সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত না হওয়ায় আগামী ডিসেম্বরে বাণিজ্যিকভাবে চালু হচ্ছে না রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। নিমার্ণকারী রাশিয়ার কোম্পানি রোসাটম থেকে জানানো হয়েছে, কমপক্ষে তিনটি সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত না হলে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পারবে না। কিন্তু পাঁচটি সঞ্চালন লাইনের মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র দুটি লাইন তৈরি হয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চে তৃতীয় লাইনটি তৈরি হবে। বিদ্যুৎ বিভাগ ও পাওয়ার গ্রিড অব বাংলাদেশ পিএলসির (পিজিবি) কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, গত বছর প্রথম ইউনিট থেকে ১২০০ মেগাওয়াট এবং চলতি বছর দ্বিতীয় ইউনিট থেকে (১২০০ মেগাওয়াট) উৎপাদনের কথা ছিল। কিন্তু উপকেন্দ্র ও সঞ্চালন প্রস্তুত না হওয়ায় উৎপাদনের তারিখ পিছিয়ে আগামী ডিসেম্বর করা হয়।
পাওয়ার গ্রিড অব বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আবদুর রশিদ খান এ প্রসঙ্গে কালবেলাকে বলেন, রূপপুরের জন্য তৃতীয় সঞ্চালন লাইনের কাজ মার্চের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। আমাদের সঞ্চালন লাইন নির্মাণে রিভার ক্রসিং (নদীর ওপর সঞ্চালন লাইন) রয়েছে। রিভার ক্রসিংয়ে সঞ্চালন লাইন নির্মাণ কঠিন ও সময়সাপেক্ষ। এর পরও মার্চের মধ্যেই কাজ শেষ করে ফেলতে পারব।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য পৃথক পাঁচটি সঞ্চালন লাইন তৈরি করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে রূপপুর-বগুড়া, রূপপুর-বাঘাবাড়ি, রূপপুর-গোপালগঞ্জ, রূপপুর-ধামরাই এবং রূপপুর-কালিয়াকৈর। এর মধ্যে রূপপুর-বগুড়া ও রূপপুর-বাঘাবাড়ি প্রস্তুত হয়েছে। অন্য তিনটি লাইনের মধ্যে রূপপুর-গোপালগঞ্জ লাইনের কাজ আগামী বছরের মার্চের প্রথম সপ্তাহে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এ কারণে মার্চে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করার কথা বলা হচ্ছে।
জানা গেছে, রূপপুর-গোপালগঞ্জ লাইনের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৯২ শতাংশ। শুধু পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে রিভার ক্রসিংয়ের কাজ বাকি রয়েছে। একইভাবে রূপপুর-ধামরাই এবং রূপপুর-কালিয়াকৈর লাইনেরও রিভার ক্রসিংয়ের কাজ বাকি রয়েছে। রূপপুর-ধামরাই লাইনের সার্বিক অগ্রগতি ৬৯ শতাংশ, যমুনা পার হয়ে মানিকগঞ্জ জেলায় প্রবেশ করা লাইনটি ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে প্রস্তুত হবে। রূপপুর-কালিয়াকৈর লাইনের কাজেও যমুনা নদী পারাপারের কাজ অবশিষ্ট রয়েছে।
বিগত সরকারের সময়ে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাণিজ্যিক উৎপাদনের তারিখ এক বছর পিছিয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়। আর দ্বিতীয় ইউনিট আগামী বছর ডিসেম্বরে উৎপাদনে আসার কথা। কিন্তু লাইন নির্মাণ শেষ না হওয়ায় এ বছর উৎপাদনে আসতে পারছে না।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, গত বছর প্রথম ইউনিট থেকে উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা ছিল। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার কারণে জার্মান প্রতিষ্ঠান সিমেন্স কাজকে জটিল করে তোলে। সিমেন্স ২৩৩/৪০০ কেভি জিআইএস সাব-স্টেশন সরবরাহ করার কথা ছিল। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে শেষ সময়ে সাব-স্টেশন সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানালে নতুন ঠিকাদার নিযুক্ত করা হয় চীনা কোম্পানিকে।
সঞ্চালন লাইন নির্মাণের তদারক প্রতিষ্ঠান পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) সূত্র জানিয়েছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঞ্চালন লাইনের দৈর্ঘ্য ৬৬৯ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৪৬৪ কিলোমিটার ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন ও ২০৫ কিলোমিটার ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইন। ২০ কিলোমিটার রয়েছে নদী পারাপার। এর মধ্যে ৪০০ কেভি ১৩ কিলোমিটার ও ৭ কিলোমিটার ২৩০ কেভি লাইন। পদ্মা ও যমুনার মতো বড় নদী পারাপার রয়েছে। নদী পারাপার কাজে অর্থায়ন করা হচ্ছে দেশীয় তহবিল থেকে। ডলার সংক্রান্ত জটিলতায় ঠিকাদারকে সময়মতো অর্থ দিতে না পারায় কাজটি বিলম্বিত হয়েছে। ফলে প্রকল্পের অন্য কাজ শেষ হলেও নদী পারাপারের কাজ শেষ হতে বেশি সময় লাগছে।
দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল এ প্রকল্পে সিংহভাগ অর্থায়ন দিয়েছে রাশিয়া। ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পে রাশিয়ার অর্থায়ন রয়েছে ৯৩ হাজার কোটি টাকা। পরমাণু বিদ্যুতে সবচেয়ে সুবিধার দিক হচ্ছে ৬০ বছর এর দর ওঠানামা করবে না। একই দরে ৬০ বছর নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। তুলনামূলক সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব হিসেবে পরিচিত পারমাণবিক বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদনে গেলে তেলভিত্তিক ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দিতে চায় বাংলাদেশ। এতে করে গড় বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমে আসবে বলে মনে করছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড।
পৃথিবীর ৩০ দেশে ৪৪৯টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। সেগুলো থেকে উৎপন্ন বিদ্যুতের পরিমাণ মোট উৎপন্ন বিদ্যুতের প্রায় ১২ শতাংশ। ১৪টি দেশে আরও ৬৫টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। ২০২৫ সাল নাগাদ ২৭ দেশে ১৭৩টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়া চলমান। এগুলোর মধ্যে ৩০টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রই নির্মিত হচ্ছে পরমাণু বিশ্বে নবাগত দেশগুলোয়, যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।
খুলনা গেজেট/এইচ