জীবনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত এক বিস্ময়কর যন্ত্রাংশ- হার্টের রিং। অসংখ্য হৃদরোগীর বাঁচার নতুন আশার নাম আজ এই ছোট্ট ধাতব জালের মতো বস্তুটি। তবে আপনি জানেন কি, এই রিং আসলে কী দিয়ে তৈরি? আর কিভাবে তা হৃদয়ের পথে স্থাপন করে ফিরে আনা হয় জীবনের গতি?
হৃদরোগ যখন জীবনের হুমকি
বাংলাদেশে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। লাইফস্টাইল, খাদ্যাভ্যাস, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ নানা কারণে হৃদয়ের রক্তনালিতে জমতে থাকে চর্বি বা কলেস্টেরল। এতে ব্লক তৈরি হয়, কমে যায় রক্তপ্রবাহ। এক পর্যায়ে ঘটে হার্ট অ্যাটাক বা মৃত্যুঝুঁকি। এমন বিপজ্জনক অবস্থায় রিং বা স্টেন্ট ব্যবহারের মাধ্যমে রক্তনালির সেই বন্ধ পথ খুলে দেওয়া হয়।
রিংয়ের উপাদান : এক বিস্ময়কর প্রযুক্তি
হার্টের রিং এক ধরনের সূক্ষ্ম জালের মতো ধাতব বস্তু, যা সাধারণত নিচের উপাদানগুলো দিয়ে তৈরি:
কোবাল্ট-ক্রোম অ্যালয়: হালকা কিন্তু অত্যন্ত শক্ত। স্থায়ীত্বে উন্নত।
প্ল্যাটিনাম-ক্রোম: এক্স-রেতে সহজে দেখা যায়, নমনীয়।
নাইটিনল (নিকেল-টাইটানিয়াম): শরীরের উষ্ণতায় নিজে থেকেই সঠিক আকার নেয়।
স্টেইনলেস স্টিল: পুরনো প্রযুক্তি, এখন তুলনামূলক কম ব্যবহৃত হয়।
বায়োঅ্যাবজর্বেবল পলিমার: সময়ের সঙ্গে শরীরে মিশে যায় এমন রিং, ভবিষ্যতের সম্ভাবনা।
অনেক রিংয়ে থাকে ওষুধের প্রলেপ, যা ব্লক আবার গঠিত হওয়া ঠেকায়—এগুলোকে বলা হয় ড্রাগ-এলুটিং স্টেন্ট।
জীবনরক্ষার পেছনের বিজ্ঞান
স্টেন্ট বসানোর প্রক্রিয়াটি হয় অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি নামে পরিচিত। ক্যাথেটার নামক সূক্ষ্ম টিউবের মাধ্যমে ধমনিতে পৌঁছে দেওয়া হয় রিং। একটি ছোট বেলুনের সাহায্যে ব্লক স্থানটি প্রসারিত করে সেখানে স্থাপন করা হয় রিংটি। সঠিকভাবে বসে গেলে রিং রক্তপ্রবাহ নিশ্চিত করে এবং রোগীর হৃদয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম পুনরায় শুরু হয়।
দাম ও প্রাপ্তি
বাংলাদেশে ড্রাগ-এলুটিং রিংয়ের দাম সাধারণত ৫০,০০০ থেকে ১,৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে সরকারি হাসপাতালে কিছু ক্ষেত্রে নিম্ন-মূল্যে বা বিনামূল্যে এই সেবা পাওয়া যায়। অনেক বেসরকারি হাসপাতালেও কিস্তিতে বা সহনীয় ব্যয়ে রিং বসানোর ব্যবস্থা রয়েছে।
দাম কমানো হয়েছে দেশে
সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় ১০ ধরনের স্টেন্টের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (MRP) ব্যাপকভাবে হ্রাস করা হয়েছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিচে তুলে ধরা হলো:
মূল্য কমানোর পরিমাণ:
দাম কমানো হয়েছে সর্বোচ্চ ৮৮,০০০ টাকা পর্যন্ত,এবং সর্বনিম্ন ৩,০০০ টাকা পর্যন্ত কিছু পছন্দের মডেলের নতুন ও পুরনো দাম:
Resolute Onyx (Medtronic): ১,৪০,৫০০ → ৯০,০০০ টাকা
Synergy XD (Boston Scientific): ১,৮৮,০০০ → ১,০০,০০০ টাকা
Xience Prime (Abbott): ৬৬,৬০০ → ৫০,০০০ টাকা
Onyx Trucor (Medtronic): ৭২,৫০০ → ৫০,০০০ টাকা
Promus Elite (Boston Scientific): ৭৯,০০০ → ৭২,০০০ টাকা
কিছু সতর্কতা
রিং বসানোর পর রোগীদের লাইফস্টাইল বদলানো, নির্দিষ্ট ওষুধ নিয়মিত সেবন, ধূমপান ত্যাগ এবং নিয়মিত চেকআপ করানো আবশ্যক। না হলে আবারও ব্লক তৈরি হতে পারে।
শেষ কথা
হার্টের রিং আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক চমৎকার উদ্ভাবন, যা প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষের জীবন রক্ষা করছে। এক সময় যেসব হৃদরোগীকে মৃত্যুর প্রহর গুণতে হতো, আজ তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারছেন-এই প্রযুক্তির কল্যাণে। তবে এও মনে রাখতে হবে, রিং নয়, সতর্কতাই হৃদয়ের আসল রক্ষা কবচ।
খুলনা গেজেট/এনএম