শেখ রাজ্জাক আলী। জাতীয় সংসদের সাবেক স্পীকার। খুলনার দক্ষ রাজনীতিক। খ্যাতিমান আইনজীবী। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখেন। মৃত শেখ এনতাজ আলী তার পিতা এবং মৃত কাজী গোলসিআরা বেগম তার মা।
১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্নে তিনি দৌলতপুর হিন্দু একাডেমীর শিক্ষার্থী ছিলেন। তখন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ছাত্র সংগ্রাম ও ছাত্র ফেডারেশন হিন্দু একাডেমীতে ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলে। ঐ সময়ের দিনগুলোতে হিন্দু একাডেমীর খুলনা শহরের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন চলাকালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। ভাষা আন্দোলন সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। খুলনায় জনমত সৃষ্টিতে অসামান্য অবদান রাখেন। ১৯২৮ সালের ২৮ আগস্ট খুলনার পাইকগাছা থানার হিতামপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৫ সালে বিজ্ঞানী স্যার পিসি রায়ের প্রতিষ্ঠিত আর কেবিকে হরিশচন্দ্র ইন্সটিটিউশন থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। পরে তিনি দৌলতপুর হিন্দু একাডেমী থেকে ১৯৪৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক ও ১৯৪৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম এ ও ১৯৫৪ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল এল বি ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৬৭ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম এ ডিগ্রী লাভ করেন।
১৯৫৩ সালে দি ডেইলী পাকিস্তান পোস্ট পত্রিকার সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৯৫৪ সালে দি ডেইলী পাকিস্তান অবজারভারে চীফ রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৮ সালে খুলনা জেলা আদালতে আইনজীবী হিসেবে যোগদিয়ে পেশা পরিবর্তন করেন। ১৯৬৫ সালে খুলনা ল’ কলেজ প্রতিষ্ঠা হলে তিনি প্রথমে উপাধ্যক্ষ, ১৯৬৮-১৯৯১ পর্যন্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৮-৭২ পর্যন্ত ন্যাপ ১৯৭২-৭৪ পর্যন্ত জাসদের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৬৪ সালে খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ৭২ সালে সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আন্তর্জাতিক রেডক্রসের প্রতিনিধি হিসেবে হাসনাবাদ ও বসিরহাট ক্যাম্পে যুদ্ধে আহদের চিকিৎসা সেবা মনিটরিং করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি কারাবন্দী হন। ১৯৭৮ সালে মার্কসবাদ দর্শন ত্যাগ করে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৮৪-৮৫ ও ৮৫-৮৬ সালে যশোরে অবস্থিত হাইকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলেন।
১৯৭৮-২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি’র রাজনীতি আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। ১৯৭৯-৯৬ পর্যন্ত খুলনা জেলা বিএনপি’র সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২-১৯৯০ পর্যন্ত স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৯ সালে বিএনপি’র মনোনয়নে খুলনা-৬ আসন, ১৯৯১-১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন খুলনা-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে আইন প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৯১ সালের ১২ অক্টোবর পঞ্চম সংসদে স্পীকার হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তার আগে তিনি ডেপুটি স্পিকার ছিলেন। ১৯৯২ সালে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন স্পীকার নির্বাচিত হওয়ার পর দলীয় দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন।
২০০৬ সালে বিএনপি থেকে পদত্যাগ করে এলডিপিতে যোগ দেন। তিনি এলডিপির প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান। মহিলা আলিয়া মাদ্রাসা, পাইকগাছা ডিগ্রী কলেজ, সবুরন নেসা মহিলা মহাবিদ্যালয়, বয়রা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, হাজী ফয়েজউদ্দিন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, পশ্চিম টুটপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বাগমারা শহিদ জিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও পাইকগাছা শহিদ জিয়া বালিকা বিদ্যালয়, শিরোমনিস্থ খুলনা চক্ষু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদান রাখেন। খুলনার এম এম সিটি কলেজ, সুন্দরবন কলেজ ও পাইওনিয়ার মহিলা মহাবিদ্যালয় সরকারিকরণের কৃতিত্ব তারই। ১৯৯২ সালে তার পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে খুলনা ফাউন্ডেশন। উনসত্তরের ও নব্বইয়ের গণঅভ্যুথানে খুলনায় প্রথম সারির নেতৃত্বে ছিলেন। খুলনা বিশ্ববিদল্যায় ও পীর খানজাহানা আলী (রহঃ) সেতু স্থাপনের সক্রিয় ভুমিকা রাখেন।
সরকারি সুন্দরবন মহিলা মহাবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত উপাধ্যক্ষ বেগম মাজেদা আলী তার স্ত্রী। পাইকগাছা উপজেলা সদরে সিনিয়র সহকারী জজ ও থানা ম্যাজিস্ট্রেট আদালত স্থায়ীকরণে তার ভুমিকা উল্লেখযোগ্য। ২০১৫ সালের ৭ জুন তিনি ইন্তেকাল করেন। হিতামপুর পৈত্রিক ভিটেয় তার দাফন হয়।
খুলনা গেজেট/এএজে