বাঙালি মুসলমানের জীবনে রমজান মাস নানান তাৎপর্য ও বৈচিত্র্য নিয়ে হাজির হয়। মুসলমানদের ওপর রমজানের এক মাস রোজা ফরজ করা হয়েছে। আল্লাহ’তালা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ রমজান মাস পাবে সে যেন অবশ্যই রোজা পালন করে।’ এক মাসের সংযম সাধনার মাধ্যমে এ সময় পাল্টে যায় বাঙালির চিরচেনা জীবনচিত্র। হিজরি দ্বিতীয় বর্ষে ইসলাম ধর্মে রোজা ফরজ হওয়ার পর থেকেই তা ইসলামি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অনুঅঙ্গ হিসেবে সারা বিশ্বে পালনের বিষয় হয়ে ওঠে। সঙ্গত কারণ মুসলমানদের কাছে রোজার তাৎপর্য অনেক।
রমজান এলেই মুসলমানদের জীবনধারায় যোগ হয় শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা। পৃথিবীর সকল মুসলিম একই ও নিয়ম মেনে রোজা পালন করে। ধনী-গরিব একই নিয়ম রীতিতে সেহরি থেকে ইফতার পর্যন্ত ক্ষুদা-পিপাসার যন্ত্রণা ভোগ করে। রমজানে প্রতিদিন বাঙালি নারীরা নিজ নিজ অঞ্চলের প্রচলন অনুযায়ী ইফতারে নানা মুখরোচক খাবার তৈরি করে। সাধারণত তারা শরবত, পিয়াজু, বেগুনি, আলুর চপ, হালিম, ছোলা-মুড়ি, দই-চিড়া, খেজুর, জিলাপি ও মৌসুমি নানা ফল দিয়ে ইফতার করে। ইফতারের দশ-পনের মিনিট আগে ইফতার সামগ্রী সামনে নিয়ে পরিবারের সবাই এক সাথে বসে। এতে মুসলিমদের মধ্যে পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের এক স্বর্গীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
বর্তমানে শহর-গ্রাম সর্বত্রই পাড়া বা মহল্লাবাসী প্রতিদিন মসজিদে ইফতারের আয়োজন করা হয়। এ ইফতারে পথশিশু থেকে শুরু করে মুসল্লি ও সর্বসাধারণ অংশগ্রহণ করে। এছাড়া পুরো রমজান মাস জুড়েই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, দল ও সংস্থার পক্ষ থেকে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এ ধরনের আয়োজন যেমন তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তোলে, তেমনি সাম্য ও প্রীতির বন্ধনেও আবদ্ধ করে। এ প্রসঙ্গে ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী পিয়ের বর্দুর বলেন, ধর্মীয় ঐতিহ্যের ভিত্তিতে সৃষ্ট এ ধরনের সম্পর্ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সামাজিক পুঁজি মূলধন গঠনের অন্যতম উৎস। মানুষ যখন স্বেচ্ছায় অন্যের বিপদে এগিয়ে আসে, তখন বোঝা যায় সামাজিক পুঁজির উপকারিতা ও আবশ্যকতা। যার সামাজিক পুঁজি যত বেশি, তার বিপদ থেকে উদ্ধার হওয়ার সম্ভাবনাও তত বেশি।
দেশে এক সময় রোজার ঐতিহ্য ছিল কাফেলার হাঁকডাকে বিছানা ছেড়ে উঠে ঘুম ঘুম চোখে সেহরি খাওয়া। সেহরির সময় ঘুম থেকে ডেকে তোলাও রমজান মাসের ঐতিহ্য। তখন অল্পবয়সী কিশোর-যুবকেরা দল বেঁধে পাড়ায় বা মহল্লায় ঘুরে ঘুরে মাইকে গজল গেয়ে রোজাদারদের ঘুম ভাঙাতো। এদেরকে বলা হত কাফেলা দল। শহরে বিভিন্ন পাড়া বা মহল্লার অলিতে গলিতে নানা নামে কাফেলার দল এ দায়িত্ব পালন করত। বিনিময়ে তারা ইদের আগে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অর্থ উঠাতো। অনেক এলাকায় ইদের দিন মাঠেও এ অর্থ উত্তোলনের রীতির প্রচলন ছিল। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে সেহরির সময় যারা ঘুম ভাঙান, তাদের সেহরিওয়ালা বলে ডাকা হয়। তারাও পাড়া ও মহল্লার রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ইসলামি গজল ও সংগীত পরিবেশন করে। এই সংস্কৃতি ক্রমে কমে এলেও পুরান দিল্লিতে এখনো তা টিকে আছে। এছাড়া দেশে অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষ ব্যক্তি উদ্যোগে সেহরির সময় ঘুম ভাঙাতো। এখন আর এ ধরনের সংস্কৃতি তেমন চোখে পড়ে না। বর্তমান দেশের প্রায় সকল মসজিদে মাইকে সেহরির সময় শেষ হবার আগে সতর্ক করা হয়। অনেক এলাকায় মাইকে বাজানো হয় গজল, হামদ, নাত প্রভূতি। আবার দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের মত এদেশেও ইফতার ও সেহরির সময় সাইরেন বাজানোর সংস্কৃতি এক সময় চালু ছিল। এখনও বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে সাইরেন বাজিয়ে ইফতার ও সেহরির সময় জানানো হয়। বর্তমানে সকল মসজিদে মাইকের সাহায্যে ইফতার ও সেহরির সময় ঘোষণা করা হয়।
মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে রোজা যেন এক উসব। রোজা নিয়ে শিশু-কিশোরদের পাশাপাশি বড়দের মধ্যেও ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা চোখে পড়ে। কখন রমজানের চাঁদ দেখা যাবে, কখন সেহরি কিংবা ইফতার হবে, তারাবীহ নামাজ কোথায় পড়বে, এসব নিয়ে যেন তাদের উদ্বেগ সীমাহীন। এছাড়া রোজার অন্যতম অনুষঙ্গ হলো ঈদের প্রস্তুতি। ঈদে নতুন সাজপোশাক তো বটেই, সঙ্গে চাই বাহারি সব খাবারদাবার। ইদকে কেন্দ্র পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, গৃহকর্মী, অফিসের সহায়ক কর্মচারী ও পাড়া প্রতিবেশিদের জন্য উপহার সামগ্রী কেনা হয়। বাংলাদেশে ইদের কেনাকাটা শবেবরাতের পর থেকেই শুরু করে চাঁদরাতে অর্থাৎ ইদের আগের রাত পর্যন্ত চলে। এ উপলক্ষ্যে প্রায় প্রতিটি বাজার আলোকসজ্জায় সজ্জিত হয়ে ওঠে। ঈদ উপলক্ষে প্রায় সবাই সাধ্যমতো জামাকাপড় কেনা থেকে শুরু করে নানা ধরনের উপহারসামগ্রী বিনিময় করে। একসময় দেশে ইদ কার্ড বিনিময়ের প্রচলন ছিল। সে সময়ে কার্ড কোম্পানিগুলো ইদ উপলক্ষ্যে নানা রঙের বাহারি কার্ড তৈরি করত। বন্ধু বান্ধবী, আত্মীয় স্বজন, অনেক সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের কার্ড ইদের শুভেচ্ছা উপহার হিসেবে বিনিময় করা হতো। এতে করে সবার মধ্যে আন্তরিকতা বৃদ্ধি পেত।
আল্লাহর দৃষ্টিতে বিশ্বের সকল মানুষই সমান। এই ধ্যানধারণাকে আরো জোরদার করে তোলে রোজা। প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী রোজা থাকার একই অভিজ্ঞতা লাভ করে। রোজার মাধ্যমে ধনী ব্যক্তিরা গরিব দুঃখী মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে শেখে। আসলে রোজার সামাজিক দিকগুলোও খুবই শিক্ষণীয় এবং সবার জন্য অনুসরণীয়। যেমন-
১। রোজা পালন করলে যেহেতু মুসলমানদের মধ্যে আত্মসংযমের অভ্যাস গড়ে উঠে। একে অপরের সাথে আচার ব্যবহারেও এর প্রতিফলন ঘটে। সমাজে বিশৃংখলা ও শান্তিভঙ্গের আশংকাও কমে যায়। পরস্পরের মাঝে ধৈর্য, ক্ষমা, সহানূভূতি ও সহমর্মিতা চর্চার ফলে সমাজ ও পারিবারিক জীবনে মিথস্ক্রিয়া ও সংহতি গড়ে ওঠে।
২। ইসলামে রোজাদাররা কাউকে ইফতার করালে তার গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া এবং জাহান্নাম থেকে রক্ষার জন্য পুরস্কার ঘোষণা রয়েছে। উপরন্তু রোজাদারদের রোজার সওয়াবও কমে না। ফলে একে অপরকে ইফতার করানোর মাধ্যমে মুসলমানদের মাঝে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বন্ধন মজবুত হয়।
৩। সামাজিক মানুষ হিসেবে প্রতিবেশীর সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ, আন্তরিক ও সহানুভূতিশীল আচরণের মধ্য দিয়ে তাকে বাঁচতে হয়। তাই প্রতিবেশীর অধিকার ও মর্যাদার প্রতি ইসলামে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রোজার মাসে প্রতিবেশীদের মধ্যে ইফতার বিনিময় করা হয়। এতে করে তাদের যেমন প্রতিবেশির হক আদায় হয় তেমনি তাদের মধ্যে আন্তরিকতা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যা সামাজিক জীবনের অন্যতম অনুসঙ্গ।
৪। রোজার মাসে প্রতিটি নেক আমলের মর্যাদা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। তাই যাদের উপর যাকাত ফরয তারা সাধারণত এ মাসেই যাকাত আদায় করে থাকে। এতে করে সমাজের দরিদ্র মানুষদের যাকাতের অর্থ দিয়ে কিছুটা হলেও তাদের দারিদ্র্য বিমোচনের সুযোগ লাভ করে। এ ধরনের কর্মকা- ধনী-গরীবের মধ্যকার বৈষম্য দূর করে বৈষম্যহীন সুখী-সমৃদ্ধ সমাজ গড়তে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
পরিশেষে বলতে হয়- রোজা ধৈর্য, ক্ষমা, সহনশীলতার মত মানবীয় গুণাবলীর বিকাশ ঘটায় এবং সমাজের মানুষের মধ্যে কল্যাণের চর্চার উন্মেষ ঘটে। রোজার শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণ রোজাদারকে প্রকৃত মুসলিম ও সামাজিক হওয়ার সুযোগ করে দেয়। মুসলমানরা রোজার মাধ্যমেই মহান আল্লাহর সঙ্গে গভীর ও নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং হৃদয়ে তাকওয়া সৃষ্টি হয়। ফলে মানব মনে এক অভাবনীয় প্রশান্তি আসে। বিশ্বায়ন ও তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে সারা বিশ্বে যখন পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনগুলো শিথিল হয়ে আসছে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বাড়ছে, তখন রোজার সংস্কৃতি পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কেও বন্ধন দৃঢ়, বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ ও সৌহার্দ্য জাগ্রত করছে বলে সমাজ বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও প্রধান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর।