আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ। দুই পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে পারেন না। পা দুটি চিকন ও বাঁকা। হাঁটুতে ভর দিয়ে চলতে হয় তাকে। ডান হাতেও নেই তেমন শক্তি। জন্মের পর থেকে তার শারিরিক সমস্যা। তবু থেমে থাকেননি। কোন প্রতিবন্ধকতা যেন বাধা হতে পারিনি মাহফুজের পথ চলায়। পরিবার ও বন্ধুদের কাঁধে চড়ে চলেছেন স্বপ্নের দিকে। শিক্ষকরা প্রথমে স্কুলে ভর্তি নিতে না চাইলেও তার মায়ের অনুরোধে সোনামনি কিন্ডার গার্ডেন ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে তিনি প্রাথমিকে বৃত্তি লাভ করেন। শিশুকাল থেকে মাহফুজের স্বপ্ন চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবায় নিয়োজিত হওয়া। আর এবার, সেই স্বপ্নকে ছুঁয়েছেন— এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়ে। প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও অধ্যবসায় তার এ অর্জন এনে দিয়েছে বলে জানান শিক্ষক ও পরিবার।
মাহফুজ সুন্দরবন বেষ্টিত উপকূলীয় উপজেলা কয়রার প্রত্যন্ত উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের দিঘীরপাড়ের বাসিন্দা মো. মুনসুর আলীর ছেলে। তার বাবা স্থানীয় একটি মাদ্রাসার ভাইস প্রিন্সিপ্যাল। মা গৃহিণী। চার ভাই বোনের মধ্যে সে ছোট। এবার বেদকাশী কলেজিয়েট স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ অর্জন করেছেন।
তার শিক্ষক ও এলাকাবাসীরা জানান, এই সাফল্য শুধু একজন ছাত্রের নয়— এটি একটি পরিবারের, কিছু বন্ধুর, একটি সমাজের যারা হাল ছাড়েনি। তার ছিল ব্যাপক মনোবল আর চোখে ছিল স্বপ্ন— ডাক্তার হয়ে অসহায়দের পাশে দাঁড়ানোর। জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁধা ছিল মাহফুজের জন্য। একটি দেহ চলতে না পারলেও, একটি মন ঠিকই ছুটে যেতে পারে তার স্বপ্নের পেছনে। মাহফুজের মতো যোদ্ধারা আমাদের দেখিয়ে দেয়— প্রতিবন্ধকতা দেহে থাকতে পারে, মনের না। চিকিৎসক হয়ে দেশের সেবায় নিয়োজিত হোক এই প্রত্যাশা সবার।
মহান সৃষ্টিকর্তার শুকরিয়া আদায় করে মাহফুজ বলেন, শিক্ষকদের আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ। পরিবারের সকলে যথেষ্ট ভালবাসেন। বন্ধু-বান্ধব ছিল আমার জন্য আশির্বাদ স্বরুপ, আল্লাহর অনন্য এক নেয়ামত। আমি একজন শারিরিক প্রতিবন্ধী হলেও সকলের সহযোগিতায় তেমনটি অনুভব হয় না। পড়ালেখায় কোন বাঁধা মনে করিনা। মায়ের কোলে চড়ে ছোটবেলায় স্কুলে যেতাম। একপর্যায়ে মামার সহযোগিতায় সাইকেল চালানো শিখে সেটা নিয়ে স্কুলে যেতাম। সাইকেল থেকে উঠানামা করতে পারিনা। সাইকেল স্কুলের গেটে পৌছালে সেখান থেকে বন্ধুরা কাঁধে করে দোতলার ক্লাস রুমে নিয়ে যেত। জরুরী প্রয়োজনে তারা সার্বক্ষণিক আমাকে সহযোগিতা করতো। কাঁধে করে টয়লেটে নিয়ে যেতেও তারা দ্বিধাবোধ করতো না। বাসায় কিছু বুঝতে সমস্যা হলে অনলাইন থেকে ভিডিও দেখে বুঝে নিতাম।
তিনি আরও জানান, পরীক্ষার দিনেও বন্ধুরা পাশে থেকেছেন। দোতলায় পরীক্ষার কক্ষ ছিল। সেখানে বন্ধুদের কাঁধে চড়েই পৌঁছেছেন প্রতিদিন। তিনি সকলের কাছে দোয়া চেয়েছেন, যেন চিকিৎসক হয়ে দেশের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারেন।
অন্যান্য প্রতিবন্ধীদের উদ্যেশ্যে মাহফুজ বলেন, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা একটা অজুহাত মাত্র। আমি একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে আজ এ পর্যন্ত এসেছি। আল্লাহ প্রত্যেককে মেধা দিয়েছেন, সেটা কাজে লাগানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহপাক সফলতা দিবেন ইনশাআল্লাহ।
মাহফুজের বন্ধু মুশফিক ও শুভ বলেন, মাহফুজের স্বপ্ন মানে আমাদের স্বপ্ন। আমাদের মাঝে বন্ধুত্বের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সম্পর্ক রয়েছে। আমরা কখনও বিরক্ত মনে করিনি। বরং যে যখন পেরেছে, সে তখন সহযোগিতা করেছে। আমরা কোথায় ঘুরতে গেলেও তাকে কাঁধে করে নিয়ে যেতাম।
মাহফুজের মা সাজেদা বেগম বলেন, শারিরিক সমস্যা নিয়ে মাহফুজ জন্মগ্রহণ করে। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। ছোটকাল থেকে সে নিজে হাঁটাচলা করতে পারে না। অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করে। তার এ সাফল্যের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া জ্ঞাপন করি। সকলের কাছে দোয়া চাই, আল্লাহ যেনো আমার ছেলের স্বপ্ন কবুল করেন। সে যেন একজন মানবিক চিকিৎসক হতে পারে।
বেদকাশী কলেজিয়েট স্কুলের অধ্যক্ষ মো. আব্দুল মজিদ বলেন, মাহফুজ অত্যন্ত বিনয়ী। নিয়মিত স্কুলে উপস্থিত থাকতো। পড়াশুনার প্রতি অতি মনোযোগী ছিল, সে তীব্র মেধার অধিকারী। আমরা তার উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি।
খুলনা গেজেট/এএজে