খুলনা, বাংলাদেশ | ১ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ১৬ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  জুলাই-আগস্টে নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশে সময় লাগবে : উপদেষ্টা আসিফ
  সাবেক বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম মারা গেছেন
  ভারতে হাসপাতালে আগুন লেগে ১০ শিশুর মৃত্যু

রাখাইনে সেনা ও বিদ্রোহীদের রক্তক্ষয়ী লড়াই, সীমান্তে রোহিঙ্গা ঠেকাতে সতর্কতা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

মিয়ানমারের সংঘাতময় রাখাইন রাজ্যে সরকারি সেনা ও বিদ্রোহীদের মধ্যে আবারও ভয়াবহ লড়াই শুরু হয়েছে। জান্তার সেনারা বিদ্রোহীদের ওপর বিমান হামলা চালাচ্ছে। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় সংঘর্ষে নিপীড়িত এ জনগোষ্ঠীর বহু সদস্য হতাহত হয়েছে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে খবর পাওয়া যাচ্ছে। সীমান্তের অদূরে হামলার ঘটনায় এ পাশের বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যও আতঙ্ক বিরাজ করছে। উদ্ভূত পরস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের আগমন ঠেকাতে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।

গতকাল শুক্রবার রাখাইনের রামব্রি টাউনশিপে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বোমারু বিমান থেকে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সদস্যদের অবস্থান লক্ষ্য করে দফায় দফায় বোমা ফেলা হয়েছে। শহরে কয়েকবার কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা গেছে। এ ছাড়া বুচিডংয়ে একটি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামে জান্তা সরকার বোমা বর্ষণ করেছে। সেখানকার একটি স্থানীয় বাজার ভস্মীভূত।

স্থানীয় সূত্র জানায়, বুচিডংয়ে ফুমালি নামে একটি রোহিঙ্গা গ্রামে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের জান্তা সরকারের মধ্যে গতকাল দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। এতে বহু রোহিঙ্গা নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তবে হতাহতের বিষয়টি নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্র নিশ্চিত করতে পারেনি।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ঘাঁটি থেকে আর্টিলারি গানসহ ভারী অস্ত্রের গোলাবর্ষণ করা হয়েছে। আহত রোহিঙ্গাদের বুচিডংয়ের স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অনেক রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে নিরাপদ আশ্রয়ে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে ছুটছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাখাইনসহ মিয়ানমারের একটি বড় অংশ এরই মধ্যে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এসব জায়গা পুনর্দখল করতে জান্তা সরকার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। এমন বাস্তবতায় যাতে ফের রোহিঙ্গার ঢল বাংলাদেশের দিকে না আসে, সেটা নিশ্চিত করতে সীমান্তে কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ বলেন, বিভিন্ন ফ্রন্টে বিরোধী সশস্ত্র গ্রুপের তুমুল প্রতিরোধের কারণে জান্তা সরকার কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা আমাদেরও কাঁধে। নতুনভাবে যাতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে, এটা নিশ্চিত করতে সীমান্তে নজরদারি বাড়াতে হবে।

তিনি বলেন, জান্তা সরকার বা বিদ্রোহী যারাই ক্ষমতায় থাকুক, আমাদের ফোকাস হবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা। জান্তা সরকার বা বিদ্রোহী; কারও পক্ষে বাংলাদেশ অবস্থান নেয়নি। বাংলাদেশ নিরপেক্ষ ভূমিকায় আছে। এই নিরপেক্ষতা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্র জোরালো করার সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে।

নাম না প্রকাশের শর্তে বিজিবির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ৩০-৪০ কিলোমিটার ভেতরে মিয়ানমারে সংঘর্ষ চলছে। একজন রোহিঙ্গারও যাতে অনুপ্রবেশ না ঘটে, এ ব্যাপারে সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্কতা রয়েছে।

স্থানীয় ও গোয়েন্দা সূত্র জানায়, রাখাইনে জান্তার কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিজেদের দখলে নিয়েছে আরাকান আর্মি। বিদ্রোহী গ্রুপটির কাছ থেকে রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে বিভিন্ন শহরে চলছে তুমুল লড়াই। রাখাইনের বহু ঘরবাড়ি জান্তা বাহিনীর বোমার আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে।

কয়েকটি ফুটেজে দেখা যায়, রাখাইনে অনেক রোহিঙ্গা হতাহত হয়ে স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। কারও হাত-পা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। অনেক রোহিঙ্গা খাবার সংকটেও পড়েছে। দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের ২৭১ কিলোমিটারের সীমান্ত রয়েছে।

কক্সবাজারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি ক্যাম্প থেকে তিনজন রোহিঙ্গা গোপনে রাখাইন গেছে। তারা সেখানে জান্তা বাহিনীর গোলাগুলির মধ্যে পড়ে। তাদের মধ্যে একজন নিহত হয়েছে। অপর দু’জন আহত হয়।

বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকা সম্প্রতি দখল করে নিয়েছে। এ অঞ্চলের নাম পালেতোয়া; চিন রাজ্যে অবস্থিত। এই জায়গাটির দূরত্ব বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১৮ কিলোমিটারের মতো।

আরাকান আর্মি জানায়, রাখাইনের মারাউক-ইউ, মিনবাইয়া, কিয়াকটাও এবং রাথেডং শহরে সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ চলছে। বেশ কয়েক বছর ধরে রাখাইন জনগোষ্ঠীর জন্য অধিকতর স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সশস্ত্র সংগ্রাম করে আসছে এ গোষ্ঠী।

বুধ ও বৃহস্পতিবার দেশটির সেনারা রাখাইনের রামব্রি শহরে ৫০০ পাউন্ডের বোমা নিক্ষেপ এবং অনেক বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয় বলে বাসিন্দারা জানিয়েছে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে কোনো স্থলযুদ্ধ ছাড়াই সেনারা ইচ্ছাকৃতভাবে জঙ্গি বিমান ব্যবহার করে রামব্রি শহরে ভারী বোমাবর্ষণ ও গুলি চালায়।

পালিয়ে আসা এক বাসিন্দা বলেন, রামব্রি ধ্বংস হয়ে গেছে। সবাই নিরাপদে পালিয়ে গেছে। আমার বাড়িও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ইউএনএইচসিআর অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে মংডু হাসপাতালে এসেছে ৪১ জন রোহিঙ্গা মুসলমান। আহত এক রোহিঙ্গা মারা গেছে।

শুক্রবার ভোর হতেই আরাকানের বুচিডংয়ে ফুমালি নামক রোহিঙ্গা গ্রামে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে অনেক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র জানায়। সেখানে মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক বন্ধ। শতাধিক রোহিঙ্গার নিহত হওয়ার কথাও বলা হচ্ছে। রোহিঙ্গারা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাওয়ার চেষ্টা করছে। অনেকে বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করছে বলে জানা যায়। তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে তাদের আগমনের কোনো খবর স্থানীয় সূত্র নিশ্চিত করেনি।

থাইল্যান্ড থেকে প্রকাশিত মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ইরাবতীর প্রতিবেদনে জানানো হয়, রাখাইনে বিপুল সংখ্যক সৈন্য পাঠিয়েছে দেশটির জান্তা। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে সেখানে আরাকান আর্মির সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষের আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে রাখাইনের আরাকান আর্মি ও আরও দুটি সশস্ত্র দল এক হয়ে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স নামে একটি জোট গঠন করেছে বেশ আগে। এই জোটের যোদ্ধারা গত অক্টোবর থেকে জান্তা সেনার ওপর হামলা চালানো শুরু করে। তাদের হামলার তীব্রতায় টিকতে না পেরে জান্তা সেনারা একাধিক স্থান থেকে পালিয়ে গেছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ এ রাজ্যের দখল নিতে সেখানে আবারও সংগঠিত হচ্ছে জান্তা বাহিনী।

ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের বরাত দিয়ে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, রাখাইনের ছয়টি শহরের দখল নিয়ে গত রোববার ও সোমবার জান্তা বাহিনী এবং আরাকান আর্মির মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়েছে। আরাকান আর্মির যোদ্ধারা দানবতীতে নৌবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে হামলা চালিয়েছে, যা দেশটির নৌ স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম বৃহৎ। এই হেডকোয়ার্টারটি যেখানে অবস্থিত, সেখানে চীনের একটি বৃহৎ প্রকল্পের কাজ চলছে।

জান্তা সৈন্যদের সঙ্গে দুই মাসেরও বেশি সময় লড়াই চালিয়ে যাওয়ার পর রাখাইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দরনগরী দখল করে নিয়েছে আরাকান আর্মি। গত নভেম্বর মাসে যুদ্ধবিরতি ভেস্তে যাওয়ার পর ২০ হাজার লোক অধ্যুষিত পাউকটাও নামের ওই শহরের বেশির ভাগ এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় বিদ্রোহীরা। বুধবার আরাকান আর্মি জানায়, তারা বন্দরনগরীর পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
সামরিক অভ্যুত্থানের পর ২০২১ সালে ক্ষমতায় আসা জান্তা সরকার প্রতিদিন পাউকটাও শহরে কামানের গোলা বর্ষণ করে আসছিল। এ ছাড়া চলছিল হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ এবং নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে হামলা।

কক্সবাজার ও টেকনাফের চিত্র

উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল গফুর বলেন, ‘গত বুধ ও বৃহস্পতিবার গভীর রাতে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে একাধারে কয়েক ঘণ্টা গুলির শব্দে সীমান্ত এলাকা ঘুমধুম ও পালংখালী এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।’

বান্দারবানের তুমব্রু ও টেকনাফ সীমান্তে মিয়ানমার অংশে থেমে থেমে ভারী গোলাগুলির বিকট শব্দ পাওয়া গেছে। শুক্রবার বিকেল থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ও টেকনাফ সীমান্তবর্তী শাহপরীর দ্বীপে ভারী গুলির শব্দে স্থানীয়দের মধ্যে আবারও ভয়ভীতি দেখা দিয়েছে।

ঘুমধুম ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘দীর্ঘ দিন পর তুমব্রু সীমান্তে আবারও মিয়ানমারের ভারী গুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। এতে সীমান্তে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা ভয়ভীতির মধ্য রয়েছে।’

জানতে চাইলে হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান নুর আহমেদ আনোয়ারী বলেন, ‘সীমান্তে মিয়ানমারে মর্টারশেলের মতো বিকট গোলাগুলির আওয়াজ সীমান্তে বসবাসকারীদের মাধ্যমে অবহিত হয়েছি। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে রেখেছি। তবে সীমান্ত দিয়ে কোনো লোকজন অনুপ্রবেশ করেছে কিনা, তা জানা নেই।’




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!