এ বছরের ২২ আগস্ট কলকাতার তিনটি সম্প্রসারিত মেট্রোরেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসে ভারতের প্রধান একবারও এই মেট্রোরেল বা পাতাল রেলের যিনি স্বপ্ন দ্রষ্টা সেই আবু বরকত আতাউর গণি খান চৌধুরীর নামটি একবারের জন্য মুখে আনলেন না। বহু তাজ্জব কি বাত। শুধু তাই নয়, সেই স্বপ্নদ্রষ্টার নামে একটা মেট্রো স্টেশনের নামকরণও করা হল না। এটাও অবাক করার মতোই ঘটনা।
ভারতের প্রথম পাতালরেল বা মেট্রোর সূচনা কলকাতায়। এটি শুধু এক পরিবহন প্রকল্প নয়, বরং আধুনিক ভারতের নগর পরিকল্পনা ও গণপরিবহনের এক মহাসাহসী দৃষ্টান্ত। কিন্তু এই ইতিহাসের পেছনে যিনি মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন, সেই প্রখ্যাত কংগ্রেস নেতা ও প্রাক্তন রেলমন্ত্রী আবু বরকত আতাউর গণি খান চৌধুরী আজ ধীরে ধীরে বিস্মৃত প্রায়। অথচ তাঁর দূরদর্শিতা ও নিরলস উদ্যোগ ছাড়া হয়তো ভারত এভাবে মেট্রোর যুগে প্রবেশ করত না।
কলকাতা মেট্রোর সূচনা
১৯৭২ সালে, গণি খান চৌধুরীর উদ্যোগেই কলকাতায় পাতালরেল প্রকল্প অনুমোদিত হয়। তাকে যোগ্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভারতের সর্বকালের ডায়ানেমিক নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়। কেন না, গণি সাহেব ছিলেন সিদ্ধার্থ মন্ত্রিসভার বিদ্যুৎ ও পরিবহণ মন্ত্রী। একদিকে প্রযুক্তিগত প্রতিবন্ধকতা, অন্যদিকে আর্থিক ও প্রশাসনিক জটিলতা-সবকিছুর মাঝেও তিনি প্রকল্পকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী বুঝে গিয়েছিলেন যে, গণি মানেই উন্নয়নের গণি। গণি এক কর্মবীর। গণি এক স্বপ্নভুক যুবক। তাই আশির দশকেই তাকে করে দিলেন কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী। ১৯৮৪ সালের ২৪ অক্টোবর যখন কলকাতার এসপ্ল্যানেড থেকে ভূগর্ভস্থ মেট্রো চালু হলো, তখন তা ভারতীয় পরিবহন ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। এই কৃতিত্বের পেছনে গণিখান চৌধুরীর নাম সর্বাগ্রে থাকা উচিত।
মালদা থেকে জাতীয় পর্যায়ে গমন গণি সাহেব
মালদার আপামর মানুষের কাছে তিনি ছিলেন বরকতদা। স্থানীয় উন্নয়ন হোক বা জাতীয় রেলব্যবস্থার আধুনিকীকরণ-সব ক্ষেত্রেই তাঁর অবদান ছিল অনন্য। মালদা রেল ডিভিশন প্রতিষ্ঠা, গৌড় এক্সপ্রেস চালু, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নানা উদ্যোগ তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের মাইলফলক।
অদ্ভুত হলেও সত্য, কলকাতা মেট্রোর কোনো স্টেশনের নাম আজও তাঁর নামে রাখা হয়নি। অথচ তুলনামূলকভাবে কম অবদান রাখা অনেক রাজনীতিক বা প্রশাসকের নাম আমরা নানা প্রকল্পে দেখতে পাই। এই উপেক্ষা কেবল একজন নেতাকে নয়, আমাদের ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
গণিখান চৌধুরীর অবদানকে সম্মান জানাতে আজও কেউ এগিয়ে এলোনা! কলকাতার অন্তত একটি প্রধান মেট্রো স্টেশন-যেমন পার্ক স্ট্রিট বা এসপ্ল্যানেড-তাঁর নামে নামকরণ করা হলে ইতিহাস ন্যায্য সম্মান পেত। একইসঙ্গে, কলকাতা মেট্রোরেল কর্পোরেশনের উচিত তাঁর একটি প্রতিকৃতি ও জীবনবৃত্তান্ত প্রদর্শন করা, যাতে নতুন প্রজন্ম জানতে পারে যে ভারতীয় পাতালরেলের প্রকৃত স্থপতি কে ছিলেন।
আমরা যাদের ভুলে যাই, ইতিহাস তাদের ফের মনে করিয়ে দেয়। গণিখান চৌধুরী ভারতের মেট্রো রেলের পথিকৃৎ। তাঁর নামের পাশে মেট্রোর স্মারক জড়িয়ে দেওয়া শুধু একটি মানুষের সম্মান নয়, বরং ভারতের আধুনিক নগর জীবনের প্রথম স্বপ্নের স্থপতিকে মর্যাদা দেওয়া। মেট্রোরেল বা পাতাল রেল ও গণিখান চৌধুরী যেন সমার্থক।
খুলনা গেজেট/এনএম