খুলনা, বাংলাদেশ | ২৭শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১১ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

Breaking News

  গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে আরও ৩ জনের করোনা পজিটিভ
  খুলনায় যুবদল নেতাকে গুলি করে ও পায়ের রগ কেটে হত্যা

জলাবদ্ধতা দূরীকরণে সড়ক উঁচুকরণ : নিজের টাকায় ডুবছে জনগণ

রুশাইদ আহমেদ

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে গেছে অনেকটাই। অবকাঠামোগত উন্নয়ন থেকে শুরু করে যোগাযোগ ও প্রযুক্তি খাতে স্বল্প সময়ের ভেতরেই ক্রমান্বয়ে বহুদূর এগিয়েছে বঙ্গোপসাগর বিধৌত প্রায় ১ লাখ ৪৮ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট এই রাষ্ট্রটি।

প্রায় ৫৪ বছরের এই পথচলায় উত্তরোত্তর বাড়তে থাকা ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের চোখরাঙানি, বর্ধনশীল বেকারত্ব ও নিরক্ষরতার হার, প্রসূতি মা ও শিশু মৃত্যুর সংখ্যা, প্রভৃতি সমস্যার সমাধানে বেশকিছু কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে সরকারি ও বেসরকারিভাবে। ফলে দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্যাগুলোর মাত্রা ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে।

তবে ভাবনার বিষয় হলো, একইসঙ্গে ব্যাপক শিল্পায়ন ও নগরায়ণ ঘটার ফলে দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রতিবন্ধকতা হিসেবে বেশকিছু নতুন সমস্যার উদ্ভব হওয়ার দৃশ্য আমাদের সামনে আবির্ভূত হচ্ছে। আর সেই সমস্যারগুলোর মধ্যে সামনের সারিতে রয়েছে ভারি বর্ষণ কিংবা নদ-নদীর জোয়ারের পানির কারণে সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বড় বড় বিভাগীয় শহর, পৌরসভা থেকে শুরু করে গ্রাম-গঞ্জে সৃষ্টি হওয়া জলাবদ্ধতার সমস্যা।

ভৌগোলিক অবস্থান এবং মৌসুমী বায়ুর সক্রিয় উপস্থিতির কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। সাধারণত, এর ৮০ শতাংশ সংঘটিত হয় জুন থেকে অক্টোবরের মধ্যে। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে এই বর্ষা মৌসুম জলাবদ্ধতার অভিশপ্ত পরিস্থিতির অবতারণা করে চলেছে অব্যাহতভাবে। এতে অবশ্য পরিবেশের যতটা না দায় রয়েছে, তার চেয়ে বেশি ঢের দায় রয়েছে আমাদের অসচেতন সর্বসাধারণের। দায় আছে সরকারি নানা নীতিগত ভুল সিদ্ধান্তের।

পাইকারি দরে দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছোট-বড় অগণিত নদ-নদী আর জলাশয় ভরাট ও ভোগদখলের ঘটনাই মূলত জলাবদ্ধতাকে উসকে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান নিয়ামক শক্তি হিসেবে রূপায়িত হচ্ছে। এর পাশাপাশি, দেশের বড় বড় শহরগুলোতে আবাসন ব্যবসায়ীরা পুরোনো জলাশয়গুলো ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মাণের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। ফলে বর্ষার পানি নিষ্কাশনের পথ ক্রমশ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে বর্ষার পানি সরতে পারছে না। বরং জোয়ারের সময় উল্টো পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে পানি নিষ্কাশন পদ্ধতির চরম অব্যবস্থাপনার কারণে।

তবে হাস্যকর হলেও সত্য, দেশের বেশকিছু সিটি কর্পোরেশন বা স্থানীয় প্রশাসন জলাবদ্ধতা দূরীকরণে পানি নিষ্কাশন পদ্ধতির দিকে নজর দেওয়ার বদলে সমস্ত মনোযোগ নিবদ্ধ করেছে সড়ক উঁচু করার দিকে। যেন সড়ক উঁচু করলে নিমিষেই জলাবদ্ধতার সকল সংকট দূর হয়ে যাবে!

কিন্তু বাস্তবে সামনে আসছে উল্টো চিত্র। সড়কগুলোতে আরসিসি ঢালাই করে সঙ্গে পিচ ফেলে উঁচু করার পরও বর্ষা মৌসুমে সড়কে দীর্ঘক্ষণ পানি তো থাকছেই, সঙ্গে অকেজো ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে সেই পানি সড়ক থেকে নেমে চলে যাচ্ছে আশপাশের নিচু বাড়িঘর আর দোকানের ভেতরে। অর্থাৎ জনগণের কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে সড়ক উঁচু করার প্রকল্পসমূহের মাধ্যমে জনগণকেই ডুবিয়ে দেওয়া হচ্ছে পানিতে।

আপাতদৃষ্টিতে দেশের বেশকিছু জায়গার সড়কগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় যে, স্থানীয় প্রশাসনের কাছে নগর বা শহরের জলাবদ্ধতা দূর করা মানে হলো সড়কে যেন বৃষ্টির পানি না দাঁড়ায়। বৃষ্টির পানি থেকে সড়ককে রক্ষার জন্য লক্ষ-কোটি বাসিন্দার ঘরবাড়ি, অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সব পানিতে ডুবে গেলেও কোনো সমস্যা নেই তাতে।

এসব কাণ্ড দেখে স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া যায়, স্থানীয় প্রশাসনের প্রকৌশলী, বিশেষজ্ঞ ও নীতিনির্ধারক ব্যক্তিবর্গ হয়তো ভুলে গেছেন এক সময় আমাদের দেশের সকল নগর, শহর বা গ্রামে ছিল অগণিত জলাশয়, পুকুর-ডোবা, খাল-বিল। প্রবাহিত হতো বহু নদ-নদী। এগুলোর মাধ্যমে সহজেই বর্ষার পানি নিষ্কাশিত হতো লোকালয় থেকে। কিন্তু অব্যাহত দূষণ, ভোগদখল আর অপরিকল্পিতভাবে সেতু, স্লুইসগেট বা বাঁধ নির্মাণের ফলে সেই জলাধারগুলোর কোনো কোনোটির নাব্যতার হার হয় শূন্যের কোঠায় পৌঁছেছে, নয় তো হারিয়ে গেছে ইতিহাসের গর্ভে।

খোদ রাজধানী শহর ঢাকার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনাও এক সময় টিকে ছিল বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদী এবং অর্ধশতাধিক খালের ওপর। তবে বর্তমানে এর অধিকাংশই অস্তিত্বহীন। এর ফলে বর্তমানে ঘণ্টায় ১০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেই ঢাকার দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

এরপরও ঢাকার সিটি কর্পোরেশনদ্বয়ের সংশ্লিষ্টরা এই বিষয়ে নজর দিচ্ছেন না। বরং গত ১০ বছরে দুবার রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকার সড়ক ও ড্রেন উঁচু করে জলাবদ্ধতা দূর না হওয়া সত্ত্বেও চলতি বছরে তৃতীয়বারের মতো এলাকাটির সড়ক উঁচু করার কাজ হাতে নিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।

রাজধানীর মতো খুলনা মহানগরীরও একই দশা। খুলনা জেলা প্রশাসন প্রায় চার বছর আগে খুলনা অঞ্চলের ২৬টি খাল-বিলের প্রায় ৪৬০ জন অবৈধ ভোগদখলকারীকে চিহ্নিত করেছিল। তবে পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ আর নেওয়া হয়নি।

অপর দিকে, ২০১৮ ও ২০২৩ সালে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের তৎকালীন মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক খুলনা নগরীর জলাবদ্ধতা দূরীকরণে ৮২৩ কোটি টাকার মেগা প্রকল্প হাতে নেন। কিন্তু সাড়ে পাঁচ বছরে এই প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৬০০ কোটি টাকা ব্যয় করে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সড়ক ও ড্রেন উঁচু করা এবং একটি খাল খনন করা হলেও আশানুরূপ কোনো ফলই মেলেনি। বরং চলতি বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই ‘যে-ই লাউ, সে-ই কদু’ হয়ে গেছে। উল্টো ‘মড়ার ওপর খড়ার ঘা’ হিসেবে এখন মহানগরীর নিচু এলাকাগুলোর অনেক বাসিন্দাদের বাড়িঘর ও দোকানপাটে পানি প্রবেশ করছে।

জলাবদ্ধতা নিরসনে দেশের যে যে এলাকায় শুধু সড়ক উঁচু করা হয়েছে, সবখানকার চিত্রই এমন। কিন্তু এরপরও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা কীভাবে ঢেলে সাজানো যায় তা নিয়ে কথা বলছেন না কেউই। সকলেই পড়ে আছেন জলাবদ্ধতা হলেই সড়ক উঁচু করার ফলহীন সহজ ট্যাকটিক্স নিয়ে।

অথচ বিশ্বের প্রখ্যাত নগরবিদদের মতে, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অযাচিতবে জলাধার দখল ও ভরাট এবং নিয়মিতভাবে নালা বা ড্রেনসমূহ পরিষ্কার না করার কারণেই সাধারণত জলাবদ্ধতা ধীরে ধীরে প্রকট আকার ধারণ করে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রয়োজন দখলকৃত জলাধার পুনরুদ্ধার এবং পুনঃখননে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ। ড্রেনেজ ব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়নও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে এ ক্ষেত্রে।

পাশাপাশি, জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেনে পানির স্বাভাবিক প্রবাহে বাধার সৃষ্টিকারী পলিথিন, প্লাস্টিক বা এ ধরনের কঠিন অপচনশীল বর্জ্য এবং অপরিশোধিত মানব বর্জ্য সরাসরি ফেলার বিষয়ে জনসাধারণকে সচেতন করা তোলা সমানভাবে অপরিহার্য। কেননা জলাবদ্ধতা দূরীকরণে জনগণের টাকা অপচয় করে সড়ক আর ড্রেন উঁচু করার পর আবারও জনগণকেই জলাবদ্ধ করে ফেলা কখনোই কাম্য হতে পারে না।

লেখক: কবি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট। মেইল : rusaidahmed02@gmail.com

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!