থেকে শিক্ষা নিয়ে আদর্শ দেশ ও জাতি গঠনে এগিয়ে আসি। এতকাল যা হয়েছে তা ভুলে গিয়ে আজ থেকে নিজের স্বার্থ, দলের স্বার্থ বাদ দিয়ে দেশের স্বার্থে একজোটে কাজ করি। তাহলেই এই দেশ হবে প্রকৃত সোনার দেশ।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন