একই নিয়মে প্রতিদিনের মতো ২৩ আগস্ট রাতেও ঘুমানোর জন্য গিয়েছিলাম বিছানায়। মোবাইল ফোনটি রেখে এসেছিলাম ওয়ার্ড্রবের ওপর। বিছানায় যাওয়ার পরই একটি ফোন আসল। উঠে রিসিভ করলাম ফোনটি। কথা বলে বিছানায় যাওয়ার সময় অভ্যাসবশত: মনে হলো দেখি সারাদেশের আজকের শেষ সংবাদটি কী? একটি পত্রিকায় নক করতেই দেখি সিলেট সীমান্তে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি এএইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক গ্রেফতার হয়েছেন। খুবই জবুথবু অবস্থা তার! শুয়ে আছেন কলাপাতার ওপর। হাত-পা বাধা। তার গলাও আটকানো। সে-টি ধরে আছেন একজন! এ ছবি দেখে মনটা ভীষণ বিষণœ হয়ে গেল! কেন-এমন অবস্থা হবে একজন বিচারপতির! ঘুম চলে গেল মুহূর্তেই!
পত্রিকা রেখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে গেলাম। দেখি সেখানে ভাইরাল হয়ে পড়েছে বিচারপতি মানিককে আটকের দুটি ভিডিও। এর মধ্যে সীমান্তবর্তী এলাকায় ধারণ করা একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, জঙ্গলের মতো একটি স্থানে শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত অবস্থায় কলাপাতায় শুয়ে আছেন। তার পরনে গাঢ় নীল চেকের হাফহাতা শার্ট আর মাটিমাখা ময়লা-ভেজা প্যান্ট।
ভিডিওতে একজনের উদ্দেশে মানিককে বলতে শোনা যায়, ‘আমি তোমাদের পয়সা দিয়ে দেব।’ উত্তরে ব্যক্তিটি বলেন, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’ মানিক এরপর বলেন, ‘পয়সা আমি দেব। আমার ভাইবোনেরা দিয়ে দেবে।’
জবাবে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘আমাদের পয়সার কোনো প্রয়োজন নেই। ঠিক আছে? আপনি যদি সেফটি মানে…।’ কথার মাঝখানে ওই ব্যক্তিকে থামিয়ে শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, ‘ওই ফালতু লোক দুইটারে আনিও না। আমি এই দেশে (ভারত) এত কষ্ট করে এসেছি, কি বাংলাদেশে ফেরত যাওয়ার জন্য?’ আফনে ইন্ডিয়া পালাইতেছিলেন কেনে? বলেন?’ শামসুদ্দিন মানিক বলেন, ‘ভয়ে পালাইতেছি।’
প্রশ্নকর্তা ‘কার ভয়ে’ জিজ্ঞাসা করলে উত্তরে শামসুদ্দিন বলেন, ‘প্রশাসনের ভয়ে।’
কেন একজন বিচারপতিকে দেশ থেকে এভাবে পালিয়ে যেতে হবে? তার মানে ক্ষমতায় থাকাকালে মানিকরা ছিলেন এক একটা দৈত্য। তাই ক্ষমতা হারানোর পর তার মতো একজন বিচারপতি দেশে থাকার নিরাপত্তাবোধ করেন নি! তিনি আসলে বিচারপতি নামের একজন কলঙ্ক।
এর আগে ধরা পড়ার পর দেখেছি, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও দরবেশখ্যাত পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে। ঢাকার সদরঘাট দিয়ে নৌকায় করে পালিয়ে যাওয়ার সময় দেখেছি তাদের বিধ্বস্ত অবস্থা। একই অবস্থা দেখেছি, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি ও বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার সময় ঢাকা বিমানবন্দরে আটক সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের। দীপুমণিকে আদালতে হাজির করা হলে ক্ষুব্ধ আইনজীবীরা তার ওপর চড়াও হন। আর গ্রেপ্তারের পর থেকেই বেশিরভাগ সময় কান্নাকাটি করেন জুনাইদ আহমেদ পলক।
বিভিন্ন সংবাদপত্র সূত্রে জানা যায়, রিমান্ডে প্রশ্ন করলেই পলক মাথা নিচু করে কাঁদছেন, কেঁপে উঠে কুঁকড়ে যাচ্ছেন। অন্য যারা গ্রেফতার হয়েছেন তাদের অবস্থাও একই রকম। কিন্তু গত ৫ আগস্টের আগেও তাদের ছিল ক্ষমতার প্রচ- দাপট।
শুধু কী তাদের ক্ষমতার দাপট ছিল? না এখন বেরিয়ে আসছে শেখ সেলিম, দরবেশ বাবা, আনিসুলদের রক্ষিতাদের রগরগা কাহিনীও। হয়তো সামনে আরো অনেক কাহিনী বেরিয়ে আসবে।
শুধু বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিক অথবা আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান, পলক বা শাকিল-ফারজানা রূপা দম্পত্তি নয়, ভবিষ্যতে আর কাউকে যেন আমরা এ রকম বিপদে পড়তে না দেখি। সহজেই বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক বনে যাওয়া আর অবৈধ ক্ষমতার লোভ সংবরণ করতে পারলেই হয়তো এ-রকম দৃশ্য আর দেখতে হবে না। আর ক্ষমতা ও অর্থ-বিত্তের লোভ সংবরণ করতে না পারলে ভবিষ্যতে হয়তো আবারো ছাত্র-জনতাকে মাঠে নামতে হবে। কিন্তু আমরা তো সে-টা চায় না।
লেখক : সংবাদকর্মী