সভ্যতার আদিকাল থেকে সমাজে শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশ বা উৎকর্ষতা সাধনে লাইব্রেরি নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে আছে। সমাজের প্রাণকেন্দ্র মানুষ আর মানুষের প্রাণকেন্দ্র হলো শিক্ষা ও সংস্কৃতি। শিক্ষা ও সংস্কৃতির ফসল হলো লাইব্রেরি। লাইব্রেরি সমাজের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতা বিকাশের কেন্দ্রবিন্দু। তাই আমেরিকান তথ্যবিজ্ঞানী Jesse H. Shera যথার্থই বলেছেন “লাইব্রেরি সংস্কৃতির ফসল”।
সৃষ্টির আদিকাল হতে অদ্যাবধি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, মানুষ প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছে তার অনুভূতি, মনন, সৃষ্টিশিলতা, চিন্তা-ভাবনা ও অভিজ্ঞতা ইত্যাদি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য লিপিবদ্ধ করতে যা প্রতিনিয়ত তথ্য হিসেবে পান্ডুলিপি, বই, জার্ণাল ও অন্যান্য মাধ্যমে মুদ্রিত ও অ-মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হচ্ছে। ফলে প্রতিনিয়ত ঘটছে তথ্যের বিস্ফোরণ। আর এই বিস্ফোরিত তথ্যকে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মেও শিক্ষা, সংস্কৃতি ও গবেষণার স্বার্থে সংগ্রহপূর্বক বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থাপনাপূর্বক সংরক্ষণের জন্য সমাজে লাইব্রেরির উৎপত্তি হয়েছে।
লাইব্রেরি আমাদের অতীত ও বর্তমান কে এক শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে সাহায্য করে। প্রতিটি দেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতির বর্তমান অবস্থা ও অতীত কর্মকান্ডের ফল আমরা লাইব্রেরির মাধ্যমে পেয়ে থাকি। তাই বলা যায়, লাইব্রেরি হচ্ছে শিক্ষা ও সংস্কৃতির চাবিকাঠি। ল্যাটিনশব্দ Liber হতে ইংরেজি Library শব্দটির উৎপত্তি। Liber শব্দটির এসেছে Librarium হতে যার অর্থ “বই রাখার স্থান” এটি থেকে উদ্ভূত হয়েছে ফরাসি শব্দ Librairie যার অর্থ “বইয়ের সংগ্রহ” এখান থেকে অ্যাংলো-ফেঞ্চশব্দ Librarie এবং সব শেষে ইংরেজি Library যার বাংলা অর্থ হলো গ্রন্থাগার। বাংলা গ্রন্থাগার শব্দটি বিশ্লেষণ করলে আমরা “গ্রন্থ ও আগার” পাই। গ্রন্থ শব্দের অর্থ “বই বা পুস্তক” আর আগার শব্দের অর্থ হলো “ঘর বা গৃহ”।
তাহলে এক কথায় বলা যায় যে, “গ্রন্থাগার হলোবই বা পুস্তক রাখার ঘর বা গৃহ।” Encyclopedia of Librarianship-এর মতে, “Library is a storehouse of information for dissemination of that information(Knowledge).” অর্থাৎ “গ্রন্থাগার হচ্ছেএ কটি তথ্য ভান্ডার যা ঐ তথ্য (জ্ঞান) কে বিতরণ করে।” আভিধানিক অর্থে, “লাইব্রেরি হচ্ছে এমন একটি আইনসিদ্ধ প্রতিষ্ঠান, জায়গা বা স্থান যেখানে তাৎক্ষণিক বা ভবিষ্যতে পাঠকদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও গবেষণার স্বার্থে একটি আধুনিক ও বিশ্বখ্যাত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অর্থাৎ Dewey Decimal Classification(DDC), Universal Decimal Classification(UDC), Library of Congress(LC) ও অন্যান্য পদ্ধতি অনুসরণ কওে বর্তমান ও অতীত কালের সকল প্রকার বই, জার্নাল, পত্র-পত্রিকা, সাময়িকী, সংবাদপত্র, আর্কাইভস, ই-বুকস, ই-জার্ণালস, ডাটাবেজ, পান্ডুলিপি, তালপাতা, প্যাপিরাস, পার্চমেন্ট, ভেলাম, সিল্ককাপড়, ক্লে-ট্যাবলেট, পাথরে লেখা তথ্য, কোডেক্স, চার্ট, ফিল্ম, মাইক্রোফিল্ম, মাইক্রোফিস, ফনোগ্রাফ, গ্লোবস, ম্যাপস, এ্যাটলাস, রেকর্ড, চিত্র, নকশা, শিল্পকর্ম, ক্যাসেট, ডিস্ক, সিডি, ডিভিডি, হার্ডডিস্ক ইত্যাদি এক কথায় সকল প্রকার ভিজুয়্যাল ও নন ভিজুয়্যাল এবং মুদ্রিত ও অ-মুদ্রিত তথ্য সামগ্রী সনাক্তকরণ, সংগ্রহকরণ, সংরক্ষণ, বিন্যাস ও বিতরণবা লেনদেন করাহয়। গ্রন্থাগার প্রধানত: ৪(চার) প্রকার। যথা: (১) জাতীয় গ্রন্থাগার (National Library), (২) গণ-গ্রন্থাগার (Public Library), (৩), প্রাতিষ্ঠানিক গ্রন্থাগার (Academic Library) ও (৪), বিশেষ গ্রন্থাগার (Special Library)। একটি গ্রন্থাগার প্রধানত: গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান (Library and Information Science) বিষয়ে ডিগ্রিধারী ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে যার তত্ত্বাবধায়ক (Custodian) হিসেবে থাকেন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ডিগ্রিধারী একজন গ্রন্থাগারিক (Librarian), অপরদিকে, বইয়ের দোকান নিছক একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বা বই বিক্রির ঘর, স্থান বা জায়গা যেখানে শুধুমাত্র বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বই বিক্রি করা হয় যার তত্ত্বাবধায়ন করেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে একজন সাধারণ বিষয়ে ডিগ্রিধারী বইয়ের দোকানের ম্যানেজার বা মালিক (Proprietor), বইয়ের দোকানে সাধাণত: গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান (Library and Information Science) বিষয়ে ডিগ্রিধারী ও প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত জনবল ব্যতীত সাধারণ শিক্ষার অধিকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ কর্মরত থাকেন যারা তাদের দোকানের বই গুলি সহজে খুঁজে বের করার জন্য নিজেদেও সুবিধা মতো পদ্ধতিতে বইগুলি সংরক্ষণ ও বিন্যাস করে থাকেন।
এক কথায় বলা যায় যে, লাইব্রেরি সম্পূর্ণ একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান যেখানে লাইব্রেরি ব্যবহারকারীদের পাঠ্য সেবা প্রদান করা হয় অপরদিকে বইয়ের দোকানে শুধুমাত্র বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ক্রেতার কাছে বই বিক্রয় করা হয়। তাই বলা যায় যে, লাইব্রেরি আর বইয়ের দোকান এক নয়। উভয়ই ভিন্ন ধরনের দুটি প্রতিষ্ঠান। এখানে উল্লেখ্য, শৈশবকাল হতে আমরা বইয়ের দোকানের সাইনবোর্ড দেখে দেখে জেনেছি বইয়ের দোকান মানে লাইব্রেরি কারণ বইয়ের দোকানের নামের সাইনবোর্ডে অমুক লাইব্রেরি, তমুক লাইব্রেরি লেখা দেখতাম এবং আমাদেও অধিকাংশ শিক্ষক ও অভিভাবকগণ বই ক্রয়ের জন্য আমাদেরকে বইয়ের দোকান চেনানোর জন্য অমুক লাইব্রেরি, তমুক লাইব্রেরিতে যেতে বলতেন। ফলে, আমরা শৈশবকাল হতে বইয়ের দোকানকে লাইব্রেরি হিসেবে জেনেছি। তাছাড়াও সমাজের দর্পন বা আয়না নামে খ্যাত টেলিভিশনে কিছু কিছু নাটক ও সিনেমায় বইয়ের দোকানকে লাইব্রেরি হিসেবে দেখানো হয়ে থাকে যা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম, দেশ ও জাতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর ও লজ্জাস্কর।
এখানে আরো উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ ব্যতীত সারা দুনিয়ার কোথাও বইয়ের দোকানকে লাইব্রেরি বলা হয়না, বইয়ের দোকানকে বিশ্বেও অন্যান্য দেশে বুক স্টল, বুকপয়েন্ট, বুককর্ণার, বুক সেন্টার, বকহাউজ, গ্রন্থ বিতান, বিবলিওগ্রাফীহাউজ ও অন্যান্য বইসম্পর্কিত নানা নামে অভিহিতকরে থাকে অথচ আমাদের দেশে কিছু কিছু বইয়ের দোকান ব্যতীত অধিকাংশ বইয়ের দোকানের নামের ক্ষেত্রে লাইব্রেরি ব্যবহার করা হয় অথচ আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এমনকি কোলকাতাতেও বইয়ের দোকানের নামের ক্ষেত্রে লাইব্রেরি ব্যবহার করা হয়না। তাই এখনই সময় নতুন প্রজন্মকে লাইব্রেরি ও বইয়ের দোকান সম্পর্কে সঠিক ও সম্যক ধারণা প্রদানের জন্য আমাদের সকল শিক্ষা স্তরের পাঠ্যক্রমে লাইব্রেরি কি?, লাইব্রেরি কত প্রকার ও কি? কি?, লাইব্রেরির উৎপত্তি কিভাবে?, লাইব্রেরির সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বিন্যাস, লেনদেন, উদ্দেশ্য, কার্যাবলী কি? কি?, গ্রন্থাগারিক (Librarian) কাকে বলে? ও তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যত। কি? এবং বইয়ের দোকান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সম্বলিত প্রবন্ধ ও গল্প আকাওে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি ট্রেড লাইসেন্স প্রদানকারী সংস্থাকে বই বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে ট্রেড লাইসেন্স প্রদানের পূর্বে আবেদনপত্রে বইয়ের দোকানের নামের সাথে যদি লাইব্রেরি শব্দটি থাকে সেক্ষেত্রে উক্ত প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স প্রদান হতে বিরত থাকতে হবে এবং উক্ত প্রতিষ্ঠান কে লাইব্রেরি শব্দটি পরিবর্তন কওে বই সম্পর্কিত নাম দিয়ে পুনঃরায় আবেদন করার পরামর্শ প্রদান করতে হবে এবং বর্তমানে যে সকল বইয়ের দোকানের সাইন বোর্ডে লাইব্রেরি শব্দটি রয়েছে তা পরিবর্তন করার ব্যাপাওে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম লাইব্রেরি ও বইয়ের দোকান সম্পর্কে প্রকৃত ও সম্যক ধারণা পাবে এবং লাইব্রেরির সঠিক মূল্যায়ণ ও ব্যবহার নিশ্চিত হবে এবং এ বিষয়ে সকল প্রকার বিভ্রান্তি কেটে যাবে। ফলে, দেশ পাবে শিক্ষিত ও মেধাবী প্রজন্ম যারা দেশ ও জাতিকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দেবে।
লেখক: উপ-গ্রন্থাগারিক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়