শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনকালে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নির্মাণ এবং পরবর্তীতে ‘২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্যে রাষ্ট্র প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে। নতুনত্বের সুযোগ নিয়ে প্রকল্পের নামে বিপুল অর্থ লোপাট করা হয়েছে। শ্বেতপত্র প্রণয়নে গঠিত কমিটি গত ১ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। সেই প্রতিবেদনে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে আইসিটি খাতকে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির রিপোর্টের পর আইসিটি বিভাগ একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি করে। ইতিমধ্যে সেই কমিটি প্রতিবেদনও প্রস্তুত করেছে। আগামী রোববার আইসিটি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের কাছে এই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।
আইসিটি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের অভ্যন্তরীণ তদন্তে দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। আমরা দেখেছি, কীভাবে পাঁচ টাকার কাজ ২০ টাকা দিয়ে করা হয়েছে। এমনকি খালের মধ্যে ইনকিউবেশন সেন্টার করা হয়েছে। একেবারে লুটপাট বলতে যা বোঝায়, সেটাই হয়েছে। এই সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সব প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এখন এই রিপোর্টের পর উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করে কিছু কাজ শুরু করা হবে। আর অনেকগুলো কাজ বন্ধ করে দেওয়া হবে।’
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তি খাত (আইসিটি) বাংলাদেশের জন্য একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ খাত এবং আমাদের জন্য নতুন ক্ষেত্র। নতুনত্বের সুযোগ নিয়ে এবং অভিজ্ঞতার অভাবের কারণে প্রকল্পের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাট করা হয়েছে।
ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা রাজনৈতিক বিবেচনায় হাতেগোনা কিছুসংখ্যক ব্যক্তি এসব প্রকল্পের কাজ পেয়েছে, যারা প্রকল্পের নামে অর্থ লোপাট করেছে।’
আইসিটি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৫৫টি প্রকল্প নেওয়া হয়, যার ব্যয় ধরা হয় প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা। আর ৩৪টি কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ১৭৩ কোটি টাকা। ব্যয়বহুল প্রকল্প আর কর্মসূচি হাতে নেওয়া হলেও সুফল মেলেনি। তার প্রমাণ, আইসিটি ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সে ১৭০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৯তম। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্যরা আইসিটি খাতের একটি প্রকল্পকে উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন, যেটিতে ৫২১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও খরচ করা হয় ৭৭৪ কোটি টাকা। ড. দেবপ্রিয় বলেন, যাচাই ছাড়াই বড় বড় প্রকল্প পাশ করা হয়েছে। সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে বড় দুর্নীতির।
শ্বেতপত্র কমিটি তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, কেনাকাটার ক্ষেত্রে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে। যন্ত্রপাতি ও সফটওয়্যার অধিক মূল্যে কেনা হয়। আর একটি বিষয় হলো অনেক প্রকল্প বা সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট করার কথা বলে আরও বড় অঙ্কের প্রকল্প করা হয়েছে যেগুলোর প্রয়োজনীয়তা আছে কি না, সেটাও যাচাই-বাছাই করা হয়নি। প্রকল্পে যে ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন বা কাজের কথা বলা হয়েছে তা আদৌ হয়নি। এছাড়া আইটি ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ভাতা বিতরণের ক্ষেত্রেও দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।
শ্বেতপত্রের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ এই খাতে দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় অগ্রগতির স্বার্থে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই ঘটনা যুবসমাজ ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের হতাশ করে। কারণ জনগণের করের অর্থ অপব্যবহারের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় প্রকল্পে অর্থ অপচয় করা হয়। এসব প্রকল্পে স্বচ্ছতার অভাব ছিল এবং অভিযোগ ওঠে যে, এগুলো তত্কালীন শাসন ক্ষমতার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের সুবিধা দিতে তৈরি করা হয়েছিল। তরুণদের জন্য আইসিটি প্রশিক্ষণ, নারীর ক্ষমতায়ন এবং স্থানীয় অ্যাপ ও গেম উন্নয়ন প্রকল্পে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও উদঘাটিত তথ্য থেকে দেখা গেছে, এসব প্রকল্প মূলত সরকারি কর্মকর্তাদের এবং তাদের পছন্দের সরবরাহকারীদেরই উপকৃত করেছে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের অধীনে সবচেয়ে বেশি ৫ হাজার ৯২৩ কোটি টাকার ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন (ইডিসি) প্রকল্পের কাজ নেওয়া হয়। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে নেওয়া ঐ প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয় ২০২৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত। এ পর্যন্ত ২০০ কোটি টাকার কাজ হয়েছে।
আইসিটি সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী বলেন, এসব প্রকল্প নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। তাই বর্তমান সরকারের শুরুর সময়েই ঐসব প্রকল্পের কেনাকাটা একেবারে বন্ধ রাখা হয়েছে। প্রকল্পগুলোতে যে পর্যন্ত কাজ হয়েছে সেখানেই বন্ধ রাখা হয়েছে।
খুলনা গেজেট/এনএম