আধুনিক লাইফস্টাইলে চলতে গিয়ে বা জীবন পরিচালনা করার জন্য অনেক সময়ই আমরা মা-বাবার ত্যাগ, ভালোবাসা ও অকৃত্রিম যত্নের মূল্যের কথা ভুলে যাই। তাদের প্রতি নিজেদের দায়িত্ব-কর্তব্যের কথাও ভুলে যাই আমরা। অথচ পবিত্র ইসলাম ধর্মে মা-বাবার প্রতি সন্তানের কর্তব্যকে একটি পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
একবার এক ব্যক্তি বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে জানতে চাইলেন, ‘আল্লাহর রাসুল, আমার সদয় আচরণ ও যত্নের ব্যাপারে সবচেয়ে কার অধিকার বেশ?’ জবাবে মহানবী (সা.) বললেন, ‘তোমার মা।’ ওই ব্যক্তি আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তারপর কে?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তোমার মা।’ ওই ব্যক্তি তৃতীয়বার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তারপর কে?’ এবারও আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন, ‘তোমার মা।’ আর চতুর্থবার জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘তোমার বাবা।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৫৪৮)
হাদিসটিতে মায়ের প্রতি তিনগুণ বেশি গুরুত্ব দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এ থেকে স্পষ্ট যে, মায়ের মর্যাদা অন্য সবার থেকে বেশি এবং তার যত্নের ব্যাপারেও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে সন্তানকে।
মা-বাবার ত্যাগ ও অনুগ্রহ মনে করা:
এ ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তাদের প্রতি দয়া ও নম্রতার সঙ্গে নতো করো নিজেকে এবং বলো, “হে আমার প্রতিপালক, তাদের প্রতি রহম করুন, যেমন তারা আমাকে ছোটবেলায় লালন-পালন করেছেন।”’ (সুরা ইসরা, আয়াত: ২৪)
শৈশবে সন্তানের প্রতি মা-বাবা যে অক্লান্ত ত্যাগ ও ভালোবাসা দিয়েছেন, তা কখনো ভুলে যাওয়া ঠিক নয়। তাদের জন্য দোয়া করা এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা সন্তানের কর্তব্য।
অবাধ্যতা বড় পাপ:
বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদের বলব বড় পাপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর কোনটি?’ এ সময় সাহাবিরা বলেন, ‘হ্যাঁ, আল্লাহর রাসুল।’ জবাবে তিনি বললেন, ‘মহান আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা এবং মা-বাবার অবাধ্যতা করা।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,৬৩১)
মা-বাবার প্রতি অবাধ্যতা এমন গুরুতর পাপ যে, যাকে শিরকের পরই সবচেয়ে বড় পাপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ইমানের পরই মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব:
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমার রব নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করবে না এবং মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে।’ (সুরা ইসরা, আয়াত: ২৩)
আয়াতটিতে মা-বাবার প্রতি সদ্ব্যবহারকে ইমানের পরই স্থান দেয়া হয়েছে। এ থেকে এটা স্পষ্ট যে, সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ইবাদতের পাশাপাশি মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব পালনও অত্যন্ত অপরিহার্য একটি ইবাদত।
মৃত্যুর পরও কর্তব্য:
হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘যখন একজন মানুষ মারা যান, তখন তার আমল বন্ধ হয়; তিনটি বিষয় ছাড়া- চলমান সদকা (সদকায়ে জারিয়া), উপকারী জ্ঞান এবং সৎ সন্তান, যে তার জন্য দোয়া করে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,৬৩১)
এ হাদিসে বলা হয়েছে, মা-ববার মৃত্যুর পরও তাদের জন্য সন্তান দোয়া করবে এবং তাদের নামে সদকা দেয়ার মাধ্যমে মা-বাবার প্রতি সন্তানের কর্তব্য পালন করতে হবে।
অমুসলিম মা-বাবার প্রতিও সদয় হওয়া:
মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘যদি তারা (মা-বাবা) তোমাকে আমার সঙ্গে এমন কিছুর শরিক করার জন্য বাধ্য করেন, যার সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নেই তোমার, তবে তাদের আনুগত্য করো না। তবে তাদের সঙ্গে এই দুনিয়ায় উপযুক্ত সদয় আচরণ করো।’ (সুরা লুকমান, আয়াত: ১৫)
এখানে স্পষ্ট যে, মা-বাবা যদি অমুসলিমও হয় তাহলে তাদের প্রতি সবসময় সদয় ও ন্যায়সংগত আচরণ করা সন্তানের দায়িত্ব। ইমানের ব্যাপারে মা-বাবার কথা না শুনলেও তাদের সঙ্গে সন্তানের মানবিক ও সম্মানজনক সম্পর্ক বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে।
মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমার মা-বাবা যদি তোমার সঙ্গে থাকার সময় বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছান, তবে তাদের প্রতি ‘উফ’ পর্যন্ত বলো না এবং তাদের কখনো ধমক দিয়ো না; বরং তাদের সঙ্গে সবসময় সম্মানজনক ও ভদ্রভাবে কথা বলো।’ (সুরা ইসরা, আয়াত: ২৩)
এখানে মা-বাবার প্রতি সামান্য অসম্মানজনক আচরণও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি মা-বাবার বার্ধক্যজনিত দুঃসময়েও সন্তানদের ধৈর্য ও শ্রদ্ধা বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে।
খুলনা গেজেট/এসএস