খুলনা, বাংলাদেশ | ২৫ ফাল্গুন, ১৪৩১ | ১০ মার্চ, ২০২৫

Breaking News

  ধর্ষণের মামলার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তি করতে আইন পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার : আইন উপদেষ্টা
  কোনো বাধা ছাড়া মাগুরায় শিশু ধর্ষণ মামলার বিচার ১৮০ দিনের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ হাইকোর্টের, শিশুটির বড়বোনকেও নিরাপত্তা দেয়ার নির্দেশ

খুলনা উন্নয়নের ফেরিওয়ালা কমরেড ফিরোজ আহমেদ

মহেন্দ্রনাথ সেন

খুলনা উন্নয়নের ফেরিওয়ালা কমরেড ফিরোজ আহমেদ। নামটি নতুন প্রজন্মের নিকট পরিচিত না হলেও তিনি খুলনার ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে রয়েছে। এ অঞ্চলের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে অবদানের কারণে তিনি খুলনার মানুষের মাঝে চিরভাস্বর হয়ে রয়েছেন।

তিনি অত্যন্ত মেধাবী, সুবক্তা, সদালাপী, স্পষ্টভাষী, বহুগুণের অধিকারী ছিলেন। তার দেশপ্রেম গণমানুষের প্রত্যাশা পূরণের রাজনীতি, পরিবেশ আন্দোলন ও শ্রমিক আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকার জন্য খুলনাবাসী তাকে জননেতার পাশাপাশি নাগরিক নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।

১৯৫৪ সালের ১ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন এ্যাড: ফিরোজ আহমেদ। আব্দুল হক মোল্লা ( খোকা মিয়া) ছিলেন তার পিতার নাম। মাতার নাম ছিল সুরমন নাহার। ১৯৭০ সালে সেন্ট জোসেফস্ হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯৭২ সালে সরকারি ব্রজলাল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স ও ১৯৭৬ সালে মাষ্টার্স পাশ করেন। ১৯৮১ সালে বাংলায় আবার মাষ্টার্স পাশ করেন।

ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। তিনি ১৯৭৯-৮০ শিক্ষাবর্ষে সরকারি ব্রজলাল কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। সুবক্তা, বিতার্কিক ও কর্মী হিসেবে কলেজের ছাত্র-শিক্ষক মহলে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ১৯৮০ সালে জার্মানীতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ছাত্র সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে রাজনীতিতে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ছাত্রাবস্থায় দেশপ্রেম চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেন। স্বাধীনতা উত্তরকালে ছাত্র ইউনিয়নের খুলনা জেলা কমিটির সভাপতি ও কেন্দ্র্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন। পরে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। আমৃত্যু এ দলের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। একাধিকবার দল থেকে মেয়র ও সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন।

এলএলবি পাশ করে ১৯৮৪ সালে খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য লাভ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। দেশপ্রেম, মেহনতী মানুষের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে পেশায় বেশ অবহেলা করেন। ১৯৯৬, ১৯৯৭, ১৯৯৮ এবং ১৯৯৯ সালে খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি আইনজীবীদের নিকট বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দীর্ঘদিন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনে পরিবেশ আইন বিষয়ে দক্ষতার সাথে শিক্ষকতা করেন।

খুলনা উন্নয়নের ফেরিওয়ালা হয়ে ওঠেন কমরেড ফিরোজ আহমেদ। খুলনার দু:খ হিসেবে পরিচিত বিল ডাকাতিয়ার জলাবদ্ধতা, অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ, সুন্দরবন রক্ষা, অচল মোংলা সচল করার আন্দোলন, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের বিরুপ প্রতিক্রিয়া ও নদীর অপরিকল্পিত শাসন নিয়ে ভাবতেন। খুলনা বিশ^বিদ্যালয় আন্দোলন, রূপসা সেতু , খুলনা মেডিকেল কলেজ আন্দোলন, শিল্প বাঁচাও, কৃষি বাঁচাও আন্দোলনে তিনি ছিলেন অগ্রজ। জড়িয়ে পড়েন জনউদ্যোগ-খুলনা, সেফ, উত্তরণ, বেলা, খুলনা নাগরিক সমাজসহ নানা সংগঠনের সাথে। খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন রূপকার।

কমরেড ফিরোজ আহমেদ ছিলেন আমার শিক্ষা গুরু। সামাজিক আন্দোলন আমাকে হাতে -কলমে শিখিয়েছেন। শিক্ষক হিসাবে তিনি ছিলেন রাগি। বানান ভুল ও শুদ্ধ ভাষায় লিখতে না পারলে তিনি রেগে যেতেন। একথায় তিনি ছিলেন কাজ পাগল।
নিপীড়িত মানুষের কাছে ছিলেন নয়নেরমনি। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে ছিলেন ফিরোজ ভাই। রোজার ঈদ এলে শ্রমিক মেহনতি মানুষের ঘরের ভিতরের খোজ নিতেন। গুজে দিতেন সাধ্য অনুযায়ি কোট আর সেমিনার থেকে পাওয়া উপার্জিত অর্থ। এই অর্থ পেয়ে কেউ সন্তুষ্ঠ হতো আবার কেউ দাবি করতো আরো কিছু। তাদের আকাঙ্খা না মিটাতে পারায় নিজেই মন খারাপ করতেন। বলতেন আমি তো কিছু হতে পারলাম না। তা ওদের কিভাবে আকাঙ্খা মেটাবো।

রাজনৈতিক দলের লোভনীয় হাতছানি থাকা সত্ত্বেও তিনি ক্ষমতার লোভে কখনো নিজের আদর্শ ও দলত্যাগ করেননি। তাই তিনি কোন পদে যাননি, বা ক্ষমতায় যাননি। সব সময় সমাজের দারিদ্র্য পীড়িত, শোষিত শ্রেণির কথা ভেবেছেন, তাদের জন্য কাজ করে গেছেন। তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। তিনি ইচ্ছা করলে আইন ব্যবসা করেই লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি, বরং অনেক দরিদ্র মানুষকে বিনা পারিশ্রমিকে আইনি সহায়তা প্রদান করেছেন। মূলত তিনি সব সময় সাধারণ মানুষদের নিয়েই ভেবেছেন। প্রত্যক্ষভাবে খুলনার শ্রমিক আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটর ছিলেন। খুলনার প্রায় সকল শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা ছিলেন। এছাড়া তিনি বহু গ্রন্থ ও প্রবন্ধের রচয়িতা।

এ্যাড. ফিরোজ আহমেদ ছিলেন একজন উদ্ভাবনপ্রিয় মানুষ। খুলনার আপামর জনসাধারণ তাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন। তিনি সমাজ ও মানবতার জন্য সারাজীবন কাজ করেছেন। নতুন প্রজন্মকে এই মহৎ মানুষটির দেখানো পথ অনুসরণ করা দরকার। এমন বিদগ্ধ বিরল ব্যক্তিত্বের কাছে দেশ ও জাতি ঋণী থাকবে,এটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা।

২০১৪ সালের ৯মার্চ খুলনা উন্নয়নের ফেরিওয়ালা কমরেড ফিরোজ আহমেদ সকলকে কাঁদিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আজও তাঁর স্বতীর্থরা রাজপথে লিফলেট হাতে এ্যাড: ফিরোজ আহমেদকে খুঁজে বেড়ায়। ১১তম মৃত্যুবার্ষিকীতে কমরেড ফিরোজ আহমেদকে লাল সালাম।

লেখক : সাংবাদিক মহেন্দ্রনাথ সেন।

খুলনা গেজেট/এমএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!