সালটা সম্ভবত ২০১২/’১৩ সালের দিকে। আমি তখন চট্টগ্রাম বিনিয়োগ বোর্ডের পরিচালক পদে। দীর্ঘ দিন ছিলাম সেখানে। এক নাগাড়ে প্রায় সাড়ে আট বছর। আমাদের চেয়ারম্যান ছিলেন তখন ড. এস এ সামাদ স্যার। নামকরা এবং তুখোড় সিএসপি অফিসার। চট্টগ্রামে জেলা প্রশাসক থাকাকালীন মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। ওনাকে এত ভয় পেতাম যে, ধারে কাছেও ঘেষতাম না। অত্যন্ত কম কথা বলতেন। শুধু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয়া ছাড়া কোনো শব্দ উচ্চারণ করতাম না।
স্যার একবার অফিসিয়াল কাজে গেলেন চট্টগ্রাম। তিনি ঢাকার বাইরে পুলিশ প্রটেকশন পেতেন। প্রতিমন্ত্রীর পদ মর্যাদায় ছিলেন। ওনাকে রিসিভ করে ওনার গাড়িতে তুলে দিয়েই প্রায় পালিয়ে আমার গাড়ির দিকে রওনা দিতেই উনি ডেকে ওনার গাড়িতে পাশে বসার জন্য বললেন। আল্লাহর নাম জপতে জপতে ওনার পাশে ঘাপটি মেরে বসলাম।
উনি মাঝে মাঝে কথা বলছেন, আমি ছোট্ট করে উত্তর দিচ্ছি। চট্টগ্রামের বিনিয়োগ পরিস্থিতি এবং সমস্যা নিয়ে জানতে চাইলেন। বললাম, চট্টগ্রামে জায়গার অভাবে বিদেশি বিনিয়োগ ব্যহত হচ্ছে স্যার। ইপিজেড এর সব জমি শেষ হয়ে যাওয়ায় সমস্যাটা বেশি হচ্ছে।
এবার অতি উৎসাহে সুযোগ পেয়ে হঠাৎ করে বলে বসলাম, কোরিয়ান ইপিজেড এর খবর কী স্যার। চট্টগ্রাম ডিসি অফিসে অনেকবার খোঁজ নিয়েছি। ২৫০০ একরের পুরো পেমেন্ট নিয়েছে সরকার, অথচ বহুদিন থেকে ফাইল ঝুলে আছে, জমি রেজিস্ট্রি করে দেয়া হচ্ছে না। এডিসি রেভিনিউ বলেছে, পিএম অফিস থেকে রেজিস্ট্রি বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।
তিনি কোনো উত্তর দিলেন না। বুঝলাম, বিব্রত করে ফেলেছি স্যারকে।
কিছুক্ষণ পর হতাশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি যা বললেন, তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। যদিও বিষয়টি জানতাম আমরা সবাই। প্রচন্ড আফসোস ছিল আমাদের সবার মাঝে। কিন্তু স্যারের মুখ থেকে শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম।
স্যার বললেন, “মাহবুব মৃত্যু পর্যন্ত একটা আফসোস যাবে না আমার।”
শুধু বললাম স্যার।
“কোরিয়ার স্যামসাং এর মোবাইল কারখানা দেয়ার বিলিয়ন বিলিয়িন ডলারের বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রস্তাব ধরে রাখতে পারিনি আমরা। অনেক চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু কারো সাহায্য পাইনি। বাধ্য হয়ে ফিরে গেছে তারা ভিয়েতনামে। আমাদের দাবী পুরণ করা সম্ভব নয় তাদের পক্ষে।”
দাবী কী ছিল, কাদের ছিল, তা আমরা অনেকেই জানতাম। বুকটা দুমড়ে মুচড়ে গেল। দেশের এতবড় ক্ষতি কেউ করতে পারে!!
গাড়ি ছুটে চলেছে শহরের দিকে। আমাদের কারো মুখে কোনো কথা নেই।
২৫০০ একর জমির পুরো টাকা জমা নেয়ার পরেও কেন জমির দলিল করে দেয়া হচ্ছে না, এই বিষয় নিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে পিএম অফিস, চেয়ারম্যান পিপিপি (পাবলিক–প্রাইভেট পার্টনারশি), চট্টগ্রাম ডিসি অফিস প্রায় ফানাফানা করে ফেলেছিলাম। কারণ সেই সময় এফডিআই বাড়াবার জন্য প্রচুর জমির দরকার ছিল। যেটা ছিল কোরিয়ান ইপিজেড এ। কিন্তু জমির দলিল না হওয়ায় কোনো ইনভেস্টমেন্ট আসছিল না সেখানে।
মজার বিষয় হচ্ছে, এই কোরিয়ান ইপিজেড এর জমি নিয়ে যাদের পিছনেই লেগেছিলাম তাদেরই মুখ চেহারা শুকিয়ে যেত। আর মোবাইল রিসিভ করত না কেউ। পালিয়ে বেড়াত আমার কাছ থেকে।
একবার চট্টগ্রাম ভিজিটে আসলেন সেই সময়ে পিপিপি’র চেয়ারম্যান সাহেব। নাম ভুলে গেছি। সম্ভবত ইংল্যান্ড থেকে তাঁকে আনা হয়েছিল। তিনি বসতেন পিএম অফিসে। প্রধানমন্ত্রীর সাথে তাঁর খুব ভাল সম্পর্ক। তাই দেখা হবার পর তাঁকে কোরিয়ান ইপিজেড নিয়ে বললাম। তিনি সম্ভবত বিষয়টি জানতেন না। আমাকে কথা দিলেন এবং বীর দর্পে ঘোষণা দিলেন, ঢাকা ফিরে গিয়েই জমি রেজিস্ট্রি করার ব্যবস্থা করে দেবেন। এক সপ্তাহ পর তাকে ফোন দেয়ার জন্য বললেন।
আমার আনন্দের সীমা নেই। কিন্তু আমি মোটেই বুঝতে পারনি, উনি আর আমার ফোন ধরবেন না কোনোদিন। দেখাও হয়নি আর।
কার নির্দেশে আটকে রাখা হয়েছিল জমির রেজিস্ট্রি, তা ভাল করেই জানতাম। এরপরেও অনবরত চেষ্টা করে গিয়েছিলাম।
এর অনেক বছর পর ভিয়েতনাম, মায়ানমার, মালয়েশিয়াকে টেক্কা দিয়ে আমাদের এফডিআই বাড়াবার জন্য একটা পরামর্শ ফেসবুকে লিখেছিলাম। এরজন্য মামলা করা হয়েছিল আমার বিরুদ্ধে। সেটার কাহিনী আর একদিন বলব।
(ফেসবুক ওয়াল থেকে)
খুলনা গেজেট/এনএম