বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্ব ব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে পরিচালিত পার্টনার ফিল্ড স্কুল প্রকল্পে ভয়াবহ অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে নড়াইলের কালিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইভা মল্লিকের বিরুদ্ধে।
গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা এক ভিডিওতে এই কর্মকর্তা নিজেই স্বীকার করেছেন যে, প্রকল্প বাস্তবায়নে “ম্যানেজমেন্ট” খরচ মেটাতে গিয়ে প্রকল্পের টাকা থেকেই ‘এদিক-ওদিক’ করতে হয়।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্ব ব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে পুষ্টি উন্নয়ন, উদ্যোক্তা তৈরি, পরিবেশ বান্ধব চাষাবাদের নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে নড়াইলের ইউনিয়নগুলোতে ২০২৩ সালের আগস্টে যাত্রা শুরু করে কৃষকদের নিয়ে পার্টনার ফিল্ড স্কুল।
২৫ জন করে কৃষক নিয়ে গঠিত এসব স্কুলে হাতে কলমে শিক্ষা দেওয়ার কথা। প্রতিটি স্কুলে ধান, গম, ডাল, তৈলবীজ, পুষ্টি, ভূট্টা আর গ্যাপ এই ৭ শ্রেণির ফসল নিয়ে ১০ সেশনে ক্লাস নেওয়ার কথা থাকলেও সেখানে উপজেলা কৃষি বিভাগের মনগড়া নিয়মে কোথাও ২ দিন আবার কোথাও ৫ দিনেই শেষ হয় সেশন।
কালিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইভা মল্লিকের চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি স্বাক্ষরিত কৃষকদের পার্টনার ফিল্ড স্কুল রুটিন অনুযায়ী দেখা যায়, স্কুল গুলোর দশম সেশন শেষ হয়েছে সকাল-বিকাল পরিক্রমায় যথাক্রমে মে মাসের ৭, ৮, ১২, ১৪, ১৫, ১৮ এবং ১৯ তারিখে। কৃষকদের অভিযোগ, কালিয়া উপজেলার পার্টনার ফিল্ড স্কুলের সাড়ে ৩০০ কৃষকের প্রত্যেকে প্রশিক্ষণ শেষের দশম দিনে সম্মানী বাবদ ২ হাজার টাকা এবং নাস্তা দেওয়ার কথা থাকলেও তা না দিয়ে প্রতি ক্লাসে নাস্তা বাবদ ৮০ টাকা বরাদ্দ দেয়ার কথা বলা হয়। খাবার বাবদ প্রতি ক্লাসে ৮০ টাকা করে প্রতি কৃষকের মোট ২ হাজার ৮০০ টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইভা মল্লিকের স্বেচ্ছাচারিতা আর অনিয়মের কারনে ক্লাস শেষ করার পরও কিছুই জোটেনি তাদের ভাগ্যে।
কালিয়া উপজেলার মাথাভাঙা পার্টনার ফিল্ড স্কুলের সভাপতি ও কৃষক মাসুদুর রহমান বলেন, রমজানের ঈদের আগে আমাদের ক্লাস শুরু হয়। আমরা শুনেছি সম্মানি বাবদ দুই হাজার টাকা করে প্রতিজন পাবো। কিন্তু কিছুই পাইনি।
একই উপজেলার উড়শী স্কুলের কৃষক আজিজুর গাজী ও শেফালী বেগম বলেন, ‘কষ্ট করে ক্লাস করছি। খাবার বাবদসহ টাকা দেয়ার কথা বলছিলো ২ হাজার আর ৫০০ টাকা করে। ৫০০ টাকা করে নাকি সমিতির জন্যি কাইটে আমাগে হাতে ২ হাজার করে দেবে। খাবার তো দেয় নাই আবার টাকা ও দিনি, দেখা ও করেনা আর দেয় ও না।’
তবে, সাংবাদিকদের অনুসন্ধানের খবরে তড়িঘড়ি করে কৃষকদের পাওনা কিছু টাকা পরিশোধ করেন ইভা মল্লিক। সেখানেও স্বেচ্ছাচারিতা করেন তিনি। কৃষকদের সম্মানি বাবদ ২ হাজার টাকা ও নাস্তা বাবদ ৮০০ টাকার পরিবর্তে কোথাও ৪০০ আবার কোথাও সাড়ে ৪০০ টাকাসহ সম্মানি প্রদান করেন।
উড়শী পার্টনার স্কুলের দীপ্তি রানী বিশ্বাস বলেন, ‘আমাদের বাড়িতে ২৫ জন কৃষক নিয়ে ক্লাস করানো হয়। ১০ দিন স্কুল হওয়ার কথা থাকলেও ৫ দিনে সকাল-বিকেল দিয়ে ক্লাস শেষ করাইছে। রোজার ঈদের আগে আমাদের ক্লাস শেষ হইছে, কিন্তু ক্লাসের টাকা আর নাস্তার টাকা দেবে দেবে করে এতোদিন ধরে দেয়নি। শুধু এই দিচ্ছি দিবানি করে ঘুরাইছে।’
তবে দীপ্তি রানী বিশ্বাসের স্বামী বলেন, ‘আপনারা আসার খবরে তড়িঘড়ি করে বড় ম্যাডাম (ইভা মল্লিক) নিজে এসে টাকা দিয়ে গেছে, ১০ মিনিট ও দাঁড়াননি। মোট ২৪৫০ টাকা করে দিয়ে গেছে আমাদের।’
সূত্র জানায়, ইভা মল্লিক কৃষি কর্মকর্তা হিসাবে কালিয়া উপজেলায় যোগদানের পর পার্শ্ববর্তী একটি সরকারি ব্যাংকে পরিবারের এক সদস্যের সঞ্চয়ী হিসাবে তিনি পৌনে দুই বছরে লেনদেন করেছেন বিপুল অংকের টাকা।
এসব অভিযোগ সম্পর্কে কালিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইভা মল্লিক পার্টনার ফিল্ড স্কুলের অনিয়ম প্রসঙ্গে প্রশ্ন করতেই তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপনারা বলতে পারেন দুর্নীতি করে আমি জমি কিনছি। কৃষি অফিসার হওয়ার আগে কি সেই সুযোগ থাকে! কৃষি অফিসার হলে অনেক কিছু সুযোগ থাকে। ভাই বাংলাদেশের সব অফিসের একই চিত্র, আমার মনে হয় আমার অফিস সেই তুলনায় অনেক ভালো। শোনেন, আমার অফিসের উপ সহকারীদের হাতে কৃষকদের নাস্তার টাকা যদি দেই, এই নাস্তা তাদের কাছে কিভাবে যাবে বা তাদের কাছে টাকা পৌঁছাবে কি না তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।’
কৃষকদের টাকা নিয়ে অভিযুক্ত কৃষি কর্মকর্তা ইভা মল্লিক সানন্দে বলেন, ‘ভাই টাকা গুলো যে কোথা থেকে ম্যানেজ করতে হয় কিভাবে বলবো, কাউকে তো বলতে পারি না! হিসাব রক্ষণ বিভাগে (এজি অফিস) প্রকল্পের টাকা তুলতে গেলেই ২৮ থেকে ৩০ শতাংশ টাকা দিয়ে আসতে হয়। ভ্যাটে ১৫, আইটিতে ৫, অডিটে ৩, একাউন্টসে ৫ থেকে ৭ শতাংশ হারে টাকা দিয়ে আসতে হয়। তারপরও আমি কৃষকদের ৭০ শতাংশ হারে সব পরিশোধ করি। আর সব কিছু ম্যানেজ করতে প্রকল্প গুলো থেকে এদিক সেদিক করতেই হয়।’ (এই কথা গুলো গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা হয়)
ক্যামেরার সামনে এসব ব্যর্থতার দায় নিজের কাঁধে নিতে নারাজ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইভা মল্লিক। তিনি দাবি করেন,’আমি স্বচ্ছতার সাথে অফিস পরিচালনা করি। তবে পার্টনার ফিল্ড স্কুল গুলোতে দশম সেশনে টাকা দেয়ার কথা থাকলেও আমি ক্লাস শেষ করিনি। টাকা যেদিন দিব সেদিন শেষ ক্লাস রাখি। কৃষকদের টাকা দিবো না বা দিচ্ছি না ব্যাপারটা এমন নয়। আপনারা আগের রবি মৌসুমের স্কুল গুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।’
অভিযুক্ত এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এর আগেও স্থানীয় এক সার ও বীজ ডিলারকে ঘুষ না দেওয়ায় হেনস্তা করার অভিযোগ উঠেছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ বিষয়ে সংবাদ প্রচারের পর খুলনা থেকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের একটি দল কালিয়ায় গিয়ে এ বিষয়ে তদন্তও করেন।
কালিয়া উপজেলায় পার্টনার ফিল্ড স্কুলের অনিয়ম অসঙ্গতির প্রশ্নে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. জসীম উদ্দীন বলেন, অনিয়মের প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
খুলনা গেজেট/এসএস