বৃহস্পতিবার । ২রা অক্টোবর, ২০২৫ । ১৭ই আশ্বিন, ১৪৩২

ওয়াকফ সংশোধনী আইন বিরোধী আন্দোলন মমতা ব্যানার্জির কাছে আরেক স্পেনীয় ক্ষত

মোহাম্মদ সাদউদ্দিন, কলকাতা

চলতি বছরের এপ্রিল মাসে মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর মহকুমার সামসেরগঞ্জ (ধুলিয়ান) ও সুতি থানা (অরঙ্গাবাদ) এলাকায় ওয়াকফ সংশোধনী আইন বিরোধী মুসলিম সংগঠনগুলির যৌথ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হয়েছিল ও যার বলি হতে হয় দুই সম্প্রদায়ের‌ শ্রমজীবী মানুষকে।

এই ঘটনার একমাসের কাছাকাছির পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সেখানে গিয়ে বলেছিলেন, ওয়াকফ নিয়ে কোনো আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গে করবেন না। যা কিছু করার দিল্লিতে গিয়ে‌ করুন। পশ্চিমবঙ্গে ওয়াকফ নিয়ে আন্দোলন করলে আমিই আপনাদের বিরোধী হয়ে যাব। এই ঘটনার পর শুধু মালদহ-মুর্শিদাবাদের মুসলিমরাই বুমেরাং হননি। গোটা পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমরাই কার্যত বুমেরাং।

আর সেই বুমেরাং-এর রূপ পশ্চিমবঙ্গবাসী দেখতে পেল ২০ আগস্ট। সূচনার দিনেই ইণ্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ) , এসডিপিআই, ওয়েলফেয়ার পার্টি, আইমিমসহ ২০টি সংগঠনের যৌথমঞ্চ কনস্টিটিউশন প্রটেকশন ফোরাম আয়োজিত কলকাতার ধর্মতলার মেট্রো চ্যানেলের সাতদিন ব্যাপী ধর্ণা-অবস্হান কর্মসূচিতে পুলিশের নির্যাতন ও হামলা প্রমাণ করে দিল মমতা ওয়াকফ সংশোধনী আইন বিরোধী আন্দোলনের ঘোর বিরোধী। ওইদিন ধর্মতলার টিপু সুলতান মসজিদের কাছে থেকে আই এস এফ সুপ্রীমো বিধায়ক নৌশাদ আলী সিদ্দিকীর কনস্টিটিউশন প্রটেকশন ফোরাম একটা মিছিল করে মেট্রো চ্যানেল বিক্ষোভ অবস্হানের দিকে গেলে মমতার পুলিশ তা আটকে দেওয়ার চেষ্টায় শুধু করেনি, রীতিমতো হামলা করে এবং তাদেরকে লালবাজার নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাদের জামিন হয়ে গেলেও আন্দোলন কিন্তু তুঙ্গে। জেলায় জেলায় আন্দোলন আরও বিকট আকার ধারণ করেছে। মুসলিম সমাজ আজ বলতে লেগেছে, পশ্চিমবঙ্গের ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের বিকল্প হিসাবে মুসলিমরা ঢেলে ভোট দিয়েছে মমতা ব্যানার্জির তৃণমূলকে।

নিজেদের ওয়াকফ সম্পত্তি বাঁচানোর তাগিদে যে আন্দোলন করতে মমতার পুলিশের যে আচরণ পাওয়া গেল তাতো ঘুরপথে বিজেপিকেই সাহায্য করা। তাহলে বিজেপি-তৃণমূলের সামনাসামনি যে কাদা ছোড়াছুড়ি তা নিছক নাটক। দিদি-মোদীর সম্পর্ক একই আছে।

২০ আগস্টের মমতার পুলিশের মারমুখী এটাই প্রমাণ করে দিয়েছে যে, মমতা-মোদীর লড়াই হিন্দুত্ববাদ বনাম হিন্দুত্ববাদ। আজকে কলকাতার মতো সম্প্রীতির মরুদ্যানে শিয়ালদহের বৈঠকখানা রোডে ঐতিহ্যবাহী ব্রিটিশ আমলের কার্মাইকেল হস্টেলের বাঙালি আবাসিকদের অবাঙালিদের হাতে মার খেতে হল কেন? কেন তাদেরকে বলা হল রোহিঙ্গা বা বাংলাদেশী? যদিও কলকাতার বাম ছাত্র সংগঠনগুলি এর বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে ও তীব্র বিরোধিতা করে।

প্রশ্ন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত বাংলাদেশী পড়ুয়াদের নিরাপত্তা আজ প্রশ্নচিহ্নের মুখে। যেখানে পশ্চিমবঙ্গ ভারতীয় ওরিজিন বাঙালি পড়ুয়ারা নিরাপদ নন। সেখানে বাংলাদেশী পড়ুরা কীভাবে নিরাপদ হতে পারে? এটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন।

৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে ঠিকই। কিন্তু জননেতা জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন যেমন বুকফুলে বলতে পেরেছিলেন, এ রাজ্যে যে দাঙ্গা লাগাবে তার জন্য একটা গুলিই যথেষ্ট। জ্যোতি বসু আরও বলতেন যে, শাসক বা সরকার চাইলেই দাঙ্গা হবে, না চাইলে দাঙ্গা হবে না।

ওই বাম জমানার জ্যোতি বসুর উত্তরসূরী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলতেন, এ রাজ্যে মন্দির-মসজিদ চলবে না। যারা এ নিয়ে দাঙ্গা লাগাতে আসবে তাদের মাজা ভেঙে দেওয়া হবে। পশ্চিমবঙ্গে অন্তত এই দাঙ্গার ক্ষেত্রে বামপন্হীরা কোনো আপস করেনি।

আর চলতি বছরে দুই শাসকের আশীর্বাদে বারবার দাঙ্গা। আসানসোলে কী ঘটলো? যে ঈমামের ছেলে খুন হলেন সেই ঈমাম শেগবাতুল্লাহ রাস্তায় নেমে বললেন, আমার ছেলের জন্য আমি আর যেন খুন না দেখি। হাওড়ার ধুলাগড়ে কী হল? কেন হল? জবাব, দুই শাসকের আশীর্বাদ। সামসেরগঞ্জ বা সুতিতেও ঠিক তাই।

মুসলিমদের বহু ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে যেগুলি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শাসক দলের মদতে নেতা-মন্ত্রী-বিধায়করা দখল করেছেন। আর এখনো সেই দখলদারি সমান তালেই চলছে।

ঠিক সেই মুহুর্তেই কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের ওয়াকফ সংশোধনী আইন যা মুসলিমদের ওয়াকফ সম্পত্তি চলে যাবে আদানি-আম্বানিদের মতো কর্পোরেট হাউসের হাতে। আর তাকে বাঁচাতে মুসলিমরা যদি শান্তপূর্ণ মুভমেন্ট করে আর তাকে যদি পুলিসি দমন-পীড়ন দিয়ে শেষ করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে পশ্চিমবঙ্গের সমগ্র মানব সমাজ গর্জে উঠবেই। পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমরা আজ দেখছে, আজকের কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম, রাজভবন, আকাশবানী ভবন, বিধানসভা ভবন, মহাকরণ, টালিগঞ্জ গল্ফ ক্লাব সবইতো ওয়াকফ সম্পত্তি ছিল। দানবীর হাজী মহম্মদ মহসীনের ওয়াকফ সম্পত্তি আজ বেদখল। মুর্শিদাবাদের নবাবদের ওয়াকফ সম্পত্তি আজ বেদখল। গৌড়-মালদহের সুলতানদের ওয়াকফ সম্পত্তি আজ বেদখল। মুসলিমরা এখন আতঙ্কিত। সাচার কমিটির সুপারিশ অনুসারে কোনো ওয়াকফ সম্পত্তি মুসলিমদের কল্যাণে কাজে লাগানো হয়নি বলে খোদ মুসলিমদের অভিযোগ।

মুসলিমরা আজ বলছে, ওয়াকফ আন্দোলনের জন্য যদি আমাদের দিল্লি যেতেই হয়, ভোটের সময় আমাদের কাছে আসবেন না মমতা দেবী। তাই ওয়াকফ আন্দোলন মমতার কাছে হয়ে যেতে পারে স্পেনীয় ক্ষত। তবে সবটাই বলে দেবে সময়ই।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন