খুলনা, বাংলাদেশ | ২৭শে ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১২ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

Breaking News

  কাল ঢাকায় আসছেন জাতিসংঘের মহাসচিব, পরিদর্শন করবেন রোহিঙ্গা ক্যাম্প
  গাজীপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় শ্রমিক নিহত, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ
  বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী মারা গেছেন 

মেজর জলিলের জবানীতে খুলনায় ভারতীয়দের লুটপাট

কাজী মোতাহার রহমান

ডেইন: ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১। স্পট : দক্ষিণ জনপদের বড় শহর খুলনা। দিনটি শুক্রবার। প্রত্যুষে গল্লামারীস্থ রেডিও পাকিস্তান, খুলনা কেন্দ্র সকালে শিরোমনিতে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর কাছে পাকবাহিনী পরাজিত হয়। বিজয়ের উষালগ্নে শিরোমনি নামক স্থানে ৮ ও ৯ নম্বর সেক্টরের সব চে’ সেরা যুদ্ধ। ইতিহাসের পাতায় এটি ট্যাঙ্ক ব্যাটেল নামে পরিচিত। ‘শিরোমনি ট্যাঙ্ক ব্যটেল’ আন্তর্জাতিক মিলিটারী একাডেমির পাঠ্যসূচি।

১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে মিত্রবাহিনীর কাছে পাকবাহিনী আত্মসমর্পন করে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে শিরোনাম হয় পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম।

শত্রুমুক্ত শহরের খুলনা সার্কিট ময়দানে সকাল ৯টা নাগাদ নবম সেক্টরের শেষ দিকের অধিনায়ক মেজর জয়নাল আবেদীন খান জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। তার সাথে ছিলেন নৌ-কমান্ড গাজী রহমতুল্লাহ দাদু বীর প্রতীক, বি এল কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি স ম বাবর আলী, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জি এম রেজাউল করিম প্রমূখ। শহর জুড়ে স্বাধীনতা প্রত্যাশী জনতার বিজয় উল্লাস। শিরোমনি থেকে লবণচরা পর্যন্ত বাড়ির আঙ্গিনায় পড়ে রক্তে কেনা লাল সবুজের পতাকা। সকাল থেকে মুক্তি ও মিত্রবাহিনী দলে দলে শহরে প্রবেশ করে। পাকিস্তানী বাহিনীর স্থানীয় অধিনায়ক, ১৪ সেনা কর্মকর্তা ও ৮ হাজার পাকিস্তানী সেনার আত্মসমর্পনের পালা। আকাশবাণী, বিবিসি ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার হয় পাকবাহিনীর আত্মসমর্পনের খবর। জুম্মার নামাজ শেষ সার্কিট হাউজের হেলিপ্যাডে আত্মসমর্পন অনুষ্ঠিত হয়। মিত্রবাহিনীর নবম ইনফেন্ট্রি ডিভিশনের অধিনায়ক মেজর জেনারেল দলবীর সিং এর কাছে পাকিস্তানী বাহিনীর খুলনাস্থ অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার মুহাম্মাদ হায়ত খান আত্মসমর্পন করেন ( সি এম রেজা রচিত একাত্তরের বিজয়ের সেইক্ষণ)।

এ সময় মিত্রবাহিনীর স্টাফ অফিসার কর্নেল দেশ পান্ডে, ৮ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর আবুল মঞ্জুর, ৯ম সেক্টরের প্রধম দিকের অধিনায়ক মেজর এম এ জলিল, একই সেক্টরের শেষ দিকের অধিনায়ক মেজর জয়নাল আবেদিন খান উপস্থিত ছিলেন। সার্কিট হাউজের হেলিপ্যাডে আত্মসমর্পনের দলিলে স্বাক্ষর হয়। খুলনাস্থ পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তা কর্নেল খটক, কর্নেল ফজলে হামিদ, কমান্ডার গুলজারিন খান, মেজর ইসতিয়াক, মেজর বেলায়েত খান, মেজর একরাম, মেজর জাফর, মেজর বানোরী, মেজর আব্বাসী, মেজর আলতাফ করিম, মেজর ইকবাল বাহার, মেজর জুবলি, লেঃ কোরবান ও লেঃ রফিক উপস্থিত ছিলেন।

৯ম সেক্টরের অধীনে সাব সেক্টর কমান্ডাররা হচ্ছেন- এ এস এম শামছুল আরেফিন, ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা, ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ, লেঃ মাহাফুজুল আলম বেগ, ব্যারিষ্টার শাহাজাহান ওমর, ক্যাপ্টেন ফোহাম উদ্দিন আহম্মেদ, তাজুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মেহেদী আল ইমাম ও মুজাহিদ ক্যাপ্টেন শাহাজাহান মাস্টার। খুলনায় মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বদানকারীরা হচ্ছেন, গাজী রহমতুল্লাহ দাদু বীর প্রতীক, শেখ কামরুজ্জামান টুকু, ইউনুস আলী ইনু, স ম বাবর আলী, জাহিদুর রহমান জাহিদ, শেখ আব্দুল কাইয়ুম, মীর্জা খয়বার হোসেন, ইস্কান্দার কবীর বাচ্চু, এটিএম খালিদ হোসেন, কুতুবউদ্দিন আহম্মেদ, শেখ আব্দুল ওয়াদুদ, শেখ বেলাল উদ্দিন বিলু, ফরিদ উদ্দিন, শেখ আফজাল হোসেন, ফশিউর রহমান নান্নু, আক্তার হোসেন বন্দ, বিনয় কুমার সরকার, তপন কুমার, ওমর ফারুখ, হরেন্দ্র নাথ টিকাদার, ইন্দ্রজিৎ জোয়ারদার, অনাদী সরকার, বজলুর রশিদ আজাদ, নুরুল ইসলাম মানিক, আব্দুল লতিফ, কাজী তাবারক হোসেন, মোশাররফ হোসেন, ক্যাপ্টেন ফোহাম উদ্দিন মোল্লা, নুরুল হক মোল্লা, সোহারাব হোসেন, গাজী রফিকুল ইসলাম, শেখ শাহাদাত হোসেন বাচ্চু, আবুল কালাম আজাদ, জি এম রেজাউল করিম, কেরামত আলী, খিজির আলী বীর বিক্রম, ইঞ্জিঃ শেখ মুজিবুর রহমান, নুরুল আলম, জালাল উদ্দিন ঢালী, আব্দুস সালাম মোড়ল প্রমূখ।

জেলার শিরোমনি, দৌলতপুর, বৈকালী, গোয়ালখালী, নিউজপ্রিন্ট, গল্লামারীস্থ রেডিও সেন্টার, পাইকগাছা হাইস্কুল, বাঁকা লঞ্চঘাট, বটিয়াঘাটা থানা, বাইনতলা স্কুল, বারোআড়িয়া, রঘুনাথপুর, রানাই, শোভনা, শলূয়া, থুকড়া, শাহাপুর, সাহস, ডুমুরিয়া থানা, বানিয়াখালী, তেরোখাদার কাটেঙ্গা হাইস্কুল, নেবুদিয়া, মসুন্দিয়া, জুনারী, হাড়িখালী, শেখপুরা, গাংনী, তেরোখাদা ডাকবাংলা, তেরোখাদা থানা, বারাসাত, বোয়ালিয়া ও পাইকগাছার কপিলমুনিতে যুদ্ধ হয়। আত্মসমর্পনের পর ৮ হাজার পাকিস্তানী সেনাদের জেলা কারাগার ও নিরাপদ স্থানে রাখা হয়। এ অনুষ্টানের পর পর মিত্রবাহিনী শহরে লুটপাট শুরু করে।

৯ম সেক্টরের কমান্ডার মেজর (আবঃ) এম এ জলিল ‘অরক্ষিত স্বাধীনতাই স্বাধীনতা’ গ্রন্থে এ তথ্য প্রকাশ করেন।

তিনি তার গ্রন্থে উল্লেখ করেন, মিত্রবাহিনী খুলনার মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সীমান্তের ্ওপারে নিয়ে যাবে, এমন উদ্যোগ নেয়। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের নিরস্ত্র করতে চেয়েছিল, প্রতিবাদের মুখে সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র জমা নেয়ার জন্য ফুলতলায় মিলিশিয়ায় ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। সেখান থেকে তাদের জমা দেয়া অস্ত্র এবং পাকবাহিনীর পরিত্যক্ত অস্ত্র মিত্রবাহিনী ট্রাকে বোঝাই করে ভারতে নিয়ে যায়। যশোর সেনানিবাস থেকে সম্পদ, খালিশপুরের মিলগুলো থেকে যন্ত্রাংশ, খুলনা জিলা স্কুলের বিজ্ঞানাগার থেকে অনুবীক্ষণ যন্ত্র তারা লুট করে। লুন্ঠনকে তিনি তার গ্রন্থে পরিকল্পিত হিসেবে উল্লেখ করেন। সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল বিষয়টি মিত্রবাহিনীর অধিনায়ক জেঃ দলবীর সিং কে জানালে তিনি তা কর্ণপাত করেননি। এমনকি মুক্তিবাহিনীর সেক্টর কমান্ডার ও সাব সেক্টর কমান্ডার ও ক্যাম্প কমান্ডারদের খুলনা শহর ত্যাগ করতে হলে মিত্রবাহিনীর অনুমতি নিতে হবে এমন নির্দেশনা দিল।

পিনাকী ভট্টাচার্য তার “স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ” নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, মিত্রবাহিনীর অফিসাররা নিজেদের এদেশের ত্রাতা মনে করতেন। তারা ঢাকা শহরে রেস্টুরেন্টে মিষ্টি খেয়ে দাম না দিয়ে চলে যেত। কখনও কখনও ঔদ্বত্য দেখিয়ে রেস্টুরেন্টর প্লেট ও গ্রøাস ভেঙ্গেঁ ফেলত।
সে সময়ে মিত্রবাহিনী সদ্য স্বাধীন দেশে নজিরবিহীন লুটপাট চালায় তা বিদেশীদের হতবাক করে তোলে। বৃটিশ সংবাদপত্র গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মিত্র বাহিনী ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে পাকিস্তানী বাহিনীর পরিত্যক্ত সম্পদ লুট করে। সম্পদের মধ্যে ছিল পাট, সুতা, যানবাহন ও সমুদ্রগামী জাহাজ। পিনাকী ভট্টাচার্য তার রচিত স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, শিখ অফিসার ও তাদের অধীনের সেনারা খুলনার শিল্পাঞ্চলে লুটপাট করে। পাকবাহিনী আত্মসমর্পনের পর তাদের অন্ততঃ চার ডিভিশনের অস্ত্র, ভারী কামান, গোলাবারুদ, যানবাহন ভারতীয়রা নিয়ে যায়। ৫৩ বছর আগে লুন্ঠিত সম্পদের মূল্য ২.২ মিলয়িন মার্কিন ডলার। ১৯৭২ সালের ১২ মার্চ ঢাকা স্টেডিয়ামে মিত্রবাহিনীর বিদায়ী কুটকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়।

মিত্রবাহিনীর লুটের বিবরণ দিয়ে ১৭ ডিসেম্বর রাতে এ গ্রন্থের লেখক মেজর এম এ জলিল তিনটি চিঠি পাঠান। চিঠির প্রাপক তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, প্রধান সেনাপতি কর্নেল (অবঃ) এম এ জি ওসমানী ও যৌথ বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক লেঃ জেঃ জগজিৎ সিংহ অরোরা। চিঠিগুলো গুরুত্ব পায়নি। এ অপরাধে ১৯৭২ সালের ৩১ ডিসেম্বরে নবম সেক্টর কমান্ডারকে বন্দী করে যশোর সেনানিবাসে রাখা হয়। তিনি স্বাধীন দেশের প্রথম রাজবন্দী। মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় তিনি একমাত্র সেক্টর কমান্ডার যিনি মুক্তিযুদ্ধে রাষ্ট্রীয় খেতাব পাননি। তিনি সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন।

১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর সরকারী গেজেট নোটিফিকেশনে বলা হয়, মারোণত্তর সাত জনকে বীর শ্রেষ্ঠ, ৬৮ জনকে বীর উত্তম, ১৭৫ জনকে বীর বিক্রম এবং ৪২৬ জনকে বীর প্রতীক পদক দেয়া হয়। ৭ নং সেক্টরের কমান্ডার লেঃ কর্নেল (অবঃ) কাজী নুরুজ্জামান বীর উত্তম খেতাব পেয়েও তার ব্যবহার করেননি, নীরবে প্রতিবাদ করেন। ৪ নং সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার মাহাবুব রব সাদী বীর প্রতীক খেতাব বর্জন করেন। তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু’র কাছে মুক্তিযোদ্ধা মেজর মইনুল হোসেন অভিযোগ করেন, যাদের পদক দেয়া হয়েছে তাদের অনেকেই নয় মাস রনাঙ্গনে পা রাখেনি। (পিনাকী ভট্টাচার্য রচিত স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ)।

খুলনা গেজেট/এমএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!