আমাদের দেশে প্রতি কেজি গরুর মাংস কিনতে ভোক্তাদের সধারণত কমপক্ষে ৫৮০-৬৫০ টাকা গুনতে হয় কিংবা খাসি বা ছাগলের মাংসও ৮০০ টাকার ওপরে থাকে প্রায়শই। এর বিপরীতে, গাজীপুর মহানগরের হায়দারাবাদের দুই বন্ধু মো. শফিকুল ইসলাম ও নূরুল্লাহ মামুনের বদৌলতে সম্প্রতি মাত্র ২৫০-৩০০ টাকায় প্রতি কেজি ঘোড়ার মাংস পাচ্ছেন ক্রেতারা। যা বাংলাদেশের মাংস বাজারে সৃষ্টি করেছে নতুন আলোড়নের।
ফলে অনেকেই সস্তায় মাংসের চাহিদা মেটাতে ঘোড়ার মাংসের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন কোনোরূপ বাছ-বিচার না করে। এই প্রসঙ্গের সঙ্গে তাই দেখা দিচ্ছে নানাবিধ প্রশ্ন। বাংলাদেশে ঘোড়ার সংখ্যা সীমিত হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে এত মাংস আসছে? নৈতিকভাবে দুর্বল আমাদের কতিপয় মাংস ব্যবসায়ীদের গরুর বদলে ঘোড়ার মাংস বিক্রি করার কোনো সুযোগও এর মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে না তো? পাশাপাশি, ইসলামি দৃষ্টিকোণ, পুষ্টিগুণ, এবং জনস্বাস্থ্যের বিষয়গুলোও বিবেচনার দাবি রাখছে।
ঘোড়া, গরু ও ছাগলের মাংস: পুষ্টিগুণে কোনটি এগিয়ে?
যুগ যুগ ধরে প্রাণিজ আমিষের প্রধান উৎস হিসেবে গরু ও ছাগলের মাংস বাংলাদেশি খাদ্য সংস্কৃতির অংশ বিরাজ করছে। গরু ও ছাগলের মাংসে উচ্চমাত্রার প্রোটিন, আয়রন, জিঙ্ক, ভিটামিন বি-১২ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান রয়েছে। এগুলো মানবদেহের পেশি গঠন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে, ঘোড়ার মাংসেও আমিষ এবং লৌহ থাকলেও তা গরু ও ছাগলের মাংসের তুলনায় ভিন্ন গঠনের। তবে গরুর মাংসে অপেক্ষাকৃতভাবে চর্বির পরিমাণ বেশি থাকলেও ঘোড়ার মাংসে তা কম।
পুষ্টিবিদেরা বলছেন, গরুর মাংসে প্রতি ১০০ গ্রামে ২৬ গ্রাম আমিষ, ১৫ গ্রাম চর্বি, ৬.৩ মিলিগ্রাম জিঙ্ক, ২.৬ মিলিগ্রাম লৌহ, ৮০ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল ও ২.৫ গ্রাম ভিটামিন বি১২ থাকে। তবে একই পরিমাণ ঘোড়ার মাংসে ২৮ গ্রাম আমিষ, ৫ গ্রাম চর্বি, ৩.৫ মিলিগ্রাম জিঙ্ক, ৩.৮ মিলিগ্রাম লৌহ, ৫০ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল ও ১.৮ গ্রাম ভিটামিন বি১২ বিদ্যমান।
এর বাইরে প্রতি ১০০ গ্রাম ছাগলের মাংসে পুষ্টিগুণ ২৭ গ্রাম আমিষ, ৩ গ্রাম চর্বি, ৪ মিলিগ্রাম জিঙ্ক, ৩.৫ মিলিগ্রাম লৌহ ও ১.৮ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন বি১২ রয়েছে। কোলেস্টেরল আছে ৭০-৮০ মিলিগ্রাম।
অর্থাৎ, ঘোড়ার মাংসে গরুর মাংসের চেয়ে চর্বি কম এবং লৌহ বেশি থাকায়, এটি অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতার রোগীদের জন্য উপকারী হতে পারে। তবে ছাগলের মাংসে আবার গরু ও ঘোড়ার চেয়ে চর্বি কম এবং বেশি পরিমাণে প্রোটিন ও আয়রন থাকায় এটি তুলনামূলকভাবে সহজপাচ্য এবং স্বাস্থ্যকর মাংস হিসেবে বিবেচিত হয়। পাশাপাশি, জিঙ্ক ও ভিটামিন বি১২-এর মাত্রা অধিক হওয়ায় মানব শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ঘোড়ার চেয়ে গরু ও ছাগলের মাংস বেশি সহায়তা করে থাকে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
জনস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব
বিশেষজ্ঞদের মতে, গরু, ছাগল ও ঘোড়ার মাংস দেখতে প্রায় কাছাকাছি হলেও স্বাদ ও গন্ধে ঈষৎ ফারাক রয়েছে। তাই এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। কেননা বাংলাদেশে মাংস উৎপাদনের লক্ষ্যে বাণিজ্যিকভাবে ঘোড়া লালন-পালন করা হয় না।
এ কারণে, অনেক ক্ষেত্রে অসুস্থ বা মৃত ঘোড়ার মাংস বাজারে আসার সম্ভাবনা থেকেই যায়। এ ছাড়া, সকল বয়স ও শ্রেণির মানুষ এটি গ্রহণে সমান সক্ষমতা না-ও রাখতে পারেন। বিশেষত, দশ বছরের কম বয়স্ক শিশু এবং বৃদ্ধদের ঘোড়ার মাংস না দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন অনেক পুষ্টিবিদেরা। কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন ঘোড়ার মাংসের তুলনামূলক কম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং ভিটামিন বি১২-এর নগন্য উপস্থিতির কথা।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ঘোড়ার মাংস খাওয়া
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ অর্থাৎ ইসলামি শরিয়তের বিধান মোতাবেক গরুর মাংস সম্পূর্ণরূপে হালাল হলেও ঘোড়ার মাংস খাওয়ার ব্যাপারে মুসলিমদের নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। যদিও এটি খাওয়া নিষিদ্ধ নয়। তবু ইসলামি ব্যাখ্যায় এ সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে, ঘোড়া সাধারণত একটি যুদ্ধের বাহন এবং অতীতে এটি যুদ্ধে ব্যবহৃত হতো। তাই একে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ না করাই উত্তম।
হাদিসে এ প্রসঙ্গে এসেছে, হযরত ওয়ালীদ (রা.) থেকে বর্ণিত, ঘোড়ার মাংস খাওয়ার ব্যাপারে নিষেধ মুসলিমদের নিষেধ করা হচ্ছে। মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স) এই নিষেধ করেছেন। (সুনানে নাসাঈ ৮/২০৬ এবং সুনানে আবু দাউদ ২/৫৩১)
ইসলামি স্কলারদের মতে, জিহাদ বা যুদ্ধে ব্যবহার্য বাহনগুলোর মধ্যে ঘোড়া অন্যতম। যদিও বর্তমানে ঘোড়ার চেয়ে আধুনিক বাহন উদ্ভাবিত হয়েছে, তবুও ঘোড়ার মাংস খাওয়া যথাসম্ভব এড়িয়ে চলাই ভালো। কেননা যুদ্ধক্ষেত্রে কিংবা সেনাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ঘোড়ার ব্যবহার এখনও শূন্যের কোঠায় নেমে আসেনি৷ বরং বাংলাদেশের পুলিশ কেন্দ্রগুলোতে ঘোড়ার রক্ষণাবেক্ষণের পাশাপাশি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
এর পাশাপাশি, বাংলাদেশে ঘোড়ার সংখ্যা অপ্রতুল হলেও যথেষ্ট পরিমাণে নানা প্রজাতির গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ লালন-পালন করা হয়। তাই এ দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য ঘোড়ার মাংস খাওয়া একটি বিতর্কিত বিষয় এবং সামাজিকভাবে একে নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। ২০২০ সালের ২৩ ডিসেম্বর পঞ্চগড়ের বোদায় ঘোড়ার মাংস বিক্রির জেরে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ঘটনা এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য।
নৈতিকতা ও প্রতারণার প্রশ্ন
বাংলাদেশের মাংস বাজারে অতীতে গরুর মাংসের পরিবর্তে শিয়াল, কুকুর বা অন্য প্রাণীর মাংস বিক্রির অভিযোগ উঠেছে বহুবার। বর্তমানে ঘোড়ার মাংসের সরবরাহ সীমিত হলেও একইভাবে অসাধু ব্যবসায়ী চক্র যদি বেশি মুনাফার লোভে গরু বা খাসির মাংসের পরিবর্তে এটি বিক্রি করতে শুরু করেন, তাহলে সাধারণ ভোক্তারা প্রতারণার শিকার হবেন।
ইতিমধ্যে চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি বগুড়ার শেরপুরে ঘোড়ার মাংসকে খাসির মাংস বলে বিক্রির অভিযোগে দুইজনকে আটক করেছিল পুলিশ। এর আগে, ২০২৩ সালে লক্ষ্মীপুরে এক হোটেল মালিকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল গরুর বদলে ঘোড়ার মাংস পরিবেশন করার অভিযোগে।
আমাদের করণীয় কী
সার্বিকভাবে, ভোক্তা অধিকার নিশ্চিতে গরু, ছাগলের সঙ্গে ঘোড়ার মাংসের সংমিশ্রণ রোধে সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের উচিত খাদ্য নিরাপত্তা আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা। পাশাপাশি, কেউ যাতে গরু বা খাসির মাংসের নামে ঘোড়ার মাংস বিক্রি করতে না পারে সে লক্ষ্যে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থাকেও সুসংহত করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে মাংসের প্রকৃত উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবেন জনসাধারণ।
উপরন্তু, সঠিকভাবে মাংসের উৎস সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে কেনাকাটা করতে সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টিতে অগ্রণী পদক্ষেপ গ্রহণ করাও দরকার। প্রয়োজনে মাংস পরীক্ষার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্রুত ও নির্ভুলভাবে মাংসের প্রকৃত ধরন চিহ্নিতকরণের সুযোগও তৈরি করা যেতে পারে।
আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশে ঘোড়ার মাংস খাওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকলে তা পুষ্টি বা অর্থনৈতিক দিকের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয়, নৈতিক এবং জনস্বাস্থ্যের ওপরও বড় একটি প্রশ্নচিহ্ন অঙ্কিত করবে। গরু বা ছাগলের তুলনায় ঘোড়ার মাংসে কিছু উপকারী পুষ্টি উপাদান থাকলেও, আমাদের খাদ্য সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের কারণে এটি কখনোই প্রধান বিকল্প হয়ে উঠতে পারে না।
এ ছাড়া, বাজারে প্রতারণার শিকার হওয়ার ঝুঁকি থাকায় সাধারণ জনগণকে আরও বেশি সতর্ক হতে হবে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত দক্ষভাবে বাজার মনিটরিং করা এবং কেউ যেন গরু ও ছাগলের নামে ঘোড়ার মাংস বিক্রি করতে না পারে, তা নিশ্চিত করা। সচেতনতা বৃদ্ধি, কঠোর বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতারণা করলে কঠোর শাস্তির প্রতিবিধান নিশ্চিতকরণ এই পদক্ষেপগুলোই পারে একমাত্র কার্যকর উপায় বলে বিবেচিত হতে।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর