ভারী বর্ষণ আর ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ডুবে গেছে দেশের কয়েক জেলার লোকালয়। ফেনী, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, মৌলভীবাজারের বাসিন্দারা পড়েছেন সবচেয়ে বিপদে। পানিবন্দি হয়ে আছেন এসব জেলার লাখ লাখ মানুষ। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তবর্তী নদীবেষ্টিত মৌলভীবাজারের কুশিয়ারা, মনু, ধলাই ও জুড়ী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে।
ভারত থেকে আসা ঢলে ফেনীর মুহুরী নদীর পানি বেড়ে ফুলগাজী ও পরশুরামের বিস্তীর্ণ এলাকা ডুবে গেছে। কুমিল্লায় গোমতী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইতে থাকায় দেখা দিয়েছে বন্যা। পানি বাড়তে শুরু করেছে নোয়াখালী অঞ্চলেও। তিন পার্বত্য জেলাসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও দক্ষিণাঞ্চলেও নদনদীর পানি বেড়ে তলিয়েছে অনেক নিম্নাঞ্চল।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর বলছে, কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে বাংলাদেশসংলগ্ন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ত্রিপুরা রাজ্যে। সেখানে বন্যা ও ভূমিধসে আটজন নিহত হয়েছেন, নিখোঁজ আছেন দু’জন। বন্যার কারণে ত্রিপুরা রাজ্য সরকার ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ খুলে দিয়েছে। ফলে গোমতী ও ফেনী নদীর পানি হঠাৎ বেড়ে বাংলাদেশে দেখা দিয়েছে বন্যা। এ ছাড়া সিকিমে পাহাড়ধসে ভেঙে গেছে তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের একটি বাঁধ। ফলে পাশের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবা বাঁধে পানির চাপ অস্বাভাবিক বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গে বন্যার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। আর এতেই তিস্তার পানি নিয়ে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলায় জেলায়।
দু’দিন ধরে ঢাকার চেয়ে দেশের অন্য অঞ্চলে বৃষ্টি হয়েছে বেশি। আজ বৃহস্পতিবারও একই পরিস্থিতি থাকতে পারে। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় যে ভারী বৃষ্টি শুরু হয়েছে, তা অব্যাহত থাকার পূর্বাভাস আছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্র বলছে, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপটি ইতোমধ্যে দেশের মধ্যাঞ্চল ও আশপাশ এলাকায় অবস্থান করছে। এর প্রভাবে দেশের বেশির ভাগ এলাকা কালো মেঘে ঢেকে গেছে। উপকূলীয় এলাকায় দমকা হাওয়া বইছে। শক্তিশালী হয়ে উঠছে মৌসুমি বায়ু। সব মিলিয়ে বৃষ্টি বেড়েছে। দমকা হাওয়া বয়ে যাওয়ার কারণে উপকূলসহ দেশের নদীবন্দরগুলোতেও ঝোড়ো বাতাস বয়ে যাচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মনোয়ার হোসেন বলেন, মৌসুমি বায়ু শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। আবার সাগরে সৃষ্ট সুস্পষ্ট লঘুচাপটি দেশের মধ্যাঞ্চলে অবস্থান করছে। এ কারণে আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীসহ অন্য অঞ্চলে বৃষ্টি আরও বাড়তে পারে। এ বৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে আগামী এক সপ্তাহ। আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে ময়মনসিংহ, সিলেটসহ উপকূলীয় এলাকার নদীবন্দরে ১ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে। বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।
ব্যুরো, প্রতিনিধি ও সংবাদদাতার পাঠানো তথ্য বলছে, ফেনীর পরশুরাম ও ফুলগাজীতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পরশুরামে বন্যার পানিতে ভেসে একজন নিখোঁজ রয়েছেন। ফেনী-পরশুরাম সড়কে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। কয়েকটি ডিঙি নৌকায় লোকজনকে উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হলেও বেশির ভাগ মানুষ এখনও পানিবন্দি। গ্রামীণ সব সড়ক ও ফসলের মাঠ তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে পুকুর ও খামারের মাছ। দুর্গতদের উদ্ধারে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা কাজ করছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে সেনাবাহিনী ও কোস্টগার্ডের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।
ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর ও আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন পুলিশ চেকপোস্ট প্লাবিত হয়েছে। গতকাল সকাল ১০টার পর ইমিগ্রেশনের সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। গাজীরবাজার এলাকায় একটি অস্থায়ী সেতু ভেঙে আখাউড়া-আগরতলা সড়কে বন্ধ হয়ে গেছে যান চলাচল। উপজেলার অন্তত ৫০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যেই গতকাল আখাউড়ায় বন্যার পানিতে ডুবে সুবর্ণা আক্তার (১৯) নামে এক অন্তঃসত্ত্বা নারী মারা গেছেন। সুবর্ণা আখাউড়া দক্ষিণ ইউনিয়নের বীরচন্দ্রপুর গ্রামের পারভেজ মিয়ার স্ত্রী। এ ছাড়া কসবা উপজেলায় তিতাস, সালদা, সিনাই, বুড়ি, বিজনা নদীর পানি বেড়ে ২০ গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে হাজার হেক্টর জমির রোপা আমন ও ৩০ হেক্টর জমির সবজির ক্ষেত।
গতকাল সিলেটের বিভিন্ন পয়েন্টের নদনদীর পানি বেড়েছে। কুশিয়ারা নদীর পানি দুটি পয়েন্টে প্রবাহিত হচ্ছে বিপৎসীমার ওপরে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সিলেট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, সিলেটে বৃষ্টি কমে এলেও বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। মূলত ভারত সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় সিলেটে পাহাড়ি ঢলের ফলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
ধলাই নদীর চার স্থানে প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে বন্যা দেখা দিয়েছে। উপজেলার ১৩০ গ্রাম প্লাবিত হয়ে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ এখন পানিবন্দি। বৃষ্টিতে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতরে সড়কের পাশে ৩টি টিলা ও আদমপুর ইউনিয়নের কালেঞ্জি খাসিয়া পুঞ্জিতে কয়েকটি ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। কুলাউড়ার পৃথিমপাশা ও টিলাগাঁও ইউনিয়নে মনু নদীর বাঁধের দুটি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। পাউবো ও স্থানীয় লোকজন বালুর বস্তা দিয়ে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করছেন। তবু প্লাবিত হয়েছে অন্তত ২০ গ্রাম। হবিগঞ্জের মাধবপুরেও সোনাই নদী উপচে রোপা আমনসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ভেসে গেছে পুকুর, খামারের মাছ।
কুমিল্লার গোমতী নদীর পানি বেড়ে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় চার হাজার হেক্টর এলাকার ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। মঙ্গলবার রাত থেকে বৃষ্টি ও ঢলের পানি ক্রমাগত বাড়ছে। চরাঞ্চলের সহস্রাধিক পরিবার বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। চরাঞ্চলে ফসলেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া লক্ষ্মীপুরসহ বৃহত্তর নোয়াখালীর বিভিন্ন এলাকাও প্লাবিত হয়েছে।
বৃষ্টিতে বিভিন্ন নদীর পানি বেড়ে প্লাবিত তিন পার্বত্য জেলাসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল। ফটিকছড়ির হালদা, ধুরুং নদী, লেলাং খাল, সর্তা খাল, ফেনী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কয়েকটি এলাকার প্রধান সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নে বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে পড়েছে কয়েক গ্রামে। পানিবন্দি রয়েছে অন্তত পাঁচ হাজার মানুষ।
চেঙ্গী ও মাইনী নদীর পানি বেড়ে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে বন্যা দেখা দিয়েছে খাগড়াছড়িতে। এরই মধ্যে ৫০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বাঘাইহাট এলাকায় সড়ক ডুবে যাওয়ায় সাজেক পর্যটন এলাকায় আটকা পড়েছেন দুই শতাধিক পর্যটক। খাগড়াছড়ি সদর, দীঘিনালা এবং মেরুং ইউনিয়নের অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। দীঘিনালা-লংগদু সড়কের কিছু অংশ প্লাবিত হওয়ায় রাঙামাটির সঙ্গে লংগদুর যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
দক্ষিণাঞ্চলেও সব নদনদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অস্বাভাবিক জোয়ারে প্লাবিত হয়েছে নদী তীরবর্তী জনবসতি। বরিশাল নগরীর নিম্ন এলাকাগুলোতে কীর্তনখোলা নদীর জোয়ারের পানি ঢুকেছে।
হঠাৎ কেন এতবার বন্যা
চলতি বছর এ নিয়ে পাঁচ দফা বন্যার কবলে পড়েছে দেশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর পেছনে রয়েছে বেশ কিছু কারণ। অপরিকল্পিত বাঁধ, নদীর নাব্য সংকট, খাল হারিয়ে যাওয়াসহ নানা কারণে বন্যার সৃষ্টি হয়। নদী, খাল যে পরিমাণ পানি বহন করতে পারত, সে ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। ফলে ভারি বৃষ্টি হলেই বন্যার কবলে পড়ছে মানুষ।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমাদের বর্ষা মৌসুম। এ সময় বাংলাদেশে স্বাভাবিক বন্যা হয়। আমাদের বৃষ্টির ৭০ শতাংশই এ সময়ে হয়। উজানে থাকা ভারতের একটা অংশেও এ সময়ে ভারী বৃষ্টি হয়। ফলে আমাদের এখানে বন্যার বিষয়টি নির্ভর করে তাদের ওখানে কী পরিমাণ বৃষ্টি হচ্ছে এর ওপর। আমাদের তিস্তায় কিন্তু দ্রুত পানি চলে আসে, আবার দ্রুত কমে যায়। এখন ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপরে আছে। এর প্রধান কারণ জুলাইয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫২ শতাংশ বৃষ্টি কম হয়েছে। ওই সময় চট্টগ্রামে ব্যাপক বৃষ্টি হয়। এক মাসের বৃষ্টি ৫-৬ দিনে হয়ে গেছে। প্রতি বছরই এখানে বর্ষায় যে পানি আসে, সেখানে কিছু না কিছু বন্যা হয়। এ মুহূর্তে বড় বন্যার শঙ্কা কম। তবে মৌসুমি বায়ু সক্রিয় আছে। ১৯৯৮ বা ১৯৮৮ সালেও কিন্তু সেপ্টেম্বরে বন্যা হয়েছে। ফলে আমাদের প্রস্তুতি রাখতে হবে, যাতে ক্ষয়ক্ষতি কমানো যায়।
খুলনা গেজেট/এইচ