খুলনা নগরীর প্রাণকেন্দ্র শিববাড়ি এলাকা, একদিকে চলমান ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন কাজ অন্যদিকে সড়কজুড়ে বেপরোয়া ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও মোটরচালিত রিকশার দৌরাত্ম। এই দুয়ে মিলে মুখ থুবড়ে পড়েছে নগরীর সড়ক ব্যবস্থাপনা একইসাথে ব্যাহত হচ্ছে নগরবাসীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।
সরেজমিনে দেখা যায়, নিউমার্কেট, শিববাড়ি, সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনাল, গল্লামারী মোড়, ময়লাপোতা মোড়, ডাকবাংলো মোড়, পিকচার প্যালেস মোড়, সদর থানার মোড়, শান্তিধাম মোড় ও পিটিআই মোড়ে প্রতিনিয়তই লেগে থাকে যানজট। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মজীবী মানুষ থেকে রোগী সঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না। প্রতিনিয়ত যানজটের ভয়াবহতা এতটাই তীব্র হচ্ছে যে, কয়েক মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করতে সময় লাগছে ঘণ্টারও বেশি।
রবিবার (৬ অক্টোবর) সকালে বটিয়াঘাটা থেকে খুলনা মেডিকেলে এসেছিলেন গৃহিণী ফারহানা। নগরীর তীব্র যানজটের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে এই অতিরিক্ত ইজিবাইকের কারণে তিলোত্তমা খুলনা তার জৌলুস হারিয়েছে। কয়েক বছর আগেও খুলনা একটা শান্তশিষ্ট নগরী ছিলো, এখন এই শহরের রাস্তায় চলাচল করা একেকটা ইজিবাইক মুর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দাড়িয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে, খুব শীঘ্রই ঢাকার মত খুলনাও বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে।
খুলনার নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সেঁজুতি তন্বী বলেন, নগরীতে বিভিন্ন মোড়গুলোতে সবচেয়ে বেশি যানজট বাঁধে। খুলনাতে কেউই ট্রাফিক পুলিশের সিগন্যাল মানে না, এমনকি কোন সড়কে সিগন্যাল বাতিও নেই। খুলনার সড়কে যদি, পুলিশের কঠোর অবস্থান ও আইনের প্রয়োগ সঠিকভাবে করা যায় তাহলে হয়তো পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হবে।
খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) সূত্র বলছে, মহানগরে ৮ হাজার ইজিবাইক ও ১৭ হাজার রিকশার লাইসেন্স রয়েছে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, নগরীতে ৮ হাজার বৈধ ইজিবাইক থাকলেও সড়কে চলছে এর দ্বিগুণ। ভুয়া ব্লু-বুক ও স্টিকার ব্যবহারসহ নানা উপায়ে চলছে অবৈধ এসব ইজিবাইক। ফলে মোড়ে মোড়ে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট, ঘটছে দুর্ঘটনা। ভোগান্তিতে পড়ছে নগরবাসী, ব্যাহত হচ্ছে মূল্যবান কর্মঘন্টা।
নগরবাসীর অভিযোগ, একাধিকবার শহরে চলাচলকারী ইজিবাইকের সংখ্যা ও রুট নির্ধারণের উদ্যোগ নিলেও কার্যকর ফল হয়নি। এছাড়া এসব অবৈধ ইজিবাইক বিদ্যুতের ওপর চাপ ফেলছে।
কোথা থেকে আসলো এই বিপুল সংখ্যক অবৈধ গাড়ি? এমন প্রশ্নের জবাবে নগরীর ইজিবাইক চালক ফজলে রাব্বি বলেন, খুলনায় কখনওই অবৈধ ইজিবাইক বন্ধ হয়নি। প্রতিদিন সকালে, নগরীর বাইরে থেকে বিপুল সংখ্যক গাড়ি প্রবেশ করে। আগে ট্রাফিক পুলিশ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ছত্রছায়ায় এসব গাড়ি চলতো। সরকার পতনের পর, পুলিশ মামলা দেওয়া বন্ধ করলে, শহরে আরও গাড়ির সংখ্যা বেড়ে গেছে।
নগরীর আরেক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী জান্নাত মিতু। বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে নগরীর একাধিক পয়েন্টে পোহাতে হয় দীর্ঘ যানজটের। তিনি বলেন, খুলনার এতোগুলো পাটকল বন্ধ হইছে, সেখানকার বহু শ্রমিকরা জীবিকা নির্বাহের তাগিদে পেশা বদলায়ে গাড়ি চালানোর পেশা বেছে নিছে, সবচেয়ে সহজলভ্য ছিলো ইজিবাইক। তাছাড়া উঠতি বয়সী ছেলেরাও আয় রোজগারের জন্য প্রথমেই বেছে নেয় ইজিবাইক চালানো। আর যেহেতু লাইসেন্স পাবার প্রক্রিয়াটা স্বচ্ছ কিংবা নিয়মতান্ত্রিক নয়, যে কেউই চাইলে কাগজ বানিয়ে ইজিবাইক চালানো শুরু করতে পারে। তাই খুলনায় হঠাৎ ইজিবাইকের নৈরাজ্য বেড়ে গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ট্রাফিক পুলিশ সদস্য বলেন, এই বিপুল সংখ্যক যানবাহনের কাছে আমরা অসহায়, নগরীর ট্রাফিকের বর্তমান যে অবস্থা তা নিয়ন্ত্রণ করতে ট্রাফিক পুলিশের সাথে সিটি কর্পোরেশনসহ একাধিক সংস্থার যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন।
এদিকে, আজ নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থা স্বাভাবিক করতে ইজিবাইক ও অবৈধ যানবাহন নিয়ন্ত্রণে সকালে গল্লামারী মোড়ে কার্যক্রম শুরু করেছে, খুলনা জেলা ট্রাফিক কন্ট্রোলিং বিভাগ, নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা। এসময় গল্লামারী মোড়ে ইজিবাইক ও অন্যান্য যানবাহনের লাইসেন্স চেক করাসহ চালকদের মাঝে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হয়।
এসময় নিরাপদ সড়ক চাইয়ের (নিসচা) খুলনা মহানগর শাখার সাধারন সম্পাদক মাহবুবুর রহমান মুন্না বলেন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, সিটি কর্পোরেশন, ট্রাফিক বিভাগ ও নিসচার যৌথ উদ্যোগে নগরীর সাধারণ জনগণ যাতে নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারে তার লক্ষ্যে ইজিবাইক কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সেই লক্ষে নাঠে নেমেছি।
তিনি আরো বলেন, আমরা নিরাপদ সড়ক চাই’র পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাবনা দিয়েছি ” সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত সবুজ রঙের ইজিবাইক চলবে এবং বিকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত লাল রঙের ইজিবাইক চালানো যায় এতে নগরীর যানযটের এই বেহাল দশা কিছুটা হলেও কমবে।
খুলনা জেলার প্রধান ট্রাফিক কন্ট্রোলিং সমন্বয়ক মো. নাঈম মল্লিক বলেন, ৫ই আগষ্টের পর থেকে আমরা সড়কে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করে আসছিলাম, খুলনার সাধারন জনগনের সাথে কথা বলে যা বুঝতে পেরেছি, খুলনার সড়কে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো অনিয়ন্ত্রিত অবৈধ ইজিবাইক। সম্প্রতি খুলনা সিটি কর্পোরেশন ইজিবাইকে বার কোডের আওতায় আনার জন্য একটি নতুন উদ্যোগ নিয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা গেলে নগরীর অবৈধ ইজিবাইকের দৌরাত্ম অনেকটাই কমে আসবে বলে আশা করি।
খুলনা গেজেট/এনএম