খুলনা, বাংলাদেশ | ৩রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১৭ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

Breaking News

  আজ খোলা থাকবে সরকারি অফিস
  মাদারীপুরের বাহেরচর কাতলায় বাল্কহেডের ধাক্কায় ট্রলারের বেশ কয়েকজন নিখোঁজ
  কক্সবাজার থেকে ছেড়ে আসা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের চাকা খুলে গেছে, ৭১ জন যাত্রী নিয়ে শাহজালালে জরুরি অবতরণ

ফারাক্কা চালুর পর ৫০ বছরে পদ্মায় পানিপ্রবাহ ক‌মে‌ছে ৮০ শতাংশ

গেজেট ডেস্ক

ভারতের ফারাক্কা বাঁধ চালুর পর গত ৫০ বছরে পদ্মার পানিপ্রবাহ ৮০ শতাংশ কমে গেছে। পদ্মা নদী শুকিয়ে বাকি আছে মাত্র ২০ শতাংশ। ফারাক্কার প্রভাবে দেশের দুই হাজার কিলোমিটার নৌপথ বন্ধ হয়ে গেছে। সুন্দরবনের ১৭ শতাংশ এলাকাজুড়ে লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়েছে। কর্মসংস্থান ও জীবিকা হারিয়েছে হাজার হাজার মানুষ। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি সীমাহীন। আর্থিক দিক থেকে বাংলাদেশ প্রায় পৌনে তিন লাখ কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের তথ্যে এ চিত্র ফুটে উঠেছে।

ভারতের ফারাক্কা বাঁধ চালুর ৫০ বছর পার হয়েছে। গঙ্গার পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহারের জন্য ভারত এ বাঁধ চালু করেছিল মাত্র ৪০ দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে। কিন্তু এ সময়সীমা ৫০ বছর ছাড়িয়ে গেছে। ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করেই চলেছে। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও আইন ভঙ্গ করে ১৯৭৫ সালের ১৬ মে তারা চালু করে এই ফারাক্কা বাঁধ।

পানি বিশেষজ্ঞ ও পানি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্যে বলা হয়, ফারাক্কা বাঁধের উজানে আরো ছোট-বড় ৩০টি ক্যানেল খননের মাধ্যমে ভারত একতরফাভাবে গঙ্গায় প্রবাহিত পানির ৮০ শতাংশ বেআইনিভাবে প্রত্যাহার করেছে। এতে এক সময়কার প্রমত্তা পদ্মা শুকিয়ে বাকি আর কিছু নেই।

নদী গবেষক ও পানি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক নদীশাসন ও পানিপ্রবাহ আইন অনুযায়ী ভারত ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহারের এখতিয়ার রাখে না। তৎকালীন শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের মতামত নিয়ে এ বাঁধ চালু করতে হয়েছিল। শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ফারাক্কা অভিমুখে ঐতিহাসিক লংমার্চ করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। ওই বছর অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ফারাক্কা সমস্যা পেশ করে আলোড়ন সৃষ্টি করেন বলে জানান গবেষকরা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী বছর ভারত গঙ্গাচুক্তি নবায়ন করতে সম্মত হলে সেখানে অবশ্যই ফারাক্কা পয়েন্টে পানিপ্রবাহের বিষয়ে গ্যারান্টি ক্লজ রাখতে হবে। এটি ছাড়া চুক্তি নবায়নের কোনো যৌক্তিকতা নেই। প্রয়োজনে চুক্তি থেকে বেরিয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জোরালো আপত্তি তুলে ধরারও পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

অভিশাপ আর প্রতারণার ৫০ বছর

৫০ বছর আগে ভারত যখন ফারাক্কার বুকে বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়, তখনও পদ্মার দুই পাড়ের বাসিন্দারা এর ভয়াবহ পরিণতি বুঝে উঠতে পারেননি। দিন গড়াতে থাকে আর আমাদের জীবনে অভিশাপ হয়ে নেমে আসে এ বাঁধ। ভারত শুধু পদ্মার পানিই প্রত্যাহার করেনি, পাশাপাশি আমাদের সুখও কেড়ে নিয়েছে। আমাদের জীবিকাও নিয়েছে।

ফারাক্কার বাঁধ প্রকল্প পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণ করা হয়। এক কোটি বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে প্রকল্পটি নেওয়া হয় ১৯৬২ সালে। ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে সাত হাজার ৫৫৯ ফুট দীর্ঘ এ বাঁধের নির্মাণকাজ শেষ হয়।

আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির সভাপতি মোস্তফা কামাল মজুমদার জানান, ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে ভারত বাংলাদেশের শেখ মুজিবের সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে পরীক্ষা চালানোর কথা বলে ৪০ দিনের জন্য ফারাক্কা বাঁধটি কার্যকর করে গঙ্গার পানিপ্রবাহ সীমিত করে দেয়। ৪০ দিনের মধ্যে শেখ মুজিব নিহত হলে বাংলাদেশের সরকারে পরিবর্তন আসে। এরপর ভারত তার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে যায়। ভারত মূলত ওই সময় থেকে এ বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছে বলে জানান মোস্তফা কামাল।

ফারাক্কার অভিশাপ ও ভারতের কূটকৌশলের বিবরণ তুলে ধরে সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ জানান, ভারত অভিন্ন ৫৪ নদীর উজানে অবৈধভাবে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। আমাদের দেশের ওপর অনেক ধরনের আগ্রাসন চালাচ্ছে। এর মধ্যে আমরা ভারতের তীব্র পানি আগ্রাসনের শিকার। তিনি বলেন, আমি যতদিন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলাম, ভারতকে এটা বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে, ফারাক্কার পানির ন্যায্য হিস্যা আমাদের অধিকার। এতে ভারতের অনুগ্রহের বিষয় যুক্ত নয়। আমরা কোনোভাবেই আমাদের অধিকার ছাড় দিতে পারি না। কারণ গঙ্গা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এ নদীর পানির ওপর ভারতের যতটুকু অধিকার রয়েছে, আমাদের অধিকার সে তুলনায় কম নয়। কিন্তু ভারত কখনোই আমাদের অধিকারকে মূল্যায়ন করেনি। আমাদের ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করে আসছে।

পানিবণ্টন ইস্যুতে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকগুলোর আলোচনায় ভারত নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে, যা সম্পূর্ণ কূটনৈতিক রীতিনীতি-পরিপন্থী উল্লেখ করে মেজর হাফিজ জানান, ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যাতে কোনো আপত্তি না করে সেজন্য তারা গত সাড়ে ১৫ বছর আমাদের দেশে ভারতের পদলেহনকারী সরকার বসিয়ে রেখেছিল। ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ভারতকে একতরফা সুবিধা দিয়ে শেখ হাসিনার করা ৩০ বছর মেয়াদি ফারাক্কা চুক্তির কার্যকাল শেষ হচ্ছে। এ চুক্তি আমাদের আন্তর্জাতিক ফোরামে যাওয়ার পথে অন্তরায় ছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে এখন থেকেই জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করা।

ভারতের বাঁধের কারণে পানির প্রবাহ ৮০ ভাগ কমেছে

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ভারত ফারাক্কা ব্যারাজ ছাড়াও গঙ্গা বেসিনকে কেন্দ্র করে সাতটি বড় খাল প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৪০ হাজার কিউসেক পানি গঙ্গা নদী থেকে অবৈধভাবে সরিয়ে নিচ্ছে। শুধু ফারাক্কা নয়, গঙ্গা-পদ্মাকেন্দ্রিক বাঁধ, জলাধার, ক্রসড্যাম, রেগুলেটরসহ কমপক্ষে ৩৩টি মূল অবকাঠামো নির্মাণ করছে ভারত। এর সঙ্গে রয়েছে আনুষঙ্গিক আরো অসংখ্য ছোট-বড় কাঠামো। নতুন করে উত্তরাখণ্ডের রাজ্য সরকার ৫৩টি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বলেও জানান পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, বিভিন্ন তথ্যউপাত্ত ও আদি নথিপত্র পর্যালোচনা করে আমরা নিশ্চিত হয়েছি, ১৯৭৫ সালে এ বাঁধ চালুর আগে গঙ্গার মাধ্যমে যে পরিমাণ পানির প্রবাহ ছিল, ৫০ বছরের মাথায় এসে বর্তমানে তা ৮০ ভাগ কমে গেছে।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র আরো জানিয়েছে, ভারত গঙ্গা ব্যারাজের উজানে ‘আপারগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘নিম্নগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘পূর্ব গঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল দ্বিতীয় পর্যায়’ এবং ‘সমান্তরাল নিম্ন গঙ্গা ক্যানেল’ প্রকল্পের মাধ্যমে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করছে। এসব বৃহৎ ক্যানেলের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করে আরো কিছু সেচ ও বিদ্যুৎ প্রকল্প করেছে নিজেদের ভূখণ্ডে। এর মধ্যে রয়েছে ইস্ট গঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট, আগ্রা গঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট, ইস্টার্ন ইয়ামুনা (যমুনা) ক্যানেল প্রজেক্ট, ওয়েস্টার্ন ইয়ামুনা ক্যানেল প্রজেক্ট, বেতওয়া ক্যানেল প্রজেক্ট, ধাসান ক্যানেল প্রজেক্ট, কেন ক্যানেল প্রজেক্ট, ঘাগর ক্যানেল প্রজেক্ট, সারদা ক্যানেল প্রজেক্ট, তেহরি ড্যাম প্রজেক্ট, লাখওয়ার ড্যাম প্রজেক্ট, তপোবন ভিষ্ণুগড় প্রজেক্ট, রামগঙ্গা মালটিপারপাস প্রজেক্ট, ধালিপুর হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট, রাইহান্ড ড্যাম, চিলা হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট, তানাকপুর ব্যারাজ, কিসাউ ড্যাম, মানেরি ভালি হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট, খারা হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট, খোদরি হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট, ছোবরো হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট, রাজঘাট ড্যাম, হালালি ড্যাম, গান্ধী সাগর ড্যাম, রাণাপ্রতাপ সাগর ড্যাম, জাওহার সাগর ড্যাম, চম্বল ভ্যালি প্রজেক্ট, ওবরা ড্যাম, বনসাগর টোনস ড্যাম, পার্বতি ড্যাম, মাতাতিলা রিজার্ভার, রামসাগর ড্যাম, মাশানজোড় রিজার্ভার, ধাউলিগঙ্গা পাওয়ার প্রজেক্ট, তিলাইয়া ড্যাম, কনোর ড্যাম, মাইথোন ড্যাম এবং পানচেট ড্যাম।

একটি গবেষণা সংস্থা জানিয়েছে, ভারত ভাগীরথী নদীর ওপর জঙ্গিপুরের কাছে ৩৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ফিডার ক্যানেল নির্মাণ করেছে। জঙ্গিপুর ব্যারাজ নামে এ প্রকল্পের লক্ষ্যই হলো ফারাক্কা পয়েন্টের ৪০ হাজার কিউসেক পানি হুগলি ও ভাগীরথী নদীতে সরিয়ে নেওয়া। ফলে একদিকে হুগলি নদীর নাব্য বৃদ্ধি পেয়ে কলকাতা পোর্ট সারা বছর সচল থাকবে, অন্যদিকে ভাগীরথী নদীর বাড়তি পানি ব্যবহার করে বিস্তীর্ণ এলাকায় সেচ সুবিধা বৃদ্ধি করা যাবে। এ ছাড়াও ফারাক্কার উজানে উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের কানপুরে গঙ্গার ওপর আরেকটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে সেচের জন্য প্রায় ৪০০ পয়েন্ট থেকে পানি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। পরিণতিতে ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রবাহ কমে গেছে। ভারত সেচ ও পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মূল গঙ্গা এবং এর উপনদীগুলোর ৯০ ভাগ পানি সরিয়ে নিচ্ছে। ফলে নদীতে পানি প্রবাহিত হতে পারছে মাত্র ১০ ভাগ।

গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের বিষয়ে যৌথ নদী কমিশনের সদস্য ড. মোহাম্মদ আবুল হোসেন বলেন, আমরা ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সব আলোচনায় পানির ন্যায্য হিস্যার বিষয়টি এজেন্ডাভুক্ত করার চেষ্টা করি। সর্বশেষ ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের ঢাকা সফরের সময়ও আমরা এ বিষয়গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। বর্তমান সরকারও ভারতের কাছ থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। কারণ আমাদের সেচ প্রকল্পগুলোর জন্য অভিন্ন নদীর পানির উৎস সচল রাখা অত্যন্ত জরুরি।

জিয়ার হাত ধরে আন্তর্জাতিক ফোরামে ফারাক্কা ইস্যু

নদী গবেষকদের মতে, শেখ মুজিব সরকারের অনুমোদন নিয়ে ভারত সাময়িকভাবে ফারাক্কা বাঁধ চালু করে তা আর বন্ধ করেনি। প্রথম বছর থেকেই এ বাঁধের বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের ওপর পড়তে থাকে। পদ্মায়ও পানিপ্রবাহ কমে যায়। কারণ ভারত প্রথম বছরেই ৪০ হাজার থেকে এক লাখ কিউসেক পানি প্রত্যাহার গঙ্গা থেকে।

১৯৭৬ সালের পুরো বছর ফারাক্কার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে জোরালো আপত্তি পেশ করতে থাকে বলছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক জসিম উদ্দিন আহমাদ।

ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরতে ওই সময় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান পানি ও নদী বিশেষজ্ঞ বিএম আব্বাসকে পুরোপুরি কাজে লগিয়েছিলেন। অধ্যাপক জসিম এ বিষয়ে জানান, আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৭৬ সালের মে মাসে তুরস্কের ইস্তানবুলে ৪২ জাতি শীর্ষক ইসলামিক পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ব্যক্তিগতভাবে ফারাক্কা সমস্যাটি উত্থাপন করেন। একই বছরের আগস্টে কলম্বোতে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ ফারাক্কা প্রশ্ন উত্থাপন করে ন্যাম সদস্যদের সহানুভূতি অর্জনে সমর্থ হয়েছিলেন।

অধ্যাপক জসিম উদ্দিন জানান, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান অবশ্য ১৯৭৬ সালের শুরু থেকে ফারাক্কার দিকে কঠোরভাবে মনোযোগ দেন। ওই বছরের ১৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানায়। ৩ ফেব্রুয়ারি আবারও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রতিবাদলিপি পাঠানো হয়। এতে গঙ্গার স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্ন সৃষ্টিকারী যেকোনো প্রচেষ্টা থেকে ভারতকে বিরত থাকতে বলা হয়।

আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির সভাপতি মোস্তফা কামাল মজুমদার জানান, বাংলাদেশের দুটি চিঠিকে ভারত গুরুত্ব না দেওয়ায় জিয়ার সরকার জাতিসংঘে ফারাক্কা সমস্যা উত্থাপনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭৬ সালের ২১ আগস্ট জাতিসংঘের ৩১তম অধিবেশনের আলোচ্যসূচিতে ফারাক্কা সমস্যাকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে মহাসচিবকে অনুরোধ করে।

মোস্তাফা কামাল জানান, বাংলাদেশের অনুরোধে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৩১তম অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে ফারাক্কা প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যায় যে, ফারাক্কা সমস্যার জরুরি সমধান আবশ্যক।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ জানান, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার চাপে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে ১৯৭৭ সালের ৫ নভেম্বর পাঁচ বছর মেয়াদি একটি চূক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। ওই চুক্তিতে গ্যারান্টি ক্লজ ছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার ১৯৯৬ সালে ভারতের সঙ্গে যে চুক্তি করেন, তাতে ফারাক্কা পয়েন্টে পানিপ্রবাহের কোনো গ্যারান্টি ক্লজ নেই। ফলে ভারত উজানে বাঁধ দিয়ে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহারে করে নিচ্ছে। বাংলাদেশ পানি থেকে বঞ্চিত হওয়ার পর আন্তর্জাতিক কোনো ফোরামে আপত্তি করতে পারছে না বলে অভিযোগ করেন রিজভী আহমেদ।

তিনি বলেন, ভারত অভিন্ন ৫৪টি নদ-নদীর পানিবণ্টন নিয়ে ‘চণ্ডালনীতি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের বিষয়ে ভারতের বর্তমান নীতিকে তাদের দীর্ঘদিনের চানক্যনীতির নিকৃষ্টতর চর্চা বলেও অভিহিত করেন মওলানা ভাসানীর লংমার্চে অংশ নেওয়া জাতীয়তাবাদী এই নেতা।

পদ্মায় ধু-ধু বালুচর

রাজশাহী অঞ্চলের কয়েকজন বয়োবৃদ্ধের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গঙ্গা নদীতে ভারত যে বছর নির্মিত বাঁধটি চালু করে, ওই সময় তাদের বয়স ছিল ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। তাদের কেউ কেউ পদ্মায় মাছ ধরে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতেন। পদ্মার সেই সময়কার কথা বলতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন তারা। বলেন, পদ্মায় যখন পানি ছিল, তখন মাছও ছিল। এখন পানি নেই, মাছও নেই। বাধ্য হয়ে অন্য পেশায় গিয়ে জীবন পার করেছি।

রিভাইন পিপলের মহাসচিব ও নদী গবেষক শেখ রোকন বলেন, উজানে ভারতের ফারাক্কা বাঁধ চালুর আগের সময়ের চেয়ে বর্তমান সময়ে এসে আমাদের প্রধান নদী পদ্মায় পানিপ্রবাহ কমেছে ৮০ শতাংশ। ১৯৭৫ সালের আগের তুলনায় এখন এ নদীতে পানি প্রবাহিত হচ্ছে মাত্র ২০ ভাগ। একটি নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে এ পানি খুবই কম।

আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির সভাপতি মোস্তফা কামাল মজুমদার জানান, ১৯৯৭ সালে চুক্তিটি কার্যকর হওয়ার প্রথম বছরেই ৩০ হাজার কিউসেক সম্মত পরিমাণের বিপরীতে বাংলাদেশ পেয়েছিল মাত্র ছয় হাজার কিউসেক পানি। গঙ্গার স্বাভাবিক প্রবাহের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ নিয়ে গঠিত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল মারাত্মক পরিবেশগত অবক্ষয়ের শিকার হয়েছে। গত পাঁচ দশকে গঙ্গার শাখা নদীগুলো মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে। কৃষি, শিল্প, মৎস্য মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এবং নদী-যোগাযোগ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। বদলে গেছে মানুষের পেশা, জীবন ও জীবিকা। সুন্দরবনে মিঠাপানি প্রবাহের অনুপস্থিতি সমুদ্র থেকে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ বাড়িয়েছে এবং মানবজাতির একটি ঐতিহ্য ম্যানগ্রোভ বনকে ধংসের মুখে ফেলেছে।

বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) তথ্যানুযায়ী, পদ্মা নদী মরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শাখা নদী বড়াল, মরা বড়াল, নারোদ, মুছাখান, ইছামতি, চিকনাই, নাগর, ধলাই, গড়াই, মাথাভাঙ্গা, হিসলা, কাজলা, চিত্রা, সাগরখালি, চন্দনা, কপোতাক্ষ মরে যাচ্ছে। কালীগঙ্গা, বেলাবত এসব নদীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুমে কিছুদিনের জন্য এসব নদীতে পানি থাকলেও প্রায় সারা বছর থাকে পানিশূন্য। তা ছাড়া এসব নদী মরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুই পাশ অবৈধভাবে দখল হয়ে গেছে। দেশের নদী এতটা বিপন্ন হয়েছে, যেন এখন এসব নদীর নাম বইয়ের পাতায় কিংবা মানচিত্রে স্থান পেয়েছে ।

প্রতিষ্ঠানটির এক গবেষণায় জানানো হয়েছে, ১৯৮৪ সালের তুলনায় শুকনা মৌসুমে পদ্মা নদীর আয়তন কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। পানির গভীরতা কমেছে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রবাহ কমেছে ২৬ দশমিক ২ শতাংশ। আর মিঠাপানির সরবরাহ সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। পদ্মা অববাহিকায় বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১৯ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে।

এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাংখা পয়েন্ট থেকে ঈশ্বরদী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পর্যন্ত ২০০ মাইলজুড়ে পদ্মা এখন খালে রূপ নিতে শুরু করেছে। চরাঞ্চলের বাসিন্দারা বলছেন, মাসতিনেক ঠিকমতো পানি থাকে পদ্মায়। বছরের বাকি সময় পানির জন্য হাহাকার পড়ে যায়। ঠিকমতো নৌকাও চলে না। কখনো কিছুটা হেঁটে উঠতে হয়।

রাজশাহী নগরীর পদ্মার তীরবর্তী তালাইমারী বালুঘাট এলাকার বাসিন্দা ৭৫ বছরের মোসলেম আলী জানান, সত্তরের দশকে উত্তাল পদ্মার গর্জন ছিল ভয়ংকর। পদ্মার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত দেখা যেত না। প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। এখন এসবই অতীত।

জেলার চারঘটা উপজেলার ৭২ বছর বয়সি ইদ্রিস আলী বলেন, পাকিস্তান আমল থেকে বাবার সঙ্গে মাছ ধরা শুরু করি। এরপর দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও নদীতে সব সময় পানি থাকত। এখন ধু-ধু বালুচর দেখে খারাপ লাগে।

সূত্র : আমার দেশ

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!