খুলনা, বাংলাদেশ | ১৪ পৌষ, ১৪৩১ | ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  সচিবালয়ে আগুনের তদন্ত চলমান থাকায় মানুষের চলাচল সীমিত করা হয়েছে, আলামত যেন নষ্ট না হয়, ক্রাইম সীন রক্ষায় এমন সিদ্ধান্ত : প্রেস সচিব
  শেরপুরে বাস-অটোরিকশার সংঘর্ষে নিহত ৬
  ১৮১ আরোহী নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার বিমান বিধ্বস্ত, জীবিত মাত্র ২
বিবিসির বিশ্লেষণ

হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর বার্তাকে ভারত কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে!

গেজেট ডেস্ক

গত ২৩ ডিসেম্বর সকালে দিল্লির চাণক্যপুরীতে বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়ার বার্তা ‘নোট ভার্বালে’র আকারে তুলে দেয়া হলো সাউথ ব্লকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা বা নীতিনির্ধারকরা বেশ কিছুদিন ধরেই আকারে ইঙ্গিতে বা খোলাখুলি বলে আসছিলেন যে তারা ভারতের কাছে শেখ হাসিনাকে তারা ফেরত চাইবেন, যাতে তাকে গণহত্যার জন্য বিচারের কাঠগড়ায় তোলা যায়।

কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে সে বার্তা বা চিঠি কিন্তু দিল্লির কাছে পাঠানো হচ্ছিল না। অবশেষে সেটা নোট ভার্বালের আকারে পাঠানো হলো।

নোট ভ‍ার্বাল হলো দু’দেশের সরকারের মধ্যে এক ধরনের ‘ডিপ্লোম্যাটিক কমিউনিকেশন’ বা কূটনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যম- কিন্তু তাতে প্রেরকের কোনো স্বাক্ষর থাকে না।

তবে নোট ভার্বালের রীতি অনুযায়ী, ধরেই নেয়া যায় এক্ষেত্রেও বার্তাটি পাঠানো হয়েছে দিল্লির বাংলাদেশ দূতাবাসের লেটারহেডে এবং তাতে হাই কমিশনের রাবারস্ট্যাম্পও ছিল।

বার্তাটি হাতে পাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দিল্লির পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে সেটির প্রাপ্তিস্বীকার করা হয়। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এটাও জানিয়ে দেন, তাদের এ বিষয়ে এখনই কিছু বলার নেই!

এরপর আরো কয়েকদিন কেটে গেছে, দিল্লির পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো প্রতিক্রিয়া যেমন দেয়া হয়নি, তেমনি বাংলাদেশকে নোট ভার্বালের কোনো জবাবও পাঠায়নি ভারত।

বস্তুত, ভারত সরকারের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সূত্র দিল্লিতে বিবিসি বাংলাকে আভাস দিয়েছেন, তারা এই অনুরোধকে আদৌ খুব একটা আমল দিচ্ছেন না।

তারপরেও এই বার্তার জবাব নিশ্চয় দেয়া হবে, কিন্তু তার জন্য দিল্লি কোনো ধরনের তাড়াহুড়ো করবে না বলেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

কেন ভারত সরকার ওই নোট ভার্বাল নিয়ে এরকম মনোভাব পোষণ করছে, কর্মকর্তা এবং বিশ্লেষকদের সাথে কথা বলে তার কারণগুলোই অনুসন্ধান করা হয়েছে বিবিসির এই প্রতিবেদনে।

‘সাক্ষ্যপ্রমাণের ফিরিস্তি কোথায়?’
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার যদিও দাবি করছে শেখ হাসিনাকে ফেরানোর প্রচেষ্টাকে তারা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। কিন্তু ভারত মনে করছে, তাদের পাঠানো বার্তা একটা ‘দায়সারা পদক্ষেপে’র চেয়ে বেশি কিছু নয় বলেই দাবি করা হয় বিবিসির প্রতিবেদনে।

দিল্লিতে শীর্ষস্থানীয় একজন সরকারি কর্মকর্তা বিবিসিকে বলছিলেন, ‘সত্যিই যদি বাংলাদেশ এই ব্যাপারটা নিয়ে সিরিয়াস হতো, তাহলে তো তারা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগগুলো কী এবং তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণই বা কী, সেই বিবরণও পেশ করত। মানে যেমনটা একটা চার্জশিটে থাকে! এক-দু’পাতার একটা নোটে যে সেটা থাকতে পারে না, তা তো বলাই বাহুল্য!’

তার বক্তব্য, বাংলাদেশ সরকার আসলে তাদের দেশের মানুষকে এটা দেখাতে চাইছে যে তারা ভারতের কাছে প্রত্যর্পণের অনুরোধ জানিয়ে দিয়েছে এবং ফলে ‘বল এখন ভারতের কোর্টে- আমাদের এখন আর কিছু করার নেই!’

ভারতের একজন সাবেক কূটনীতিবিদের কথায়, ‘আমার তো মনে হচ্ছে যেন বাংলাদেশ এই পদক্ষেপের মাধ্যমে যেন একটা বক্সে টিক দিয়ে দায়িত্ব সারলো- আমাদের প্রত্যর্পণের অনুরোধ জানানোর কথা ছিল, জানিয়ে দিয়েছি – ব্যাস!’

কিন্তু শেখ হাসিনাকে ভারত বিচারের জন্য হস্তান্তর করবে- বাস্তবে এরকম সম্ভাবনা ক্ষীণ বলেই বাংলাদেশ হয়তো সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়নি, এমনটাও ধারণা করছেন তিনি।

প্রকৃত কারণটা যাই হোক, নোট ভার্বালে যে যুক্তি দেখিয়ে শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হয়েছে, (জুলাই-অগাস্ট গণহত্যার বিচারের জন্য তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে) সেটাকে ভারত আসলে জোরাল কোনো দাবি বলে মনেই করছে না বলেই দাবি করা হয় বিবিসির প্রতিবেদনে।

ভারতীয় সাবেক ওই কূটনীতিবিদ বলেন, ‘কারণটা হলো কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়া এ অভিযোগ জানানোর অর্থ এ বার্তার চরিত্র পুরোপুরি রাজনৈতিক। এখন দু’দেশের প্রত্যর্পণ চুক্তিতেই পরিষ্কার বলা আছে রাজনৈতিক অভিযোগে অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে হস্তান্তর করা যাবে না। ফলে শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও নিশ্চয়ই সেই যুক্তিই প্রযোজ্য হবে।’

‘লেটার রোগেটরি দিলে তবু না হয় বুঝতাম!’
কোনো দেশের সাথে ভারতের প্রত্যর্পণ চুক্তি বা বিশেষ কোনো ব্যবস্থা বা অ্যারেঞ্জমেন্ট থাকলে সেই দেশের কোনো নাগরিককে ভারত তাদের হাতে তুলে দিতে পারে- যদি তিনি একজন ‘ফিউজিটিভ ক্রিমিনাল’ এফসি বা ফেরার আসামি হন।

এখন কোন কোন শর্তের অধীনে ভারত একজন ‘এফসি’-কে তার নিজ দেশের হাতে তুলে দিতে পারে, তার নিয়মকানুন খুব স্পষ্ট এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেও তার পুরোটাই উল্লিখিত আছে।

এইসব রীতিনীতি কিছুটা নির্ভর করে বিশেষ ওই দেশের সাথে প্রত্যর্পণ চুক্তির বিশেষ ধারার ওপর। তবে মূল ধারাটা সব দেশের ক্ষেত্রেই এক, আর তা হলো যাকে ফেরত চাওয়া হচ্ছে তাকে কোনো ‘প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধে’র মামলায় ফেরার আসামি হতে হবে।

এখন শেখ হাসিনা যখন ভারতে এসে পৌঁছান, তখন তিনি কিন্তু কোনো ফেরার আসামি বা এফসি ছিলেন না।

ভারতের সাবেক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিবিদ পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী এ যুক্তি দেখিয়েই বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘মনে রাখতে হবে ৫ আগস্ট তারিখেও শেখ হাসিনার নামে সে দেশে কোনো মামলা ছিল না। ফলে ভারত যখন তাকে আতিথেয়তা দিচ্ছে, সেই মুহূর্তে তিনি কিন্তু কোনো ফেরার আসামি নন।’

তিনি আরো যুক্তি দিচ্ছেন, ‘এখন শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর যদি তার বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে শত শত মামলা একসাধে দায়ের করা হতে থাকে, তাহলে এটা মনে করার যথেষ্ঠ কারণ থাকতে পারে এগুলো রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক- যার ভিত্তিতে প্রত্যর্পণের কোনো প্রশ্নই ওঠে না।’

তাহলে কি ধরেই নেয়া যেতে পারে, অনুরোধ যে আকারেই আসুক বা যতই জোরালে সাক্ষ্যপ্রমাণ পেশ করা হোক- ভারত কোনো অবস্থাতেই শেখ হাসিনাকে ফেরত দেবে না?

পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী জবাবে বলছেন, ‘না বিষয়টা ঠিক সেরকম নয়। যদি সব নিয়ম মেনে এবং আঁটঘাট বেঁধে ভারতের কাছে এই অনুরোধ জানানো হয়, তাহলে ভারত নিশ্চয়ই সেটা বিবেচনা করবে।’

ঢাকায় ভারতের সাবেক এই হাই কমিশনারের ধারণা, এক্ষেত্রে একটি নোট ভার্বালের চেয়ে হয়তো অনেক বেশি কার্যকরী হতো একটি ‘লেটার রোগেটরি’।

ল্যাটিনে ‘রোগাটোরিয়াস’ কথার অর্থ হলো তথ্য জানতে চাওয়া। আর ‘লেটার রোগেটরি’ হলো এক দেশের আদালত যখন অন্য দেশের আদালতের কাছে কোনো বিষয়ে আইনি সহায়তা চেয়ে চিঠি দেয়।

সেটা কোনো অভিযুক্তের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ হতে পারে, কিংবা আইনি প্রক্রিয়ায় সাহায্য করার অনুরোধ হতে পারে।

সুতরাং, এক্ষেত্রে বাংলাদেশের আদালত বা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যদি ভারতের বিচার বিভাগের কাছে (সুপ্রিম কোর্ট) শেখ হাসিনার বিচার প্রক্রিয়ায় সহায়তা চেয়ে কোনো চিঠি দিত (লেটার রোগেটরি)- সেটার প্রভাব এই নোট ভার্বালের চেয়ে অনেক বেশি হতো বলে ভারতের কোনো কোনো পর্যবেক্ষক মনে করছেন।

তবে, এই ধরনের কোনো চিঠি পাঠানোর আগে সংশ্লিষ্ট বিচার প্রক্রিয়াতেও যথেষ্ঠ অগ্রগতি হওয়া দরকার। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে তা এখনো আদৌ হয়েছে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ আছে দিল্লি বলেই উল্লেখ করেছে বিবিসি।

ভারতের শাসক দল বিজেপির ঘনিষ্ঠ পররাষ্ট্র নীতি বিশেষজ্ঞ শুভ্রকমল দত্ত বিবিসিকে বলেন, ‘ভারতের কাছে শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়ার আগে আমি তো বলব মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের উচিত তাদের নিজেদের সেনাবাহিনীর কাছে জবাবদিহি চাওয়া, কেন তারা শেখ হাসিনাকে ভারতে যেতে দিল।’

বিসিসি উল্লেখ করে, শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর একটি মিলিটারি এয়ারক্র্যাফটে করেই দিল্লির কাছে হিন্ডন বিমানঘাঁটিতে এসে অবতরণ করেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর এর পরদিনই মানে ৬ আগস্ট পার্লামেন্টে জানান, শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানটি যাতে দিল্লিতে এসে নামতে পারে, তার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তরফে ভারতের কাছে আগাম অনুমতি বা ফ্লাইট ক্লিয়ারেন্সও চাওয়া হয়েছিল।

শুভ্রকমল দত্ত বলেন, ‘ফলে, যে পরিস্থিতিতেই শেখ হাসিনা ভারতে এসে থাকুন, তার পেছনে বাংলাদেশের বর্তমান সেনা নেতৃত্বের একটা সক্রিয় ভূমিকা অবশ্যই ছিল- যা অস্বীকার করা কঠিন।’

তার কথায়, ‘বাস্তবিক শেখ হাসিনা এখন আমাদের অতিথি হতে পারেন, কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে- তাকে কিন্তু আমরা নিজে থেকে ডেকে আনিনি।’

ফলে ৫ আগস্টের সেই ঘটনাক্রম আজ শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের অনুরোধকে বেশ কিছুটা দুর্বল করে দিচ্ছে বলেই ভারতের বিশ্বাস। দিল্লিতে সাউথ ব্লকের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বলেন, ‘কারণ রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ (সেনাবাহিনী) তাকে ভারতে আসতে সাহায্য করেছে, আর এখন রাষ্ট্রেরই আর একটি স্তম্ভ (নির্বাহী বিভাগ) তাকে ভারত থেকে ফেরত চাইছে- এর মধ্যে তো একটা স্ববিরোধিতা আছেই।’

এই সব কারণেই বাংলাদেশের নোট ভার্বালের তড়িঘড়ি একটা জবাব দেয়া উচিত কিংবা শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের ব্যাপারে দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত- তেমনটা ভারত মনে করছে না!
সূত্র : বিবিসি।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!