কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঢাকায় নিহত হয়েছে খুলনার দুই ছেলে। এর মধ্যে খুলনা নগরীর নবপল্লী এলাকার শেখ মো. সাকিব রায়হান বেসরকারি একটি মুঠো ফোন কোম্পানিতে চাকরি করতেন। সম্প্রতি যোগ দিয়েছিলেন অর্থনীতি শুমারির মাঠ কর্মী হিসেবে। গত ১৯ জুলাই বিকেলে গুলিতে নিহত হন তিনি।
অন্যদিকে খুলনার রূপসা উপজেলার রহিমনগর গ্রামের ইয়াসিন শেখ ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকার একটি এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের দোকানে ডেলিভারিম্যানের কাজ করতেন। গত ২০ জুলাই গ্রাহকের বাসায় গ্যাস পৌঁছে দিয়ে ফেরার সময় গুলিতে আহত হন। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৫ জুলাই মারা যান তিনি।
আদরের দুই সন্তান হারিয়ে মায়েদের কান্না এখনও থামছেনা। পরিবার দুটিও অসহায় হয়ে পড়েছে।
সাকিব রায়হান
সাকিবের বাবা শেখ মো. আজিজুর রহমান জানান, ১৯ জুলাই বিকালে ঢাকার সোহরাওয়াদী হাসপাতাল থেকে একজন ফোন করে জানায়, তার ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। পরদিন ভোরে তার মেঝো ছেলে অ্যাম্বুলেন্সে করে মরদেহ নিয়ে এলাকায় ফেরেন। পরে জানাজা শেষে বসুপাড়া কবরস্থানে সাকিবকে দাফন করা হয়। তবে সেদিন ঢাকায় কীভাবে কী ঘটেছিল তার কোনো কিছুই জানেন না সাকিবের পরিবার। আজিজুর রহমান বলেন, ‘বিচার, না কারও কাছে বিচার চাই না। বিচার আল্লাহপাক করবে। এ নিয়ে আমার কোনো কিছু বলার নেই।’
সাকিবের বাবা কথা বলার সময় তার পাশে এসে দাঁড়ান মা নূরুন্নাহার বেগম। তিনি বলেন, ‘আমাদের কিছু বলার নেই। মরদেহ ফেরত পেয়েছি, আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। কত মা তো তাও পায়নি।’ সাকিবের মেঝো ভাই সাব্বির রায়হান বলেন, যদি এমন হতো যে, ভাইকে ফেরত পেতাম, তাহলে তা-ই চাইতাম। অন্য কিছুই চাই না।
নবপল্লী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ছোট একটা গলিতে জীর্ণশীর্ণ ঘরে থাকেন সাকিবের পরিবার। কাছেই আন্নী এন্টারপ্রাইজ নামে ছোট একটি মুদি দোকান চালান বাবা আজিজুর রহমান। ঘরবাড়িজুড়ে অভাব-অনটনের ছাপও স্পষ্ট। সাকিবের বড় বোন বিয়ের পর থেকে থাকেন রাজধানীর মিরপুরে। আর মেঝো ভাই সাব্বির রায়হান, ঢাকায় অনলাইনে ছোটখাটো একটি ব্যবসা করেন।
সাকিবের মা-বাবা বলেন, সাকিবকে অনেকবার খুলনায় ফিরে আসতে বলেছি। তবে ও বলতো, খুলনায় কিছু করার সুযোগ কম। ঢাকায় চাকরি অথবা ব্যবসা করে তোমাদের মুখে হাসি ফোটাবো, এরপর ফিরবো। ১ আগস্ট থেকে নতুন চাকরিতে যোগ দেয়ার কথা ছিল সাকিবের। তবে ওই সুযোগ পায়নি সাকিব। তার এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না এলাকাবাসীও। স্থানীয়দের দাবি সাকিব ছিলেন নম্রভদ্র একটি ছেলে। কারো সঙ্গে কখনো বিরোধও দেখিনি এলাকার কেউ। পাশাপাশি সে কোনো রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না বলেও জানান তারা।
ইয়াসিন শেখ
সোমবার (২৯ জুলাই) সকালে মনজিলা’র বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, জীর্ণশীর্ণ কুড়ে ঘরে বসবাস তাদের। মনজিলা বেগম জানান, ইয়াসিন গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর কয়েকটা ছেলে ঢাকার যাত্রাবাড়ী মাতুয়াইল এলাকায় আমার ভাড়া বাসায় এসে জানায়। তখন আমার কাছে একটা টাকাও ছিল না, অনেক অনুরোধের পর রিকশাচালক বিনা ভাড়ায় আমাকে ইয়াসিনের কাছে নিয়ে যায়। এরপর তাকে মুগদা হাসপাতালে ভর্তি করি। পরে সে মারা যায়। মৃত্যুর পর মরদেহ গ্রামের বাড়িতে আনতেও অনেক হয়রানি পোহাতে হয়।
তিনি বলেন, ‘আমার ছেলের কোনো দোষ ছিল না। সে পথচারী ছিল। সে কোনো দল করতো না। কাজ করতো, ভাত খেত। আমি মানুষের বাড়িতে কাজ করি। ইয়াসিনের আয় দিয়েই বাসা ভাড়াসহ সংসার চলতো। আমাকে কাজ করে খাওয়ানোর মতো কেউ নেই। আমি এখন কী করে চলবো, আমাকে কে খাওয়াবে? আমার তো সব শেষ। এত অল্প বয়সে যে আমার বুক খালি করবে ভাবতে পারিনি। যার সন্তান যায় সেই মা-ই বোঝে তার সন্তানের দরদ। গ্রামের লোকজন চাঁদা তুলে টাকা দেয়, তারপরে অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ বাড়ি আনি।
খুলনা গেজেট/হিমালয়