লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগরে অবৈধভাবে ইতালিতে যাওয়ার পথে তিউনিশিয়ার সমুদ্র উপকূলে নৌকাডুবিতে নিহত ৯ জনের আটজনই বাংলাদেশি। তাদের মধ্য পাঁচজনের বাড়ি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলায়। বাকি তিনজনের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে। লিবিয়ার দূতাবাসের মাধ্যমে বাংলাদেশিদের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়ার পর থেকে তাদের পরিবারে চলছে শোকের মাতম। প্রিয় সন্তানকে হারিয়ে স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে পরিবেশ।
মৃতরা হলেন মাদারীপুরের রাজৈরের কোদালিয়া গ্রামের মিজানুর রহমান কাজীর ছেলে সজীব কাজী (১৯), পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামের ইউসুফ আলী শেখের ছেলে মামুন শেখ (২২), সেনদিয়ার গ্রামের সুনীল বৈরাগীর ছেলে সজল বৈরাগী (২২), উত্তরপাড়া গ্রামের পরিতোষ বিশ্বাসের ছেলে নয়ন বিশ্বাস (২৪), কেশরদিয়া গ্রামের কাওসার (২২), গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার বড়দিয়া গ্রামের দাদন মিয়ার ছেলে রিফাদ (২১), ফতেয়পট্টি এলাকার মো. রাসেল (২০) ও গয়লাকান্দি গ্রামের পান্নু শেখের ছেলে ইসরুল কায়েস আপন (২২)। এই দুর্ঘটনায় আরও এক পাকিস্তানি নাগরিকও মারা গেছেন বলে জানা গেছে।
মাদারীপুরের পাঁচজনের মধ্যে গত শুক্রবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) মৃত্যুর খবর আসে মামুন শেখ ও সজল বৈরাগীর। এর তিনদিন পর মঙ্গলবার মৃত্যুর খবর আসে কায়সার খলিফা, সজীব কাজী ও নয়ন বিশ্বাসের।
স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইতালির স্বপ্ন পূরণে তাদের কারও কারও জমি বিক্রি করতে হয়েছে, সুদে ঋণ নিতে হয়েছে। তাই ভূমধ্যসাগরে তাদের এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না স্বজনরা। ঘটনায় জড়িত দালালদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে পরিবার।
নিহতের স্বজনদের সঙ্গে কথা বললে তারা গণমাধ্যমে জানান, দুই মাস আগে রাজৈর উপজেলার মামুন, সজল, কায়সার, সজীবসহ কয়েকজন ইতালি যেতে বাড়ি থেকে বের হন। গত বুধবার লিবিয়া থেকে ইঞ্জিনের একটি ছোট নৌকায় তাদের ওঠানো হয়। ৩২ জন ধারণক্ষমতার নৌকায় ছিল ৫৩ জন। ইতালি যাওয়ার পথে তিউনিসিয়া সমুদ্র উপকূলে নৌকায় পানি উঠে ডুবে যায়। এতে মামুন, সজল, কায়সার, সজীবসহ নয়জন মারা যান। কয়েকজনকে জীবিত উদ্ধার করে স্থানীয় কোস্ট গার্ড।
নিহতদের একজন সজীব কাজি (১৮)। তার বাবা মিজানুর রহমান কাজী জানান, সজীবকে ইতালি নিতে গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার রাঘদী ইউনিয়নের গজনিয়া গ্রামের মানব পাচারকারী রহিমের সঙ্গে ১৪ লাখ টাকায় চুক্তি হয়। রহিমের ভাই কামাল আমার কাছ থেকে নগদ ১২ লাখ নিয়ে ছেলেকে লিবিয়া পাঠায়। পরে অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই ইঞ্জিনের নৌকায় ইতালি পাঠানোর সময় ঘটে এই দুর্ঘটনা। শুনছিলাম আমার ছেলে সজীব আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন ছিল। দুই দিন পরে মৃত্যুর খবর পেয়েছি।
তিনি আরও বলেন, মানব পাচারকারী নারী মনিকা, রহিম কাজি ও কামাল কাজির বোন। বিয়ে হয়েছে রাজৈর উপজেলার তেলিকান্দি গ্রামে। অধিকাংশ টাকার লেনদেন করেছেন এই মনিকার সঙ্গে।
এ বিষয়ে মনিকার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তাকে পাওয়া যায়নি। মোবাইলে ফোন দিলে সেটিও বন্ধ পাওয়া যায়। স্থানীয়দের জিজ্ঞাসাবাদ করলে এ ব্যাপারে কেউ মুখ খোলেনি।
নিহত সজল বৈরাগীর বার সুনীল বৈরাগী বলেন, সজল এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। দুই মাস আগে মানবপাচারকারী মোশারফ কাজি তার বাড়িতে এসে তার সংসারের বড় ছেলে সজল বৈরাগী (২০) কে ইতালি নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। লোভনীয় প্রস্তাবে রাজি হয়ে পাসপোর্ট করাবে বলে মানব পাচারকারী মোশারফের ছেলে যুবরাজ ৫০ হাজার টাকা নেয়। লিবিয়ার উদ্দেশ্য বিমানে উঠার আগে নেন ৬০ হাজার। সাগর পারি দেওয়ার আগে আরও ১১ লাখ টাকা নেয় মানব পাচার কারী সদস্য যুবরাজ কাজি ।
তিনি আরও বলেন এরপর সাগর পাড়ি দিতে ৩০ জনের ছোট নৌকায় ৫৩ জন যাত্রী নিয়ে তিউনিশিয়া উপকূল থেকে রওনা দেয়। অতিরিক্ত যাত্রী হওয়ায় পানি উঠে নৌকাটি ডুবে যায়। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি জানতে পারি ছেলেরও নাম রয়েছে মৃতদের তালিকায়। পরিবারের বড় ছেলের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে সজলের মা পুষ্প রানী বৈরাগী অনেকটা ভারসাম্যহীন হয়ে পরেছেন। হারিয়ে ফেলেছে মুখের ভাষা। কমছে না চোখের পানি। শুধু একটাই চাওয়া তার ছেলেকে যেন ফিরে পায়।
সুনীল বৈরাগী অনেক স্বপ্ন নিয়ে জমি বিক্রি করে ছেলের জন্য দালালের কাছে টাকা দিয়েছিলেন। চুক্তি অনুযায়ী ১৪ লাখ টাকায় ইতালী পৌঁছানোর কথা থাকলেও পৌঁছানোর পর আরও ২ লাখ টাকা দেওয়ার কথা ছিল পরিবারের। বাকির খাতায় এখন রয়ে গেল একটা স্বপ্ন আর একরাশ বেদনা। মানব পাচারকারীর মূল হোতা লিবিয়াতে বসবাস করে। তবে যারা টাকা নিয়েছে এখন তারা পলাতক।
নিহত কায়সার খলিফার দুই মেয়ে রয়েছে। স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী নাজমা বেগম দিশেহারা। তিনি অসুস্থ থাকায় কথা বলতে পারেননি। নাজমার ভাই পরিচয়ে (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) একজন জানান, কাওসারকে ইতালি নেওয়ার জন্য যাদের কাছে টাকা দিয়েছেন। তারা তাদের আত্মীয় স্বজন। ঘটনাটি নিজেদের মধ্যে মীমাংসা করা হয়েছে।
নয়ন বিশ্বাসের ভাই আকাশ বিশ্বাস বলেন, আমার ভাই ঢাকার এক মানবপাচারকারীর মাধ্যমে লিবিয়া যায়। পরে এই দুর্ঘটনার খবর শুনেছি। তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ রয়েছে। তিনি বলেছেন, আমার ভাই ভালো আছে। কিন্তু মিডিয়ার মাধ্যমে খবর পাচ্ছি, আমার ভাইয়ের নাম মৃতদের তালিকায় আসছে। এখন বুঝতেছি না, সে আদৌ বেঁচে আছে কী না?
রাজৈর উপজেলা চেয়ারম্যান শাহিন চৌধুরী জানান, অবৈধ পথে দালালের মাধ্যমে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেকেই ইতালি যায়। তারা অনেক অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করে। জমিজমা বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হয় প্রতিটি পরিবার। অনেকের আবার মৃত্যু হয়। এ পদ্ধতি থেকে সকলকে বেড়িয়ে আসতে হবে। উপার্জনের জন্য বৈধ উপায়ে সরকারি নিয়ম মেনে বিদেশে গেলে এসব দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হবে। এর প্রতিকার জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিদেশ যাত্রায় এই দালালদের বিরুদ্ধে উপজেলা প্রশাসন বিভিন্ন সময় সচেতনতামূলক সভা সেমিনার করে। কিন্তু সাধারণ জনগণের কাছে এসবের মূল্যায়ন কম।
মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মাসুদ আলম বলেন, এটি একটি অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রীতিকর ও অমানবিক ঘটনা। অবৈধ মানব পাচারকারী চক্রই এ ঘটনার জন্য দায়ী। যে কোনো মূল্যে এই চক্রকে আইনের আওতায় আনা হবে।
খুলনা গেজেট/ টিএ